প্রকাশ : ০১ মে ২০২২, ০০:০০
ব্রিটিশ শাসনাধীন পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোর মধ্যে শ্যামলিমার সমারোহে নয়নাভিরাম ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, বর্তমানের বাংলাদেশ। সে সময় চলাচলের মাধ্যম ছিল গরুর গাড়ি, চালক ছিল গাড়িয়াল। গাড়িয়ালের কণ্ঠে মিষ্টি-মধুর ভাওয়াইয়া জাতীয় বিরহের গান, আর নদী-খাল-বিলের নাইওরী নৌকার মাঝির পল্লীগীতি শ্রোতাদের মনকে উদাসী করে দিতো। বাংলার মানুষ ছিল উৎসবপ্রবণ এবং অতিথিপরায়ণ। বারো মাসে তের পার্বণ ছিল বাঙালির ঐতিহ্য। বাংলার হাট-বাজার-আড়ংগুলোতে অধিকাংশই ছিল বন-ছন এবং তাল পাতার নির্মিত চালার ঘর। যেগুলোর পরিসর ছিলো অল্প এবং নির্দিষ্ট দিনে হাট মিলতো। মুক্ত খাল-বিলে মানুষ মাছ শিকার করতো নৌকায় করে। তখন খেলার মাঠের প্রচলন খুবই কম ছিল। ছেলেরা নাড়া খেতে গোল্লাছুট, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্দা, ফুটবল, হা-ডু-ডু এবং মাঠেই অস্থায়ী খুঁটিতে নেট টানিয়ে ভলিবল খেলতো। খেলা শেষে ছেলেরা যেমন বাড়ি ফিরে যথারীতি পড়ার টেবিলে বসতো, তেমনি শ্রান্ত পাখিরাও স্বীয় নীড়ের পানে ছুটে যেতো। প্রাচীন বাংলার হাট এবং আড়ংগুলো যুগের বিবর্তনে বাজারে রূপান্তরিত, আগের বাজারগুলো থানা সদরে রূপান্তরিত হয়েছে। আর বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এলাকা পেয়েছে বৈদ্যুতিক ঐশ্বর্য এবং কুপি বা হারিকেন হয়েছে জাদুঘরের ঐতিহ্য।
প্রাচীনকালে বাংলার পায়েচলার বন্ধুর পথগুলো হয়েছে পিচঢালা সোজা-সমতল রাস্তা। আর এখানেই এসে জায়গা করে নিয়েছে ছোট-মাঝারি-বড় ধরনের যন্ত্র দানব। চালকদের অদক্ষতার কারণে এসব রাস্তায় ঝরে পড়ছে প্রতিদিন অগণিত মানুষের প্রাণ।
প্রাচীন বাংলার সবুজ প্রকৃতি নির্বিচারে ধ্বংস করে যে আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতার সূচনা হয়েছে তা প্রাচীন বাংলার মৌলিক সভ্যতার প্রতি কটাক্ষ মাত্র। আদিকালে মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাকঘর, টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন। আজকের ডিজিটাল যুগে ‘অল ইন ওয়ান’ হলো মোবাইল। এর ব্যবহারের ভাল-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে।
বিখ্যাত লেখক বিনয় ভূষণ মুখোপাধ্যায় (যাযাবর) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দৃষ্টিপাতে লিখেছেন, “বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।” একটি মাত্র উদাহরণ এ কথার প্রমাণ বহন করে। প্রাচীন বাংলায় আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা হতো যাতায়াতের মাধ্যমে। কিন্তু এ যুগে অনুষ্ঠানাদির নিমন্ত্রণও করা হয় মোবাইলে। প্রাচীন কালের ছাপাখানার কাজ বর্তমানে অধিকতর নিখুঁতভাবে বিজ্ঞানের অত্যাশ্চার্য অবদান 'কম্পিউটার'-এর সাহায্যে সম্পাদন করে এর বিশাল স্মৃতিকোষে রেখে দেওয়া যায়। আদি যুগে অফিস-আদালতের বিভিন্ন অতি প্রয়োজনীয় রেকর্ড সমূহ একটি বিশেষ কক্ষে সংরক্ষিত থাকতো। যাহা যে কোনো অফিসের 'রেকর্ড রুম' নামে অভিহিত ছিল। বর্তমানে এসব রেকর্ড কম্পিউটারের স্মৃতি কোষে সংরক্ষিত থাকে। প্রাচীন বাংলার অফিস-আদালতের বিশাল কর্মযজ্ঞে যে পরিমাণ জনবল নিযুক্ত থাকতো, কম্পিউটারের যুগে আর সে পরিমাণের নিশ্চয়ই হ্রাস ঘটবে। আদি কালের সংরক্ষণ পদ্ধতির বিশেষ অরি ছিল উই পোকা, আর ডিজিটাল যুগের সংরক্ষিত রেকর্ডের অরি হলো কম্পিউটার ভাইরাস নামক এক প্রকার অদৃশ্য অণুজীব। এই বিশ্ব-প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বে যেখানেই বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে, সেখানেই তার অনুপ্রবেশ অনিবার্য বটে।
প্রকৃতি নিয়তই প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে থাকে।
একটা প্রচলিত বাক্য আছে, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। প্রাচীন বাংলায় ঢেঁকি ছাঁটা চাল আর চিড়ে মানুষকে অনকেটা নিরোগ রাখতো। পাটায় পেষা মসলার তরকারিও অনেকটা রুচিসম্মত হতো। মুক্ত মাঠে-ঘাটে রাস্তার পাশে শিকার করা মাছ ছিল খুব সুস্বাদু। আধুনিক যুগে ঢেঁকি চলে গিয়েছে জাদুঘরে। পাটা-পুতা মানব চক্ষুর অন্তরালে। এমন কোনো মুক্ত খাল-বিল বা রাস্তার পাশ নেই যেখানে মাছ শিকার করা যায়। প্রাচীন বাংলার এই ঐতিহ্য আর কোনো দিন ফিরে আসবে কিনা তা সময়ই বলে দিবে। কারণ চিরায়ত ঐতিহ্যের আধুনিকায়ন প্রকৃতিগতভাবে বেমানান।
বিজ্ঞান আমাদেরকে পৌঁছায়ে দিয়েছে সার্বিক উন্নয়নের শিখরে। এ সময় যদি আমরা ভুলে যাই আমাদের শিকড়ের বিস্তৃতির ঐতিহ্য, তা উন্নয়নের ক্রমবর্ধিষ্ণু ধারাকে বিবর্ণ করে দিবে।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।