প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২২, ০০:০০
সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চলমান বন্যায় বিশাল মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় সরকারের প্রত্যাশিত প্রস্তুতি ও সাফল্য দেখাতে না পারা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের জীবন-মানের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা পালন না করে উল্টো গণমাধ্যমের ওপর চাপ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ‘প্রেস কাউন্সিল আইন-২০২২’-এর খসড়া তৈরি, বিনাশর্তে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার সুযোগ দেয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সদস্যদের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ। একই সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলা ও পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এসে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারীগণ। টিআইবি যেমন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ থেকে বিরত থাকতে বদ্ধপরিকর, একইভাবে সংস্থাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সদস্যবৃন্দও ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে উল্লেখ করেন সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ।
উক্ত সভায় টিআইবির সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪৭জন সদস্য ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী। সভায় উপস্থাপিত টিআইবি পরিচালিত গবেষণা, অধিপরামর্শমূলক ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে সদস্যগণ ইতিবাচক মন্তব্য এবং সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভাশেষে এক ঘোষণাপত্রে উপস্থিত সদস্যবৃন্দ সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিস্তীর্ণঅঞ্চলে চলমান বন্যায় বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল’ হওয়া সত্ত্বেও এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকার প্রত্যাশিত পর্যায়ের প্রস্তুতি ও সাফল্য দেখাতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় ঘাটতি ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে আরো সক্রিয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে সম্মিলিতভাবে ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ। পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা, প্রতিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হতাশাজনক অবস্থান থেকে উত্তরণে দ্রুত এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার প্রতিপালনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন সদস্যবৃন্দ।
ঘোষণাপত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের পাশাপাশি সম্প্রতি ‘প্রেস কাউন্সিল (সংশোধন) আইন, ২০২২’-এর খসড়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তথা সকল নাগরিকের বাক্-স্বাধীনতার চর্র্চার ক্ষেত্রে দেশে যে অভূতপূর্ব উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা উল্লেখ করা হয়। খসড়ায় ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ইত্যাদি ক্ষুণœ বা ভঙ্গের দায়ে অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে’। এর ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের জীবন-মানের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা পালন না করে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে আরো সংকুচিত করার ভূমিকায় প্রেস কাউন্সিল তৎপর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্যদিকে রেগ্যুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস-এর খসড়ার কয়েকটি ধারা সংবিধান পরিপন্থী। যেখানে আইনের কয়েকটি ধারা ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় জনগণের কণ্ঠরোধে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া, খসড়া ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২’ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে, যা ব্যক্তি-তথ্য গোপনীয়তা ও সুরক্ষার নামে ব্যক্তির নিরাপত্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সর্বোপরি প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যম (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ২০২১’-এ গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যবৃন্দ। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রক্রিয়াসমূহ স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ।
সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের আহ্বান জানান সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ। নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করা, সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র, আচরণ, আকার এবং গঠন কী হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যবৃন্দ। প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার, প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, অবাধ তথ্য প্রকাশ নিশ্চিতে গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকগণের বাধাহীন পরিবেশে কার্যক্রম পরিচালনা, নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখা এবং ইভিএম- এর নির্ভুলতা ও সকল অংশীজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয় সভায়।
দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা, সরকারি ব্যয়ে সংকুলান এবং বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার যুক্তিতে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে ফেরত আনতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান সংযোজনের অভূতপূর্ব অনৈতিক এক প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক, সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। এ জাতীয় দুর্নীতি-সহায়ক সুযোগ প্রদান বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। অবিলম্বে এ সুযোগ বাতিল করে অর্থপাচারকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ।
সভায় অংশগ্রহণকারীগণ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে মূলত শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হচ্ছে আর রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রভাবশালীদের যারা এসব অনিয়মণ্ডদুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। প্রশাসনিক দিক থেকেও একই অবস্থা চলে আসছে। দুর্নীতির মূল হোতা রাঘব বোয়ালরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। সে কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়টি ক্রমশই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এসবের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আছে। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি দমনে যে আইনি এখতিয়ার দেওয়া আছে, তার যথাযথ প্রয়োগ হলে দেশে একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা ঘটত না উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এসে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ।
করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে পরিবার ও সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অর্থাৎ ধর্ষণ, বিবাহবিচ্ছেদ, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, পাচার, অপহরণ ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনায় দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব বা ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মামলার বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের বিপরীতে ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের অঙ্গীকারকে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে দুর্নীতি। ঘোষণাপত্রে এ সকল বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সদস্যবৃন্দ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হেনস্তা ও শারীরিক নিগ্রহ এবং একজন শিক্ষক হত্যার শিকার হওয়ার খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। সভায় অংশগ্রহণকারীগণ এ জাতীয় বর্বরোচিত শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি, করুণা ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান সদস্যরা।
দেশে জবাবদিহিতাহীন ও স্বেচ্ছাচারের নানা অমানবিক দৃষ্টান্ত ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের স্বার্থে এখনই এই প্রবণতার লাগাম টেনে ধরার জোরালো আহ্বান জানান সদস্যবৃন্দ। সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত অবস্থান কেবল তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে কি-না, তা নিয়ে আশঙ্কাও প্রকাশ করেন সভায় অংশগ্রহণকারীরা। মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সততা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে স্কুল পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম জোরদারের আহ্বান জানানো হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ, আদিবাসী, বাঙালি, প্রতিবন্ধী বা অন্য যেকোনো পরিচয় নির্বিশেষে সকল মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ।