প্রকাশ : ২৬ মে ২০২২, ০০:০০
খুব জাঁদরেল, শক্ত, মেজাজী সিনিয়রদের সাথে চাকুরির শুরুতে কাজ করার বদৌলতে মাথার মধ্যে ইউএনওগিরির কঠিন পাঠের কিছুটা হাতেখড়ি হয়ে গেছিল। উপজেলাতে কয়টি গ্রুপ থাকে, তাদের কোন্ জনের কী কী ইন্টারেস্ট থাকে, কাকে কখন ধরতে হয়, কীভাবে ধরতে হয়, কোন্টা দেখেও না দেখার ভান করতে হয়, কাকে দশদিন ছাড় দিতে দিতে একদিন কায়দামতো সাইজ করতে হয়-এসব স্যারদের দেখতে দেখতে মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছিল। ইউএনও হবার আগে তাই ধারণা ছিলো, উপজেলা চালাতে গেলে উপজেলায় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সব বিভাগের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কীভাবে সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক রেখে সরকারের দৈনন্দিন কার্যাদি সম্পন্ন করতে হবে। সবকিছু সঠিকভাবে নিশ্চিতভাবে করা কখনোই সম্ভব হয়নি, তবে কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটেনি।
উপজেলায় অন্য দপ্তরের সব অফিসারের সাথেই নানা সুখময় স্মৃতি রয়েছে যদিও, তবু আজ বলবো আমার শেষ কর্মস্থলে থাকা ওসি মিজান সাহেবকে নিয়ে। এর পেছনে একটা কারণ আছে। ইদানিং নানা উপজেলায় ওসি সাহেবদের সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সম্পর্কে সংকটের কথা শুনি। ব্যাপারটা খুবই অনাকাক্সিক্ষত। হ্যাঁ, প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি, ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো কোনো চারিত্রিক সীমাবদ্ধতার কারণে অন্যপক্ষ যতোই সদ্ভাব রাখার চেষ্টা করুক না কেন শেষতক কোনো লাভ হয় না। কিন্তু কিছু ঘটনা স্রেফ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ইগোকে কেন্দ্র করে ঘটে, যেখানে সম্পর্ক আর কখনোই স্বাভাবিক হয় না। আমার অভিজ্ঞতা মূলত এই অংশটিকে কেন্দ্র করে।
মিজান সাহেব আসেন শাহরাস্তি উপজেলায় আমার ইউএনও হিসেবে আসার মাস দুয়েক পর। এর পূর্ববর্তী জনের সাথে আমার সম্পর্ক মোটেও সুবিধার ছিল না। থাকার কারণও ছিলো না। তিনি যে কোনো ব্যক্তিকে খেয়াল-খুশিমতো অল্প কিছু মাদক ধরে ইউএনওর দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়ে ফোন করে বলতেন-‘ইউএনও সাহেব আপনার কাছে আসামী পাঠালাম, জেল দিয়ে দিবেন।’ নতুন ইউএনও হিসেবে আমার কাছে পাঠালে খুব অবাক হলাম, ম্যাজিস্ট্রেট আমি অথচ ওসি সাহেব আসামী ধরে আমাকে জেল-জরিমানা করতে বলবেন, যদিও ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না, তাই এমনটা আমি কখনোই করতে পারি না। আর ওসি সাহেবের নিজেরই ক্ষমতা আছে মাদক আইনে রেগুলার মামলা করার। কিন্তু তিনি তা করবেন না, এর পেছনে বহুবিধ কারণ ছিল। পরে শুনেছি এই একই কাহিনী বহু উপজেলায় ওসি সাহেবরা করে থাকেন।
আমি সুস্পষ্টভাবে ভদ্রতার সাথে ওসি সাহেবকে না করলে তিনি প্রায় উদ্ধত ভঙ্গিতে আমাকে উত্তর দিতেন, ও, তাহলে আপনি মোবাইল কোর্ট করবেন না? পুলিশের সাথে এইভাবে কাজ করলে আপনি সহযোগিতা পাবেন বলে মনে করেন?
খুব বিরক্ত হলাম এবং মনে মনে বুঝলাম, এমন লোকের সাথে মিলে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা চালানো ভবিষ্যতে খুব মুশকিল হবে। জানালাম, আপনি বিষয়টি যেভাবে নেবেন, নিতে পারেন, কিন্তু আমি যেমন আপনার ক্ষমতার জায়গায় হাত দেবো না, তেমনি আমার ক্ষমতার জায়গাটা আমাকে দেখতে দেবেন আশা করি।
তিনি তারপর থেকে আমার বিরূদ্ধে নানা জায়গায় কথাবার্তা বলে উসকে দিতে লাগলেন। খুব আন্ডার এস্টিমেট করলেন। আমিও সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। ঘটনাক্রমে এর মাস খানেক পর তিনি বদলি হয়ে গেলেন। এরপর এলেন মিজান সাহেব।
মিজান সাহেবের সাথে প্রথম দর্শনে যেটা সবচেয়ে ভাল লেগেছিল, তিনি থানাতে যোগদানের পর ফোনে সৌজন্য আলাপের পর আমার অফিসে এসে পরিচয় পর্বের পর বললেন, 'আমার থানা চালাতে গেলে আপনার সহযোগিতা লাগবে, আর আমার মনে হয় আপনার উপজেলা চালাতে গেলে থানার সহযোগিতা লাগবে। কাজেই আপনার সাথে আমার সম্পর্ক ভাল থাকলে আমাদের দুজনেরই লাভ’।
আমিও একটা কথা বলেছিলাম, যা তিনি মেনে নিয়েছিলেন-দেখেন জেলায় ডিসি স্যার, বা আপনার এসপি স্যারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক যাই হোক, আমরা একই উপজেলায় যেহেতু কাজ করবো, কাজেই আমাদের সম্পর্ক যেন এমন হয় যাতে আপনি বা আমি চলে যাওয়ার সময় যেন ভালমতো হাত মিলিয়ে যেতে পারি, কিংবা পরে অন্য কোথাও দেখা হলে যেন কোলাকুলি করতে পারি। তিনিও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
বলা বাহুল্য, তার এই কথার মধ্যে আন্তরিকতা ছিল। হাজার হোক নোয়াখালির মানুষ। আরও একটা ব্যাপার ছিল। তিনি জানতেন, ইউএনও হলেও আমরা বয়সে তরুণ, আমাদের সব সিদ্ধান্ত ঠিক না। তিনি কীভাবে যেন আমাকে সময়মতো সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন, কিন্তু কখনোই তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন না, বরং আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন। এইখানেই অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি, যা আমার জন্যে একটা শক্তির জায়গা।
তার সাথে আমার প্রায় দেড় বছরের একসাথে কাজ করার সুযোগে অনেক বিষয়েই দ্বিমত হয়েছে, আমি আমার প্রশাসনিক দিক দেখেছি, তিনিও তার মতো থানার কার্যাদি চালিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপজেলার কোনো ছোট-বড় নেতা অন্যায্য দাবি, মাস্তানি করার সুযোগ পেতো না, কারণ আমরা আগে থেকেই পরামর্শ করে নিতাম, এমপি সাহেবের কাছে আমাদের বক্তব্য হতো একই। তখন এমপি সাহেবের উপায় থাকতো না আমাদের কথা না মানার। এর ফলাফল এমন হতো যে, অনেক টাউট-বাটপার উপজেলার ত্রিসীমানায় আসতে সাহস পেতো না।
আমরা একসাথে পিঠা উৎসব করেছি, শীতের রাতের আঁধারে কম্বল বিতরণ করেছি, মাছের পোনা ছেড়েছি, মাদকের অপারেশন করেছি, ডাকাত ধরাকে কেন্দ্র করে বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করেছি। সবচাইতে বড় যে কাজ করেছি, তা হলো ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে একসাথে কাজ করা। খুব চ্যালেঞ্জিং ঐ নির্বাচনের সময়ে সম্ভবতঃ বাংলাদেশের সবচাইতে সুষ্ঠু নির্বাচন করেছিলাম আমরা, বলা যায় সকল জনপ্রতিনিধি প্রকৃত অর্থে শতভাগ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় আসতে পেরেছে, এক বিন্দু এদিক ওদিক হয়নি। এক্ষেত্রে আমার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জেসমিন ও জেলা থেকে আসা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা ছাড়াও ওসি সাহেবের সাপোর্ট ছিল অবিস্মরণীয়। হরিহর আত্মার মতো একসাথে কাজ করেছি। এমন নিখুঁত পরিকল্পনা আমরা করেছিলাম যে, নির্বাচনের দিন হাঙ্গামাকারীরা কেন্দ্র হামলা করতে যাওয়ার মিনিট দুয়েকের মধ্যে বিজিবি/র্যাব/পুলিশের কাছে বেধড়ক পিটান খেয়ে মুল্লুক ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এতো সফল নির্বাচনের পর পুরো এলাকার জনগণ তো বটেই, আমাদের এমপি সাহেব ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ওসি সাহেবের নেতৃত্বে পুলিশের সেদিনের ভূমিকা এতো চমৎকার ছিল যে, আমরা এখনো প্রায়ই আলাপ করি সেটা আমাদের স্বর্ণসময় ছিল কি-না।
সেই যে মিজান সাহেবের সাথে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল আজ অবধি তেমনই রয়ে গেল। মনে পড়ে ঈদে প্রথম পাঞ্জাবিটা তার কাছ থেকেই উপহার পেয়েছিলাম। তার থানার পুকুরে মাছের পোনা দরকার কিংবা ওসির বাসাটা মেরামত দরকার-উপজেলা পরিষদ থেকেই তার ব্যবস্থা হতো। আমার বাসা থেকে উপজেলার কুখ্যাত চোর আমার ব্যক্তিগত ল্যাপটপ ও ট্যাব চুরি করে নিয়ে গেল। ওসি সাহেব এত দুঃখ পেলেন যে, আমাকে কথা দিলেন যেভাবেই হোক উদ্ধার করে দিবেন। প্রায় বিশ দিনের মধ্যে বহুদূর থেকে তার ডানহাত এসআই মান্নানের (বর্তমানে ইন্সপেক্টর) মাধ্যমে ঠিকই উদ্ধার করে দিলেন।
উপজেলাতে মাদকের ব্যবহার বেড়ে গেলো পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলার মধ্যস্থলে হওয়ার কারণে। সিস্টেম খোকন নামে একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী নটের গুরু বলে জানতে পারলাম। ওসি মিজান সাহেবের সাথে আলাপ করলাম। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে হেসে উনাকে বলেছিলাম, আপনি কত দক্ষ ওসি বুঝবো ঐ ব্যাটাকে ধরতে পারলে। তিনিও ভালোভাবেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। ঠিক মাসখানেকের মধ্যে তিনি ঠিকই পাকড়াও করে আনেন। পূর্ববর্তী মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকায় চালান দিলে এলাকায় অনেকটা শান্তি ফিরে আসে।
আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া কেমন তা আমার ডিসি আব্দুস সবুর মন্ডল স্যার ও এসপি ম্যাডাম শামসুন্নাহার ইউপি নির্বাচনের আগে উপজেলা ভিজিটে এসে বুঝে গেলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় একটা সুবিধা নিতাম, ওসি সাহেবকে দিতাম না। তা হলো, এসপি মহোদয় আমার উপজেলাতে এলে আমিই তাঁকে আমার বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতাম, ওসি সাহেবকে কখনো সুযোগ দিতাম না। এ নিয়ে তিনি প্রায়ই গোস্যা করতেন, বলতেন-' ডিসি স্যার না হয় আপনার বস, আপনি স্যারকে আপনার বাংলোয় খাওয়াবেন সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার এসপি স্যারকে আমি তো আমার থানায় আয়োজন করবোই'। কিন্তু সে সুযোগ তিনি কখনোই আমার কাছ থেকে পাননি। এক্ষেত্রে সবসময়ই বড় একরোখা ছিলাম।
আরও একটি ব্যতিক্রম ঘটনা হলো, ডিসি স্যার আমার উপজেলায় এলে থানা পরিদর্শন করতে গেলে পুলিশ রেগুলেশন মোতাবেক ওসি সাহেব নিজে থেকে সালামি প্রদান করতেন, এতে জেলা থেকেও তার ওপর কোন অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা ছিল না এবং তিনি তা পছন্দও করতেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল, যেটা আইনে আছে সেটা তো করতেই হবে, আর আমার এসপি সাহেবকে যদি আপনি সম্মান দেন তাহলে আমি আমার নিয়মতান্ত্রিক কাজটা কেন করবো না।
এসপি ম্যাডামও বুঝতেন, হেসে বলতেন, আপনাদের এই আতিথেয়তার জন্যে আর এই উপজেলায় আসা যাবে না। আমার বাসায় যখন ডিসি স্যার, এসপি মহোদয়, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ সভাপতিসহ আমরা একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করতাম তখন আন্তরিকতার মধ্যে সবাই একসূত্রে গেঁথে যেত। স্যারেরা চলে যাওয়ার সময় বলতেন, এই উপজেলা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা যে করতে হবে না তা বুঝে গেছি।
এইভাবে কখন যে দিন চলে গেল আর একদিন আমার হঠাৎ করে বদলি হয়ে গেল। আমার এসি ল্যান্ড জেসমিন, পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব ছাড়া আর যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে সেটা ওসি সাহেব। বাংলাদেশে পুলিশি চাকরির রূঢ় বাস্তবতায় যেখানে অশ্রূজল শুকিয়ে যায়, যেখানে আমি বিদায় নেওয়ার সময় তার চোখ ছলছল করে ওঠে। তা ঢাকতে আমার বাসা থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হয়ে যান।
পরদিন বিকেলে যখন গাড়িতে উঠে শেষবারের মতো উপজেলা ছাড়ছি, তখন দেখি তার থানার সবচেয়ে নতুন গাড়িটা আমার সামনে সামনে জেলার শেষ সীমানা পর্যন্ত প্রটোকল দিয়ে শেষে দায়িত্বরত এসআই সাহেব স্যালুট দিয়ে ভালবাসা ও সম্মানের শেষ পালকটা আমার বুকে গেঁথে দিলেন।
না মিজান সাহেব তাঁর দায়িত্ব থেকে কোনোদিন সরে এসেছেন, না কোনোদিন আমিও আমার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছি। আমরা সব বিষয়ে সবসময় একমতও হইনি, কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসেনি। কার সম্মান কতোটা বেশি সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনোদিন নামার প্রয়োজন হয়নি। বরং দ্বিমত হলেও আমরা পরস্পরের মতকে সম্মান করেছি। একে অন্যকে পরিপূরক ভেবেছি।
আজ এই সুদূর পরবাসে বসেও আপনাকে অনেক মিস করি মিজানুর রহমান সাহেব। কী একটা অদ্ভূত সময় কাটিয়েছি, না? ভালো থাকবেন সবসময়।