প্রকাশ : ১৫ মে ২০২২, ০০:০০
আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা। আজ হতে ২৫৬৬ বছর আগে কপিলাবাস্তু রাজ্যের লুম্বিনী কাননে মা মহামায়ার গর্ভ হতে এক শাক্য রাজকুমারের জন্ম হয়। এই রাজকুমারের গৃহী নাম রাখা হলো সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিনের মাথায় মা মহামায়ার প্রয়াণ হলে তাঁকে লালন-পালন করেন তাঁরই মায়ের আপন বোন মহাপ্রজাবতী গৌতমী। তাই মাসী পুত্র হিসেবেও সিদ্ধার্থের নাম হয় গৌতম। বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ তথা আলোকনপ্রাপ্তি এবং মহাপরিনির্বাণ বা মহাপ্রয়াণও এই পূর্ণিমা তিথিতে। তাই আজ তথাগত বুদ্ধের প্রতি যথাযথ ভাব-গাম্ভীর্যে বন্দনা জানিয়ে বুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত বৃক্ষের মিথোলজি বিষয়ে আলোকপাত করছি।
বৃক্ষ এক মৌন তাপস। মানুষের কল্যাণে তার দানের যে তপস্যা, তা হার মানায় পরার্থে জীবন-মন দেয়ার সকল পৌরাণিক কাহিনীকেও। প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী মানবজীবনে বৃক্ষের শিক্ষা নিয়ে যা লিখেছেন তাতে বৃক্ষের দান-তপস্যার কিছুটা বিবৃত হয়েছে। জগতশাস্তা (জগত-শিক্ষক) ভগবান বুদ্ধের জীবনেও বৃক্ষের অবদান কম নয়। আষাঢ় মাসের পুণ্য পূর্ণিমা তিথিতে কপিলাবাস্তু রাজ্যের শাক্য বংশীয় রাজা শুদ্ধোদনের অগ্র মহীয়সী রানি মহামায়া যে স্বপ্ন দেখেন তাঁর গর্ভে শ্বেতহস্তী কর্তৃক শ্বেতপদ্মের কোরকের স্থাপন প্রক্রিয়ায়, তারই পরবর্তী সময়ে এই সুসংবাদ জগৎ জ্ঞাত হয়ে ওঠে যে, রানির গর্ভে এক পুণ্য শিশুর জন্ম হতে চলেছে। মায়ের গর্ভে পবিত্র পদ্মের স্বপ্ন দিয়ে যাঁর অধিষ্ঠান, তাঁর জীবনে নানাবিধ বৃক্ষ জড়িয়ে আছে পৌরাণিক গুরুত্ব ধারণ করে। পুণ্যস্মৃতিসম্পন্ন এসব বাস্তব বৃক্ষের পাশাপাশি ‘কল্পতরু’ নামের এক কল্পিত বৃক্ষের কথাও বৌদ্ধ ধর্মে চর্চিত হয়, যার কাছে যা কিছু যাঞ্ছা করা হয় তা পাওয়া যায়। যদিও এই বৃক্ষটি বুদ্ধের সাথে স্মৃতি-সংশ্লিষ্ট নয়, তবু প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব উদ্যাপনকালে কল্পতরু বৃক্ষ বানিয়ে তা প্রদর্শন করা হয় এবং তার গায়ে টাকা, খাতা, সুঁই-সুতো ইত্যাদি দান করে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
নিজের জন্ম তথা আবির্ভাব হতে মৃত্যু তথা মহা পরিনির্বাণ অবধি সিদ্ধার্থ গৌতম ও ভগবান বুদ্ধের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে জাম গাছ, মহাবোধি বৃক্ষ বা অশ্বত্থ গাছ, বটগাছ বা ন্যগ্রোধ বৃক্ষ, মুচলিন্দ চাঁপা বৃক্ষ, রাজায়তন বা ক্ষীরকুল গাছ, আম গাছ ও শাল গাছ বা মহাশাল গাছ। এইসব গাছের সাথে বুদ্ধের বাস্তব ঘটনার সাথে যুক্ত হয়ে গেছে মিথ ও পৌরাণিক কিংবদন্তি। আগ্রহী ব্যক্তিমাত্রেই সেই মিথের সমুদ্রে অবগাহন করে সত্য অবহিত হতে প্রয়াসী।
শালবৃক্ষ ও বুদ্ধের জন্মের মিথ :
বোধিসত্ত্ব রূপে দশ পরমার্থ পারমী, দশ পারমী এবং দশ উপ পারমী পূর্ণ করা বুদ্ধ যখন তাঁর শেষ মানব জন্মে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার চিন্তা করছিলেন, তখন তিনি পাঁচটি মহা অবলোকন তথা পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেছিলেন। প্রথমত পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাবের সময় নির্ধারণে তিনি বেছে নিয়েছেন মানুষের একশ বছর আয়ুষ্কালের সময়কে। দ্বিতীয়ত তিনি তৎকালীন পৃথিবীর সেরা স্থান জম্বুদ্বীপ তথা আজকের এশিয়ায় জন্মগ্রহণ করার মনস্থির করেন। তৃতীয়ত তিনি মধ্যদেশে জন্মগ্রহণের সংকল্প করেন। এরই ফলস্বরূপ তিনি মগধ, কোশলের মতো বিখ্যাত রাজ্যগুলোর মাঝে জন্মগ্রহণ করেন। চতুর্থত তখনকার আমলে ক্ষত্রিয়রাই ছিল সেরা। বুদ্ধ তাই ক্ষত্রিয়কূলে জন্ম নেন। পঞ্চমত বুদ্ধ তাঁর মাতা নির্বাচনে এমন একজনকে প্রাধান্য দেন, যিনি জন্ম-জন্মান্তরে পারমী পূর্ণ করে এসেছেন। সেই মোতাবেক তিনি তাঁর জননীরূপে মহামায়াকে বেছে নেন যিনি বুদ্ধের জন্মের সাতদিনের মাথায় প্রয়াত হন। স্বর্গ হতে বোধিসত্বের পঞ্চ মহা অবলোকন শেষে আষাঢ় নক্ষত্রের উৎসবকালে তথা আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রানি মহামায়ার গর্ভে অধিষ্ঠান করেন। তখনকার দিনে কপিলাবাস্তুতে আষাঢ় উৎসব হতো সপ্তাহব্যাপী। পূর্ণিমার সাতদিন আগে থেকে উদ্যাপিত এই পবিত্র উৎসব উপলক্ষে রানির বিশেষ প্রস্তুতি থাকতো। তিনি নিজেই উৎসবের সপ্তাহকাল আগে থেকে কোনো রকম মাদকজাত দ্রব্য সেবন হতে বিরত থাকতেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিন সকালে তিনি সুবাসিত দ্রব্যে স্নান করে সালংকারা হলেন এবং মহাদানযজ্ঞ সম্পাদন করলেন। তারপর পরিমিত আহারে তৃপ্ত হয়ে পরের দিনের উপোস-ব্রতের জন্যে মানসিকভাবে তৈরি হলেন। রাত্রি সমাগমে সুসজ্জিত কক্ষে সুসজ্জিত শয্যায় তিনি শয়ন গ্রহণ করলেন। নিদ্রাকালে তিনি দেখেন, চারজন দেবদূত এসে তাঁর শয্যাকে নিয়ে গেল আশ্চর্য এক স্থানে যেখানে এক মহাশালবৃক্ষতলে তাঁকে অবতরণ করানো হলো। সেই মহাশালবৃক্ষ ছিলো সপ্তযোজন বা ছাপ্পান্ন মাইল উঁচু। দেবলোকের নারীরা এসে তাঁকে অনবতপ্ত হ্রদের জলে স্নান করালেন। ছয়দাঁতের এক শ্বেতহস্তী তার শু-ে সাদা একটি পদ্মফুলের কোরক ধারণ করে রানি মহামায়াকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে প্রণাম শেষে দক্ষিণ পার্শ্ব ভেদ করে মহামায়ার গর্ভ প্রবেশ করলেন। এতটুকু স্বপ্ন দেখার পর রানির নিদ্রা ভঙ্গ হলো এবং এরপর থেকেই তিনি প্রসন্ন মনে বিরাজ করতে শুরু করলেন। তাঁর চারপাশে সবগুলো ঘটনাই শুভ হয়ে ঘটতে লাগলো। স্বপ্নের বর্ণনা হতে দেখা যায়, মাতৃগর্ভে বোধিসত্বের অধিষ্ঠানকালীন ঘটনায়ও মহাশালবৃক্ষের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
আগের বছর আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে গর্ভধারণের স্বপ্ন দেখা রানি মহামায়া যখন পূর্ণ গর্ভ হয়ে ওঠেন, তখন তিনি রাজার কাছে আব্দার করেন পিতৃগৃহে যাওয়ার। যেহেতু গর্ভবতী মায়েদের আব্দারগুলো যথাসাধ্য পূরণের চেষ্টা করা হতো এবং প্রসবের আগে একবার পিতৃগৃহ ভ্রমণের রেওয়াজ চালু ছিল, তাই রাজা শুদ্ধোদন অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে রানিকে তাঁর পিতৃগৃহে ভ্রমণের অনুমতি দেন এবং সেই মতে আয়োজন করে দেন। যত এবড়ো থেবড়ো, উঁচু-নিচু খানা-খন্দক ওয়ালা রাস্তা-ঘাট ছিলো, রাজার নির্দেশে সব সমান করা হলো। অতঃপর রানি মহামায়া সখি-পরিবৃত হয়ে রওনা করলেন পিতৃগৃহে। রানি মহামায়ার বাপের বাড়ি ছিল দেবদহ রাজ্যে যা কপিলাবাস্তুর পার্শ্ববর্তী রাজ্য ছিল। কপিলাবাস্তু হতে দেবদহে যাওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ছিল এক প্রমোদ কানন, যার নাম লুম্বিনী উদ্যান। কথিত আছে, রানি মহামায়ার পিতামহী লুম্বিনীর নামেই এই প্রমোদ কাননের নির্মাণ হয়। লুম্বিনী কাননে পৌঁছেই রানির বিশ্রামের প্রয়োজন হলো এবং প্রসব বেদনা অনুভূত হলো। সেই কাননে ছিলো অপূর্ব শোভার মঙ্গল শালবন। কাননের পুকুরে রানি স্নানে শুদ্ধ হলেন। ক্রমশ প্রসব বেদনা বাড়তে থাকলে রানি উদ্যানের মাঝখানে স্থাপিত এক মহাশালবৃক্ষকে অবলম্বন করলেন। শাল বৃক্ষের একটা ডাল আপনা হতেই নুয়ে এসে রানিমার হাতের নাগালে এলো। রানিমা সেই ডাল ধরে ভারসাম্য রক্ষা করে প্রসব প্রক্রিয়ায় সাড়া দিলেন। সঙ্গে থাকা রমণীরা যেন হঠাৎ করেই সংখ্যায় বেড়ে গেল। তাদের তৎপরতায় নতুন মাকে কাপড়ের পর্দা টেনে আড়াল করা হলো। গর্ভস্থ বোধিসত্ব সেদিন বত্রিশ প্রকার পূর্বনিমিত্তের আশ্চর্য ঘটনা শেষে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী কাননে ধরায় আবির্ভূত হলেন। কুমার সিদ্ধার্থের পৃথিবীতে আগমনে সাক্ষী হয়ে থাকলো পুণ্যবতী শালবৃক্ষ।
হলকর্ষণ উৎসব, সিদ্ধার্থের ধ্যান ও জাম গাছ :
আগেকার দিনে কৃষিপ্রধান রাজ্যে বর্ষার আবাহনী বাজিয়ে বার্ষিক হলকর্ষণ উৎসব উদ্যাপিত হতো। হলকর্ষণ উৎসবে নগরী হতো সুসজ্জিত যেন অমরাবতীর ছায়া। সিদ্ধার্থের জীবনের প্রথম বছরেও এমনই হলকর্ষণ উৎসবের মৌতাত এলো ধেয়ে। প্রতি বছর একহাজার লাঙল বা হল নামে জমির বুকে। কিন্তু সেই বার হাজারের স্থলে তা হয়ে গেল আটশতক। উৎসবের আটশো লাঙল সেজেছে উৎসবের বর্ণিলতায়। সে উৎসবের শোভাযাত্রায় শিশু সিদ্ধার্থকে কোলে নিয়ে সবাই বের হলো রাজপ্রাসাদ থেকে। ঠিক যে স্থানে হলকর্ষণ উৎসবের উৎসব মণ্ডপ, সে স্থানের নিকটেই বিরাট এক জামগাছ। জামগাছের শীতল ছায়াতেই পাতা হলো শিশু সিদ্ধার্থের শয্যা। চারপাশ কাপড়ে ঘেরা, মাথার ওপরে স্বর্ণখচিত চন্দ্রাতপ। পরিচারিকাদের পরিচর্যায় সিদ্ধার্থকে রেখে রাজা গেলেন হলকর্ষণ উৎসবের শুভ উদ্বোধনে। উৎসবের আনন্দ-কল্লোলে শামিল হতে পরিচারিকারাও আর স্থির থাকতে পারল না। শিশু সিদ্ধার্থকে একা রেখে তারা সবাই মেতে উঠল উৎসবে। কিন্তু ক্ষুদ্র শয্যায় একাকী সিদ্ধার্থ উঠে বসলেন পদ্মাসনে। প্রাণায়ামে বসে শুরু হলো ধ্যান সাধনা। উৎসব শেষ হতে সময় লেগে গেলো বেশ। মধ্যাহ্নের সূর্য তেতে উঠেছে আকাশে। কোন বৃক্ষের ছায়া নেই, কিন্তু সিদ্ধার্থকে ছায়াদানকারী জাম গাছের ছায়া কেবল শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল শিশু সিদ্ধার্থের গায়ে। পরিচারিকারা ডামাডোল হতে ফিরে এসে দেখে, একটি গোলাকার ছায়া সেই জামগাছতলে সিদ্ধার্থের মাথার ওপরে ছাতা ধরে আছে যেন। রাজা শুদ্ধোদন পরিচারিকাদের অবাক হওয়া ডাকাডাকিতে ফিরে এসে দেখেন, ধ্যানমগ্ন শিশু সিদ্ধার্থ পদ্মাসনে উপবিষ্ট। সেই জামগাছ তলে রাজা আপন পুত্রকে তাঁর দ্বিতীয় প্রণাম জানালেন।
পরের বছরের হলকর্ষণ উৎসব আবারো যথারীতি জাঁকজমক নিয়ে হাজির হলো নগরজুড়ে। সোনায় মোড়া লাঙল আর রূপোয় জড়ানো বলদ। পিতা শুদ্ধোদনের সাথে কুমার সিদ্ধার্থও গেলেন সেই উৎসবে। রাজ পোশাক আর স্বর্ণালঙ্কারে মণ্ডিত সিদ্ধার্থ উৎসবের কলকাকলি এড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন নিচের দিকে যেখানে লাঙল-কর্ষণের কারণে মাটির কীটগুলো উঠে আসছিলো ওপরে। কিছু কিছু কীট কাটা যাচ্ছিল লাঙলের ধারে, আর কিছু কিছু কীট শকুনের, পাখির শিকার হয়ে আকাশে পাচার হচ্ছিল। বেদনাবিধুর মনে সিদ্ধার্থ সেই স্থান ত্যাগ করে চলে এলেন নির্জন পাহাড়ের দিকে। কলকোলাহল ক্ষীণ হয়ে এলেও পার্বত্য ঝরণার ঝিরি ঝিরি কানে এলো। ঝরণার কাছে যে বড় পাথরটিতে জল এসে ছুঁয়ে যায়, তারই নিকটে এক বিশাল জামগাছ ছিল। নিরবতায় মগ্ন সিদ্ধার্থ সেই জামগাছের তলায় উপবেশন করলেন। ঝরণার বাতাসে ভেসে আসা জলকণায় তিনি সামান্য সিক্ত হয়ে উঠলেন। ধীরে ধীরে গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে কুমার সিদ্ধার্থ চলে গেলেন তাঁর নিজের জগতে। প্রাচীন পঞ্চ ঋষি, বল্কল পরিহিত, তাঁর দর্শনে তৃপ্ত হয়ে চলে গেলেন নিজ পথে। হল কর্ষণোৎসব শেষে রাজা শুদ্ধোদনসহ দলবল খুঁজতে খুঁজতে এক ব্যাধের মুখে সংবাদ পেলেন, বালক সিদ্ধার্থ পর্বতের পাদদেশে গভীর অরণ্যে বিশাল এক জামগাছের তলায় ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন। এভাবেই দেখা যায়, বুদ্ধের শৈশবে জামগাছের ছায়া তাঁর ধ্যানে যুগিয়েছিল প্রজ্ঞামণ্ডিত প্রেরণা।
বটের ছায়ায় ধ্যান ও সুজাতার পায়েসান্ন গ্রহণ :
সত্যের সন্ধানী মহাআবিষ্কারক শ্রামণ গৌতম ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন উরুবিল্ব গ্রামের নৈরঞ্জনা নদীর তীরে। উরুবিল্ব মানে বালুময়। নদীর ওপারে আছে সেনানী গ্রাম। আহারের প্রয়োজনে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি নৈরঞ্জনা নদী পার হয়ে সেনানী গ্রামে এসে পৌঁছালেন। সেনানী গ্রামে ঢোকার মুখে বটগাছ দেখে বুদ্ধ ধ্যানের স্মৃতি জাগ্রত হয়। তিনি বটের ছায়ায় ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। সেনানী গ্রামে এক ধনীর দুলালী সুজাতা মানত করেছিলেন, যদি তার সমমান সম্পন্ন ঘরে বিয়ে হয় এবং প্রথম গর্ভেই যদি পুত্রসন্তান হয় তবে তিনি বৃক্ষদেবতা বা বনদেবতাকে পায়েসান্ন সহযোগে পূজো দিবেন। সেই মানত রক্ষার্থে তিনি বনে প্রবেশ করে দেখেন, বটের ছায়ায় ধ্যানসমাধিস্থ সিদ্ধার্থ গৌতমকে। তাঁর অপরূপ পুতঃ জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে অরণ্যভূমি। সুজাতা স্বর্ণ নির্মিত বড় পাত্রে আনীত পায়েসান্ন ভক্তি ভরে অর্পণ করলেন। সেনানী গ্রামের সেই বটের ছায়াই বুদ্ধকে সুজাতার (নন্দিকের স্ত্রী) পায়েসান্ন গ্রহণের নিমিত্ত তৈরি করে দেয়।
মহাবোধি বৃক্ষ ও সিদ্ধার্থের আলোকন :
সত্যের সন্ধানে, দুঃখমুক্তির উপায় উদ্ভাবনে জগৎশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধ তাঁর গৃহী জীবনের ইতি টানতে আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে ঊনত্রিশ বছর বয়সে মহাভিনিষ্ক্রমণে বের হয়ে আসেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর্যন্ত উপযুক্ত গুরুর সন্ধান করে কারও কাছে দুঃখমুক্তির পথের সন্ধান না পেয়ে শেষমেষ নিজেই মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সাধনার শেষে প্রান্তে উপনীত হন। সত্যের সন্ধানে যেতে যেতে তিনি এসে উপনীত হন উরুবিল্ব গ্রামের নৈরঞ্জনা নদীর তীরে। বনদেবতার কাছে মানতকারী সেনানী গ্রামের ধনীর দুলালী সুজাতার প্রতিজ্ঞা রক্ষার পায়েসান্ন গ্রহণ করে অস্থি-চর্মসার শ্রামণ গৌতম বুঝতে পারলেন, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতনের তপস্যায় সাধনা সিদ্ধ হবে না। তিনি সুজাতার অর্পণকৃত আলোকপায়েসান্ন ঊনপঞ্চাশ গ্রাসে গ্রহণ করে নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান সমাপন করে বসলেন বুদ্ধত্ব লাভের অন্তিম আসনে। তাঁর এই সাধনার সিদ্ধির জন্যে তিনি এবার বেছে নেন এক অশ্বত্থ বৃক্ষ যা পরবর্তী সময়ে বোধিবৃক্ষ নামে অভিহিত ও পূজিত হয়। তৃণ-সংগ্রাহক সোত্থিয়র দেয়া সাত মুষ্টি তৃণ নিয়ে শ্রামণ গৌতম সাজালেন তাঁর আলোকনপ্রাপ্তির আসন। ভেবেচিন্তে বোধিবৃক্ষকে (অশ্বত্থবৃক্ষ) পেছনে রেখে পূর্বদিকে মুখ করে বসলেন তিনি ধ্যানের আসনে। রাত্রি চতুর্থ যাম শেষে বোধিবৃক্ষের পুণ্যছায়ায় শ্রামণ গৌতম আলোকনপ্রাপ্ত হলেন। হয়ে উঠলেন জগত আলো করা মহাকারুণিক বুদ্ধ। বুদ্ধের জীবনে আলোকনপ্রাপ্তিতে এই বৃক্ষ ছায়া দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় বুদ্ধত্ব লাভ করেই তিনি মহাবোধিকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। এই বোধিবৃক্ষের পাদদেশে জল সিঞ্চন করে বৌদ্ধরা পুণ্য অর্জন করে। সকল অশ্বত্থ গাছকেই বোধিবৃক্ষ বলা হয় না। কেবল বুদ্ধগয়ার সেই মহাবোধির বংশধরেরাই বোধিবৃক্ষ বলে পূজিত হয়। বুদ্ধ বোধিবৃক্ষতলে বসে বোধিজ্ঞান লাভের পর প্রথম সপ্তাহের টানা সাতদিন অনিমেষ নেত্রে চেয়েছিলেন বোধিবৃক্ষের দিকে। বোধিবৃক্ষ তাঁকে ছায়া দেয়ায় তিনি তার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে পরবর্তী সময়ে উক্তস্থানে 'অনিমেষ চৈত্য' নামে স্থাপনা তৈরি করা হয়।
বুদ্ধ ও অজপাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষ :
রামপুত্র রুদ্রক ও অরাঢ় কালামের কাছ থেকে এসে সত্য সন্ধানে সিদ্ধার্থ গৌতম শুরু করলেন কঠোর তপস্যা। তিনি বটগাছের তলে মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন-পণ করে সাধনা শুরু করেন। যে বটের ছায়ায় তিনি সাধনা করেন, সেই বটের ছায়ায় মেষ ও ছাগল পালক রাখাল বালকেরা এসে বিশ্রাম নিতো। তিনি অস্থিচর্মসার হয়ে শক্তিহীন অবস্থায় মূর্ছিত হলে এই রাখাল বালকেরা এসে তাঁকে সেবা-শুশ্রূষা করে জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। এই বটের ছায়াতেই ধ্যানমগ্নকালীন সিদ্ধার্থ গৌতমকে দেখে সুজাতা বনদেবতা জ্ঞান করে মানতের পায়েসান্ন অর্পণ করেন। সুজাতার পায়েসান্ন ঊনপঞ্চাশ গ্রাসে গ্রহণ করার পর বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের চূড়ান্ত ধ্যানে বসেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর চার সপ্তাহ বনের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে তিনি ধ্যানমগ্ন হন। এরপর পঞ্চম সপ্তাহে বনের বাইরে আসেন। এ সময় তিনি সেই বট গাছের নিচে আসন গ্রহণ করে পুনরায় সাতদিন টানা ধ্যান সম্পন্ন করেন। এই বটগাছকে ন্যগ্রোধ বৃক্ষ বলে। এই গাছের নিচে মেষপালকেরা ছাগল ও মেষ চারণকালে বিশ্রাম নিত বলে এর নাম হয়ে গেছে অজপাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষ।
মুচলিন্দ চাঁপা বৃক্ষমূল ও তথাগত :
অজপাল বৃক্ষমূলে আলোকনোত্তর পঞ্চম সপ্তাহ ধ্যানে কাটিয়ে তথাগত এলেন মুচলিন্দ বা মুচকুন্দ চাঁপা বৃক্ষমূলে। স্থানান্তরের পরেই শুরু হল কালবৈশাখীর ভয়ানক ঝড় ও বৃষ্টি। সেই দুর্যোগ স্থায়ী হয়েছিল সপ্তাহকাল। এমন ঝড়েও তথাগত নির্বিকার চিত্তে মুচলিন্দ চাঁপা বৃক্ষের মূলে বসে রইলেন। প্রস্ফুটিত চাঁপা ফুলের অপূর্ব সৌরভে গাছটিতে আশ্রয় নিয়েছিল নাগকূল। আলোকনপ্রাপ্ত বুদ্ধের পবিত্র দেহকে ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নাগলোক থেকে স্বয়ং নাগরাজ এসে সেই মুচলিন্দ গাছের বেদীমূলে আস্তানা গাড়েন। নাগরাজ সাতটি পাকে তথাগতের শরীর বেষ্টন করে তাঁকে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে ব্রতী হলেন। পরম করুণানিধি তথাগতও প্রশান্ত মনে নাগরাজের তদারকিতে নির্বিঘেœ ধ্যান সমাপন করলেন। সাতদিন পরে দুর্যোগ কেটে আবার রোদ উঠল। নাগরাজ তখন বুদ্ধের শরীর ছেড়ে তাঁর চরণে প্রণাম জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
বুদ্ধ ও ক্ষীরকুল বৃক্ষ :
মুচলিন্দ চাঁপা বৃক্ষের নিচে নাগরাজের প্রহরায় ষষ্ঠ সপ্তাহ ধ্যান সমাপন করে বুদ্ধ এরপর এলেন একটি রাজায়তন বা ক্ষীরকুল গাছের নিচে। সেখানে তিনি আলোকনোত্তর সপ্তম সপ্তাহ ধ্যান সম্পন্ন করেন। এই সময় কদাকার দর্শন 'মার' আবার তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। পরাজিত হয়ে মার হীনবল হয়েছে, তবুও সে তখনও একেবারে হাল ছেড়ে দেয়নি। 'মার' ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁকে মহাপরিনির্বাণে যাওয়ার ফাঁদে ফেলতে চাইলে তথাগত চোখ মেলে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাপী মার তার চোখ নামিয়ে নিল। সে জোড় হাত করে তথাগতের মৃত্যু কামনা করছে। বুদ্ধ তখন উত্তর দিয়েছিলেন, 'হে পাপী মার! তথাগত এখন নির্বাণ লাভ করবেন না। তাঁর শিষ্য ভিক্ষুরা যতদিন না শান্ত-দান্ত, বিনীত বিশারদ ও বহুশ্রুত না হবেন, যতদিন না বুদ্ধের ধর্ম ও সংঘের প্রতিষ্ঠা হবে ও তা প্রসার লাভ করবে ততদিন তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন না।'
বুদ্ধ অনেকদিন পর উপলব্ধি করলেন, এবার শরীর রক্ষার জন্য তাঁর খাদ্যগ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যের কথা ভাবতেই সেই রাজায়তন বৃক্ষ বা ক্ষীরকুল গাছটি উৎকৃষ্ট পাকা ফলে ভরে উঠল। পীতাভ সুমিষ্ট ফলের গন্ধে তথাগত অনেকদিন পরে রোমাঞ্চিত হলেন। তাঁর মনে মুখ ধোওয়ার ইচ্ছে জাগল এবং ইচ্ছে তখনই কাজে পরিণত হল। প্রচলিত আছে, এ সময় দেবরাজ ইন্দ্র তথাগতের জন্যে হরীতকী ও দাঁত মাজতে নাগলতার দন্তকাষ্ঠ নিয়ে আসেন। মুখ ধোওয়ার জন্য স্বর্গের অনবতপ্ত সরোবর থেকে একপাত্র জলও আসে। বুদ্ধ দাঁত মেজে ও মুখ ধুয়ে আবার সেই বৃক্ষমূলে এসে বসেছিলেন।
আমগাছ ও বুদ্ধের বিশ্রামের স্থান :
বৌদ্ধ মিথে আমগাছ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বৈশালীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী জনপদকল্যাণীকে শিশুকালে আমগাছের গোড়ায় কে বা কারা রেখে গিয়েছিল। বাগানের মালী সেই শিশুকে পেয়ে নিজেই লালন-পালন করে বড় করে তুলেছেন। আম গাছের পাদদেশে পাওয়া গিয়েছিল বলেই সেই কন্যাশিশুর নাম রাখা হয়েছিল অম্বাপালি যা আম্রপালি নামেও পরিচিত। পরিণতকালে এই আম্রপালিই বুদ্ধের দর্শন লাভ করে তার শরণ নেন এবং বুদ্ধ ভিক্ষুণী সঙ্ঘে তাঁকে স্থান দেন।
চুন্দ স্বর্ণকারের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে জীবনের সর্বশেষ আহার গ্রহণ করেন বুদ্ধ। শেষে পাবা নগর হয়ে অপরাহ্নে ককুত্থা নদী পার হয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুস্থতা তাঁর অন্তিম অসুস্থতায় পরিণত হয়। এ সময় বিশ্রাম করার জন্যে তিনি নদী তীরবর্তী আমবাগানে আম গাছের শীতল ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণ করেন। আমবাগানে বিশ্রামকালীন তিনি ককুত্থা নদীর পানি পান করে পিপাসা মেটান। এটাই বুদ্ধের অন্তিম জলপান। আম্রবনে বিশ্রামের সময় নদী হতে পানি আনতে গিয়ে আনন্দের বিলম্ব হয়। তিনি যতই পাত্রে পরিষ্কার পানি নেন, ততই তা ঘোলা পানিতে পরিণত হয়। বুদ্ধকে এ কথা প্রকাশ করতেই বুদ্ধ বললেন, কোন এক জনমে তিনি বাছুর হয়ে তাঁর গোমাতার জলপানে বিঘœ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর দুষ্টুমির কারণেই গোমাতা পরিষ্কার জলের পরিবর্তে ঘোলাজল পান করেন। এটাই সেই শেষ কর্মফল যা বুদ্ধের ভোগার বাকি ছিল।
যমজ শালবৃক্ষ ও মহাপরিনির্বাণ :
পঁয়ত্রিশ বছরে বুদ্ধত্ব লাভ করার পরে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বুদ্ধ তাঁর আবিষ্কৃত ধর্ম প্রচার করেন। এরপরে তিনি আশি বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর তীরে এসে অন্তিম শয্যায় শুয়ে পড়েন। হিরণ্যবতী নদীর তীরে ছিল মল্লদের শালবন। এই শালবনে যমজ দুটি শালবৃক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে তিনি মহাশয্যায় শায়িত হন। উত্তর দিকে মাথা এবং দক্ষিণে পদযুগল। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলো। চারদিক আলোর বানে ভেসে যাচ্ছিলো। এমন সময়েই মল্লরাজ্যের শালবনে বুদ্ধ তাঁর দেহত্যাগ করেন।
বুদ্ধ জগতের শাস্তা। তিনি জগতকে দুঃখ হতে পরিত্রাণের উপায় শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর জন্ম হতে আলোকন প্রাপ্তি এবং ধর্মপ্রচার হতে মহা পরিনির্বাণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁকে সাহচর্য দিয়েছে আম, জাম ও মহাশাল বৃক্ষ। এই বৃক্ষগুলো তাই বৌদ্ধ পুরাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে তাঁর অনুসারী ও ভক্তবৃন্দের প্রতিদিনের চর্চায়।
তথ্যঋণ :
১. সংক্ষিপ্ত ত্রিপিটক, সুদর্শন বড়ুয়া, ২৭ জুলাই ১৯৯৯, প্রকাশিকা- শ্রীমতী প্রভাবতী বড়ুয়া, ময়নামতী আর্ট প্রেস হতে মুদ্রিত
২. নির্বাণে অনির্বাণ বুদ্ধ ভগবান, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, জানুয়ারি ২০১৬, সুধাংশু শেখর দে, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা
৩. মহামানব বুদ্ধ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন
৪. বুদ্ধ, ক্যারেন আর্মস্ট্রং, অনুবাদ : শওকত, একুশে বইমেলা ২০১০, রোদেলা প্রকাশনী
৫. ‘তথাগত’ উপন্যাস, নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী, ‘জয়ঢাক’-ছোটদের ওয়েবজিন, ২০২০