রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৮ মে ২০২২, ০০:০০

মার্কসবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক বিধান
অনলাইন ডেস্ক

জার্মান দার্শনিক মহামতি কার্ল মার্কস। এ মহান ব্যক্তির দর্শনতত্ত্ব সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। দর্শন চর্চার মধ্য দিয়ে মানবজাতির মুক্তির পথ বের করেছেন। তিনি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism), যা ছিল তার অনবদ্য আবিষ্কার। এ তত্ত্ব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে গেলেন দার্শনিক। নিপীড়িত মানুষের পথের দিশা দেখাতে তাঁর অনিসন্ধিৎসু চেষ্টা সারা বিশ্বে প্রবাহিত হয়েছিলো। শোষক-শোষিতের সংঘাত বুঝতে পেরে তিনি শোষিতের পক্ষে ছিলেন। মানবমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে উজার করে দিয়ে বিপ্লবী কাজে অংশ নিয়ে তিনি হয়ে গেলেন বিপ্লবী। বিপ্লবী কাজের মধ্য দিয়ে তিনি দেখলেন যে, মানুষ শোষিত হচ্ছে অর্থনীতিতে বৈষম্যের কারণে। তাই তিনি অর্থনীতির আসল স্বরূপ উন্মোচন করে বের করলেন ‘শ্রমের উদ্বৃত্ত্ব মূল্যতত্ত্ব’। মানুষের শ্রম মালিক শ্রেণি কীভাবে শোষণ করেন এবং কতটুকু শোষণ করছেন-সেটার মাত্রা উন্মোচন করলেন মার্কস। তিনি অর্থনীতিতে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সৃষ্টি করলের ‘রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র’। তাই তিনি এক সময় হয়ে উঠলেন অর্থনীতিবিদ। কার্ল মার্কস ১৮১৮ সালের ৫ মে জার্মানের বার্লিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। তিনি শুধু তথাকথিত বস্তুবাদী নয়; তিনি বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব অর্থাৎ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান রয়েছে-এ বিষয়টি উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন। বস্তুবাদী দার্শনিক ডেমোক্রিটাস বস্তুর মধ্যে যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব আছে সেটি উদ্ঘাটন করতে পারেন নি বলেই সেটি ছিল যান্ত্রিক। দার্শনিক এপিকিউরাস ডেমোক্রিটাসের এ তত্ত্বকে উপেক্ষা করেছেন। ডেমোক্রিটাস বস্তু থেকে চেতনাকে আলাদা করে দেখেছেন। কিন্তু বস্তু থেকে চেতনা আলাদা হতে পারে না-এ মত দেন এপিকিউরাস। শেষ পর্যন্ত দার্শনিক এপিকিউরাস দ্বারা প্রভাবিত হন মার্কস।

ডেমোক্রিটাস মনে করতেন, মানুষ পরমাণু থেকে সৃষ্টি, তাই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা নেই-সে পরাধীন। এপিকিউরাস তার এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মানুষ প্রকৃতির কঠোর নিয়মে বাঁধা থাকেন না, সে স্বাধীনভাবে চলতে পারেন। মার্কস এপিকিউরাসের তত্ত্বকে মেনে নেন, আর ডেমোক্রিটাসের তত্ত্বকে নাকচ করে দেন। মার্কস বলেন, যে ঈশ্বর বা ধর্ম নয়, দর্শনই মানুষকে বাঁচার রসদ যোগাবে, কারণ দর্শনেই আছে জগৎ সম্পর্কে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি।

তিনি এ জায়গায় যোগ করে বলেন, মানুষ যতদিন নিজেকে ও জগৎকে জানতে না পারবে ততদিন ধর্ম তাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। তিনি সর্বহারাদের উদ্দেশ্য বলেন, শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারাদের হারাবার কিছুই নেই। জয় করবার জন্য আছে সারাবিশ্ব।

এভাবে মার্কস ভাববাদী প্রবণতাকে মেনে নিতে পারেন নি। তরুণ মার্কস প্রথমে হেগেলের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরিণত বয়সে দার্শনিক হেগেলের দর্শনতত্ত্বকে তুলোধুনো করেছেন। তবে ব্যেদ্ধিক মহল মনে করেন, মার্কসের চিন্তা কিছু সবচেয়ে সেরা তা তাঁর নিজস্ব, আর দ্বিতীয় যা সেরা তা হেগেল থেকে উদ্ভূত। মার্কস মাত্র ২৪ বছর বয়সেই থিসিস লিখেন, যার মর্মকথা হচ্ছে, কীভাবে মানুষ যথার্থ স্বাধীনতা পেতে পারে, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ওই সময় জার্মান অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ ছিলো। তবে চিন্তাগত তথা বুদ্ধিগত দিক দিয়ে ‘জার্মান দর্শনের স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। মার্কস প্রথমে হেগেলের তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন। হেগেল বস্তুতে দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করলেও ভাতকে বস্তু থেকে আলাদা করে দেখেন বলে হেগেল একজন ভাববাদী দার্শনিক। অর্থাৎ পরাবাস্তবতা এবং অলৌকিতায় বিশ্বাসী। তার এ চিন্তাধারায় ঈশ্বর তন্ত্রই প্রকাশ পায়। মার্কস ফয়েরবাখের তত্ত্ব দ্বারা আকৃষ্ট হন। প্রকৃতি ও মানুষের বাইরে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই-এ মতটি ব্যক্ত করেন তিনি। মার্কস এবং তার বন্ধু এঙ্গেলস দার্শনিক ফয়েরবাখের দর্শনে প্রভাবিত হন।

মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির চোরাবালির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ‘উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব’ তারই মানদণ্ড। এটি মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদের মূলভিত্তি। লেনিন, এটিকে অর্থনৈতিক মতবাদের ভিত্তিপ্রস্তর বলে আখ্যায়িত করেন। মার্কসের প্রধান রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘পুঁজি’ (capital) তে উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব সন্নিবেশন করা হয়েছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির গতি ও বিকাশের নিয়ম এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উদ্ঘাটন করেছেন এ তত্ত্বে। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির এ নিয়মই হলো ‘উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব’। এ আবিষ্কারই মার্কসের রাজনৈতিক অর্থনীতির বড় কৃতিত্ব হিসেবে ধরেছেন বিশেষজ্ঞগণ। মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে এ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডোর মূল্যের শ্রম তত্ত্ব পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে রক্ষা করে। তাঁরা মনে করতেন এ তত্ত্বের মাধ্যমেই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে। সুবিদিত যে, পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আসতে পারে না বিধায় মার্কস আরও একধাপ এগিয়ে শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। মার্কস মনে করেন, প্ুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সবকিছু পণ্যে পরিণত হয়। এমনকি মানুষও পণ্য হয়ে যায়। অবাধে কেনাবেচা হয় মানুষের শ্রম শক্তি। এ সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন সম্পর্ক মালিক-শ্রমিক। শ্রমিকের শ্রম এখানে পণ্য হিসেবে গণ্য হয়। পুঁজিবাদী সমাজ শোষণমূলক সমাজ। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমজীবীগণ শ্রমের মালিক। দাস যুগে শ্রমিক নিজেই দাস মালিকের গোলাম কিংবা অধীন। আর সামন্তবাদী সমাজেও কৃষকের শ্রমশক্তি সামন্তের অধীনে ছিলো। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে শ্রম স্বাধীন।

মার্কস এ জায়গায় বলেন, পণ্যের বাজারে শ্রমিক দুই অর্থে স্বাধীন। এক. পণ্য হিসেবে সে তার শ্রম শক্তির মালিক। দুই. অন্য অর্থে শ্রম শক্তি ছাড়া বেচার আর কিছুই নেই। সে কারণে শ্রমিককে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে কম মূল্যে শ্রম বিক্রি করতে হয়। শ্রমিক শোষিত হতে থাকেন এভাবে। শ্রমিক অনন্যোপায় হয়ে পড়েন। তিনি শ্রম দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হন। তাইতো একদল ধনী থেকে আরও ধনী হতে থাকেন। আরেক দল গরিব থেকে আরও গরিব অতঃপর নিঃস্ব হতে থাকেন। এখানে মহামতি মার্কসের এ বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য-ঈশ্বর নয়, সমাজই ধনী-গরিব সৃষ্টি করে।

মার্কস সমাজের ভিতরকার বৈষম্যের কারণ উদ্ঘাটন করেন। অতঃপর তিনি সমাজবিপ্লবে নিজেকে মেলে ধরেন। ১৮৪২ সালে তিনি যখন সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেন তখন তিনি তরুণ হেগেলপন্থীদের মুখপত্র ‘হ্যালো বার্ষিকী’ ও আর্নল্ড রুগের ‘ডয়েশ্চে ইয়ারবুখে’ তিনি লেখালেখি করতে থাকেন। এ সময় তরুণ হেগেলপন্থীদের সাথে নতুন ধরনের আন্দোলনে যোগ দেন। এ আন্দোলনটি রাজনৈতিক র‌্যাডিকেল আন্দোলনে রূপ নেয়। র‌্যাডিকেল আন্দোলনকারীদের পত্রিকা ‘রাইনিশে সাইটুঙ্গ’-এর সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে এ পত্রিকার তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এ পত্রিকার দায়িত্বে থাকাকালে অমানবিক প্রুশীয় সমাজ ব্যবস্থায়, সমাজতন্ত্রের আধিপত্যে ও আমলাতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গুরুতর আঘাত হানেন। পরে সরকার পত্রিকটি নিষিদ্ধ করে দেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মার্কস অর্থ সংকটে পতিত হন। প্যারিসে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখনও তাঁর লড়াই-সংগ্রাম চলমান।

আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মার্কসের নতুন জীবন শুরু হয়। ১৮৪৩ সালে মার্কস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। যার সাথে প্রণয় ঘটে, তিনি হলেন বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পী এবং ট্রিয় নগরীর সবচেয়ে সুন্দরী তরুণী। নাম তার নাম জেনি। পুরো নাম জেনি ফন ভেস্টফালেন। জেনি ছিলেন মার্কসের বড় বোনের বান্ধবী। জেনি মার্কস থেকে চার বছরের বড়। জেনি ধনী পরিবারের সন্তান। পুরো জীবনের সহযাত্রী হিসেবে মার্কসের হয়ে থেকেছেন জেনি। এঙ্গেলসের ভাষায় তিনি কেবল স্বামীর ভাগ্য, শ্রম, সংগ্রামের ভাগিদারই ছিলেন না, নিজেই তাতে অংশ নিতেন অসাধারণ সচেতনতায় আর দৃপ্ত আবেগে।

রাইনিশে সাইটুঙ্গ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে প্যারিসে পাড়ি দেন। এখানে তিনি আর্নল্ডের সাথে ‘জার্মান-ফরাসী বার্ষিকী’ নামে একটি পত্রিকা নতুন করে প্রকাশ করেন। হেগেলের মতকে খণ্ডন করার পর দার্শনিক ফয়েরবাখের দর্শন দ্বারা আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি বুঝতে পারেন যে, একমাত্র সমাজ বিপ্লবই জার্মানীতে আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। আস্তে আস্তে মার্কস হেগেলীয় ভাবধারা থেকে ক্রমশ সরে আসেন। এরপর সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় নিবিষ্ট হন। মার্কস হয়ে ওঠেন শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের প্রধান নায়ক। বিপ্লবের প্রবক্তা। হয়ে ওঠেন কমিউনিস্ট। মার্কসীয় তত্ত্বকে শক্তিশালী হওয়ার পেছনে যার ভূমিকা বলা ছাড়া উপায় নেই, তিনি হলেন এঙ্গেলস। মার্কসীয় তত্ত্বকে বিকাশমান ধারায় নিয়ে যেতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক ও ব্যবহারিক বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপ। এ কাজটি মার্কস-এঙ্গেলস একত্রে করেন। এঙ্গেলস প্যারিসে কিছুদিন অবস্থানকালে ১৮৪৪ সালে মার্কসের সাথে প্রথম পরিচয় হয়। সে থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন মার্কসের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। ১৮৪৪ থেকে ১৮৫২ সালের এ সময়ের মধ্যে মার্কসবাদ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ বছরেই প্রকাশিত হয় মার্কসের Economic and philosophic Manuscript of 1844।

১৮৪৫ সালে এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে প্রকাশিত হয় The Holy Family গ্রন্থ। এটি প্রথমে একটি প্রচারপত্র হলেও পরবর্তীতে এটি হয়ে উঠে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির ব্যাখ্যা। এ গ্রন্থে ব্রুনো বাউয়ের ভাববাদী তত্ত্বের সমালোচনা করেন। মার্কস বাউয়ের গ্রন্থে ভাববাদী চেতনা দেখতে পান যা হেগেলবাদীদের সাথে মিল রয়েছে। মার্কসের সামাজিক বস্তুবাদী ধারণা অর্থনীতি বিষয়ক তত্ত্ব এবং পুরো জীবনের সংগ্রাম মার্কসবাদ হিসেবে আখ্যায়িত। মার্কস নিজেই বলে গেছেন, মার্কসবাদ কোন মতবাদ নয়। এমন একদিন আসবে মার্কসবাদও অকার্যকর হবে। সমাজ বিবর্তনের মাধ্যমে এর পরিবর্তন ঘটবে। মার্কস তার জীবদ্দশায় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী অর্থ ব্যবস্থা দেখে না গেলেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি যখন সংকটে পড়বে তখন পুঁজিপতিরা নিজের দেশের জনগণকে শোষণতো করবেই পরবর্তীতে অন্য দেশের জনগণকে শোষণ করবে পুঁজি লগ্নি করে। এ সা¤্র্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে মার্কস নয়া উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

১৮৪৫ সালে প্যারিসে জার্মান রেডিকেলদের Vorwarts পত্রিকায় লেখালেখি করলে, প্যারিসের সমাজব্যবস্থার সমালোচনা হলে সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। এরপর মার্কস ব্রাসেলসে চলে যান। ১৮৪৬ সালে প্রকাশিত হয় 'These on Feuerbach ' এবং 'The German Ideology '।

মার্কসের কমিউনিজম সম্পর্কে তাত্ত্বিক ভাবনার উন্মেষ ঘটে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ সালের দিকে। ‘সম্পত্তির চোর্যবৃত্তি’ সম্পর্কে প্রুধোঁর মতকে মৃদু সমর্থন করেছেন, কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মার্কস তাঁর দর্শনকে দরিদ্র বলে অভিহিত করেন। প্রুধোঁর সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাটাও ‘কল্পীয় স্বর্গ’ সমাজতন্ত্র বলে অভিহিত করার আভাস দেন। ইতিহাসের নির্দিষ্ট স্তরে শ্রমিকসমাজ যেভাবে শোষিত হয়, শ্রমিক শ্রেণিই যে এ শোষণের প্রধান উপকরণ এটা প্রুধোঁর ব্যাখ্যায় আসেনি। মার্কস সেটাকে উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন হেতু তিনি দার্শনিক ও বিপ্লবী তত্ত্বই নির্মাণ করেন নি, তত্ত্বকে তিনি প্রয়োগের সাথে মিলিয়ে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করেন। তাই তিনি বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ করে বিপ্লবী রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হন। তাই মার্কসের এ বক্তব্যটি এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, এতদিন প-িতেরা দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেই গেছেন, এখন পাল্টানোটাই আসল কাজ। এ প্রসঙ্গে আরেকটি তত্ত্ব খুবই গুরুত্বর্প্ণূ যে, বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে না, বিপ্লবী সংগঠন ছাড়া বিপ্লব হয় না। তিনি একটি সভায় দার্শনিক ভেটলিংয়ের বিরুদ্ধে এমন তত্ত্বটি খাড়া করান।

১৮৪৭ সালে কমিউনিস্ট লীগের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ দলের পুরানো স্লোগান ছিল, সব মানুষ ভাই ভাই। মার্কস-এঙ্গেলস এ স্লোগান পাল্টে দিয়ে নতুন স্লোগান জুড়ে দেন, তা হলো, দুনিয়ার মজদুর এক হও।

দ্বিতীয় কংগ্রেসে মার্কস-এঙ্গেলস একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেন, সেটা হলো- Manifesto of the Communist party অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। এই ইশতেহারটি সমাজতান্ত্রিক রচনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হিসেবে আলোচনায় এসেছে।

মার্কস শুরুতেই জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রত্যাশা করেননি। তখন জার্মানে সংসদীয় সংবিধান এবং জাতীয় ঐক্যের লড়াই চলছে। এতে মার্কস আকৃষ্ট হন। এর পাশাপাশি ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয়। ভোটাধিকার, সংসদ বাতিল ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের আন্দোলন ছিল ইংল্যান্ডের প্রধান সংগ্রাম। এ সময় মার্কস জার্মান ছেড়ে প্যারিসে যান। এরপর চলে যান কোলানে। কোলানে গিয়ে ‘নিউ রাইনিশে সাইটুঙ্গ’ নামীয় পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এটি ছিল তাঁর একক নিয়ন্ত্রণে। জার্মানীকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এ পত্রিকার প্রধান কর্তব্য ছিলো। তিনি ১৮৪৮ সালে পত্রিকার সম্পাদনার পাশাপাশি কমিউনিস্ট লীগের সভাপতির দায়িত্বগ্রহণ করেন। এ থেকে শ্রেণি আন্দোলন, শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ও শ্রমিক আন্দোলনের লক্ষ্য এবং সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন।

১৮৪৯ সালে মার্কসের আরেকটি বিখ্যাত রচনা প্রকাশ হয়, যার নাম Wage, Labour and Capital। ১৮৪৯ সালে নিউ রাইনিশে সাইটুঙ্গ পত্রিকাটি জার্মান সরকার নিষিদ্ধ করেন এবং মার্কসকে জার্মান থেকে বহিষ্কার করেন। সেখান থেকে ফ্রান্সে গেলে সেখানেও বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান। জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি লন্ডনে কাটান।

১৮৫২ সালে কমিউনিস্ট লীগ ভেঙ্গে যায়। এ সময়ে প্রায়োগিক রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেলেও তখন অর্থনীতি বিষয়ে মনোযোগী হন। অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন। এ সময় তিনি অর্থনীতি বিষয়ে বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করেন। ১৮৬৩ সাল নাগাদ পুঁজি গ্রন্থটির পা-ুলিপি তৈরি হয়। ১৮৬৭ সাল নাগাদ ‘পুঁজি’ (capital) গ্রন্থটি প্রকাশ হয়। তিনটি খণ্ডের মধ্যে একটি তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেন। বাকি দুটি খণ্ড তাঁর বন্ধু এঙ্গেলস প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তাঁর অতি দামী আবিষ্কার ‘শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব’ তথা পুঁজিবাদের গতির নিয়ম। এটা তাঁর জীবনে দ্বিতীয় আবিষ্কার। প্রথমটি হলো, ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা। এ কারণে এঙ্গেলস উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন, “পৃথিবীর সমস্ত সুসভ্য দেশের শ্রমিক আন্দোলনের তত্ত্ব ও কর্মসূচিস্বরূপ আধুনিক বস্তুবাদ ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পাওয়া যায় মার্কসের যে মতামতের সমগ্রতা থেকে, তার অপূর্ব সঙ্গতি ও অখণ্ডতা তাঁর শত্রুরা পর্যন্ত স্বীকার করে”। মার্কসকে এঙ্গেলস পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক হিসেবে অভিহিত করেন এবং তিনি বলেন, এই মানুষটির মৃত্যুতে ইউরোপ-আমেরিকার বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত এবং ইতিহাস-বিজ্ঞান উভয়েরই অপূরণীয় ক্ষতি হলো।

মার্কস পুরোহিত ও সন্যাসিদের লক্ষ্য করে বলেন, “তোমরা হৃদয়বৃত্তিতে নাড়া দাও, দর্শন নাড়া দেয় বিচারশক্তিকে; তোমরা দাও অভিশাপ, দর্শন শেখায়; তোমরা স্বর্গ-মর্ত্যরে প্রতিশ্রুতি দাও, দর্শন সত্য ছাড়া কিছুই দেয় না; তোমরা বিশ্বাস দাবি কর; দর্শন দাবি করে বিশ্বাস নয়,পরখ করার; তোমরা আতঙ্কিত কর, দর্শন শান্ত করে।”

মার্কস তাঁর দার্শনিক চিন্তা থেকে দেখান যে, শ্রম হলো তার চেতনা ও আবেগের সংগঠন। শ্রমই মানুষের চাহিদা ও আকাক্সক্ষা নির্ধারণ করে। শ্রম, চেতনা ও ভাষার মাধ্যমে সমবেতভাবে ক্রিয়াকলাপ করতে সক্ষম হয়। এভাবে গড়ে ওঠে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। এ সম্পর্কের নামই সামাজিক সম্পর্ক। তিনি দেখান যে, দর্শন যুগের সৃষ্টিকালের সৃষ্টি। মার্কস দর্শন চর্চা করে প্রথমে দার্শনিক হন। দর্শন চর্চা করতে গিয়ে সমাজের গতি খুঁজে পান। সেখানে খুঁজে পান শ্রেণি দ্বন্দ্ব। একদল শোষক আর একদল শোষিত। তিনি শোষিতের পক্ষে তথা শ্রমজীবীদের ভাগ্য পরিবর্তনে বিপ্লবী কাজে যুক্ত হন। এভাবে তিনি হয়ে গেলেন বিপ্লবী। মানুষের উন্নতি কিংবা অনুন্নতির পেছনে রয়েছে অর্থনীতি। সামাজিক অর্থব্যবস্থাই মানুষের ভাগ্য নির্ণায়ক, কোনো ঈশ্বর নয়। সে কারণে অর্থনীতির গতি-পরিবর্তনকে নিয়ে রাজনীতি দিয়ে বিচার করেছেন। তাই তিনি অর্থনীতিকে রাজনীতির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। সে কারণে অর্থনীতিতে গবেষণায় গভীর মনোনিবেশ করেন। তিনি আবিষ্কার করেন রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র। এ কথাটি উল্লেখযোগ্য যে, ইতিহাসকে বস্তুবাসী চেতনার দ্বারা নির্ণয় করেছেন। সে কারণে একে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। সমাজে শ্রেণি দ্বন্দ্ব বিদ্যমান বলে আবিষ্কার করেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। ইতিহাসের গতিবিধি দ্বান্দ্বিক নিয়মে চলছে বলে তিনি তত্ত্ব দেন। তাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তাঁর অন্যতম উদ্ঘাটন।

অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণার পর মার্কসের মধ্যে পুনর্জাগরণ শুরু হয়। তিনি নতুন করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। ফরাসী ও ইংরেজদের ট্রেড ইউনিয়নপন্থী সংগঠনে জড়িত হন। তিনি প্যারি কমিউন আন্দোলনে যোগ দেন। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন সম্পর্কে 'The Civil War in France ' নামক রচনা লিখেন। তিনি প্যারি কমিউন থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙ্গে কিভাবে কিভাবে শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সে বিষয়ে বিশ্বের মানুষকে আহবান জানান। তিন মাসের মাথায় প্যারি কমিউন ভেঙ্গে যায়। এরপর মার্কস জার্মান রাজনীতির দিকে অবলোকন করেন। লাসালেপন্থী, যারা প্রুঁশীয় কর্তৃত্বে জার্মান ঐক্যে আগ্রহী। আরেকটি গ্রুপের বিপরীতে উদারপন্থী বুর্জোয়া দল। মার্কস উদারপন্থীদের সাথেই ছিলেন।

১৮৭০ দশকের দিকে মার্কস ও তাঁর স্ত্রী জেনিফেখ জেনির স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। মার্কস আক্রান্ত হন ক্রনিক ব্রনকাইটিস ও ফুসফুসের আলসারে এবং জেনি লিভার ক্যান্সারে।

মার্কসের অতি যৌবনকালে অর্থাৎ ১৯৫২ সালের পর দুই কন্যার মৃত্যু ঘটে। ১৮৫৫ সালে তাঁর আট বছরের পুত্র এডগারের মৃত্যু হয়।

১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর স্ত্রী জেনি না ফেরার দেশে চলে যান। স্ত্রীর মৃত্যুতে মার্কসের মৃত্যু ঘটে বলে এঙ্গেলস মত দেন। ১৮৮৩ সালে মার্কসের আরেক কন্যার মৃত্যু হয়। এর দুই মাস পরে ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ মার্কসের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু হলেও মার্কসের সৃষ্টির মৃত্যু নেই। তাঁর সৃষ্টি মানুষকে আলোকিত করে। সমাজ হয়ে ওঠে সভ্য। মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তিনি দেখে গিয়েছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন লেনিন, মাওসেতুং, হোচিমিন, ফিদেল ক্যাস্ত্রোসহ অসংখ্য বিপ্লবীরা। বাংলাদেশেও শ্রমজীবী মেহনতীদের সমাজ তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে যদি মানুষের চেতনা হয় শ্রেণিহীন সমাজের চেতনা, তখনই গভীর সংকটে নিমজ্জিত পুঁজিবাদী সমাজ ভেঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে-এটাই হবে আগামী দিনের কার্যসূচি।

লেখক পরিচিতি : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চাঁদপুর জেলা কমিটি; সভাপতি, চাঁদপুর লেখক পরিষদ, চাঁদপুর। মোবাইল-০১৬২৭৮৪০৪৯৫।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়