প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
আদিমকাল থেকে প্রকৃতি আঁকড়ে আছে মানুষের সবটুকু, ভিতরে-বাইরে। আমার জীবনে একটু বেশিই। বইয়ের সাথে বসবাসের কারণে হয়তো এমন হয়েছে। যাক সে কথা। আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতোই আমরা এখনকার মতো আয়োজন করে বেড়াতে যাইনি কখনো। তারপর বিয়ে-সংসার। বিশাল একটা সময় চলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো, দীর্ঘ সময় ধরে বুকের গহীন জলে যে স্বপ্ন শ্যাওলার মতো বেঁচে আছে, তা যেন স্পর্শ খুঁজে জলের বাইরে আসতে চাইছে। চিন্তা মাথার মাঝে আলো জ্বেলে চললেও তাতে জ্বলজ্বল করার মুক্তো ছিল না। তারপরের গল্প সবকিছুকে হার মানালো।
একদিন ভোরের ট্রেনে আমি একা চড়ে বসলাম। অদ্ভুত এক অনুভূতি। নিজেকে মনে হলো পাল তোলা নৌকা, পালে হাওয়া লেগে মন-প্রাণ সব সুবাস ছড়িয়ে গল্পের পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আমাদের দেশের মেয়েদের বিয়ের পর এরকম একা ঘুরতে যাওয়া খুব সহজ নয়। হাজারো রঙের মানুষের ভিড়ে এ-ই চাওয়াগুলো প্রতিটি মেয়ে কখন যে ভুলে যায়, সেই খবর রাখার সময়ও কেউ দেয় না। ট্রেন থেকে নেমে সিনজি অটোরিকশা নিজেই ঠিক করলাম। শহর ছেড়ে খাগড়াছড়ির পথে বাস চলতে শুরু করতেই মনে হলো, আহা! জীবন। কী মুগ্ধতা ছড়িয়ে গল্পের মতো আয়োজন করে প্রকৃতি সেজেছে। আমার মন মুহূর্তে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমি আমার হাত বাড়িয়ে বাতাসের তীব্র সুখটুকু টেনে নিলাম নিজেকে উজাড় করে। মনে হলো ভেতরের শুদ্ধতাটুকু আয়নার মতো স্বচ্ছতা পেয়ে হেসে উঠলো, সকালের প্রথম আলোর সম্মোহন-আদরে। আমার উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে গেলো পাশের স্থানীয় যাত্রীকে। প্রশ্ন করলো, প্রথম আসা? মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। কী অদ্ভুত মায়াজালে আমাকে টেনে নিচ্ছিল পথ। মনে হচ্ছিল এ-ই পথটুকু ছুঁয়ে থাকুক জীবনের সব রঙের খেলায়। পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টে অফিসার্স কোয়ার্টারে এক আত্মীয়ের বাসায়। অনেক ছোট বেলা থেকে গোপন একটা ইচ্ছে ছিলো, কোনো একটা ক্যান্টনমেন্টে থাকা। সত্যি হবে ভাবিনি। তা-ও নিজেকে প্রকৃতির একটা অংশ হিসেবে দেখা। নিয়ম, সম্মান, গোছানো যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে করেছে অনন্য, সম্মানিত দেশে-বিদেশে। পরদিন ঘুম ভাঙলো পাখির কিচিরমিচির শব্দে। নিজেকে অনেক সময় নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম। অদ্ভুত এক সোনালী আভা আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। নিঃশব্দের এক মায়ার চাদর আমাকে জড়িয়ে ধরলো। জীবনের কোলাহলে কখনো কখনো নিঃশব্দ যে কতো গভীর আলোড়ন তৈরি করতে পারে তা আগে টের পাইনি।
সকালে একা একা হাঁটতে বের হলাম। কালো পিচে মোড়ানো পাহাড়ি নির্জন রাস্তা, চারপাশে নাম না জানা পাখির ডাক, কাঠবিড়ালিগুলো নিজের মনে খেলে বেড়াচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখলাম। কতোটা নির্ভার, কী উচ্ছল! প্রকৃতি কতোটা উদারতায়, ভালোবাসায় যত্নে আগলে রেখেছে সব। পাহাড়ি টিলাময় পথের বাঁকে দেখা পেলাম শিউলি গাছের। ঝরা শিউলি ঘাসের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠছে। থমকে দাঁড়ালাম। স্পর্শ করে চুরি করে নিলাম তাঁর ঘ্রাণ বুকের গহীনে। যেন তাকে ধারণ করে চলতে পারি এই ইট-পাথরের দালান-কোঠাময় অমানবিক শহরে শিউলির মতো কিঞ্চিত সুবাসিত হয়ে। একটু একটু করে আলো ফুটছিল। আলো-ছায়ার খেলা চলছিল। পরদিন ছিল প্রবারণা পূর্ণিমা। এমন একটা জায়গায় এমন একটা রাত, ভাবা যায়!
সন্ধ্যার পর বের হলাম। মনে হচ্ছিল এ কোথায় আমি! চারপাশ ভেসে যাচ্ছে শান্ত, কোমল আর মনের মনন ভুলানো আলোতে। এ আলো বড় শুদ্ধ। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম হেলিপ্যাডে। চারপাশে সবুজ ঘাসের নরম শরীর, মাঝে কালো হেলিপ্যাড। আকাশ জোড়া নরম, মায়াবী সুন্দরী চাঁদ, তাকে সঙ্গ দিচ্ছিল দুটো তারা। খালি পায়ে সবুজ ঘাসের নরম শরীরের ভালোবাসা নিয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম হেলিপ্যাডের মাঝখানে। চারপাশে পাহাড়, নিজেকে বিছিয়ে দেবার ইচ্ছেটুকু সামলাতে পারলাম না। শুয়ে পড়লাম। তির তির করে বয়ে যাওয়া বাতাসের ছুঁয়ে যাওয়া প্রকৃতি আমার কানে কানে বলে উঠলো, মেয়ে তুমি সৃষ্টির মাঝে আমার মতোই সবাইকে আগলে রাখো। তুমি নারী! তুমি প্রেয়সী, তুমি বোন, তুমি ‘মা’। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে বেছে নিয়েছে তাঁর সৃষ্টি এগিয়ে নেয়ার জন্য।
লেখক : সাইদা আক্তার (পান্না), সহকারী শিক্ষিকা, উদয়ন শিশু বিদ্যালয়, চাঁদপুর।