প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২২, ০০:০০
গত ১১ মার্চ কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানার ডেউয়াতলী এলাকায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ইয়াসমিন আক্তার (২২) নামে একজন গৃহবধূ মারা যায়। যার প্রেক্ষিতে ভিকটিমের ভাই মোঃ রাকিব হোসেন পরদিন অর্থাৎ ১২ মার্চ বাদী হয়ে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন (যার নং-০২, তারিখ ১২/০৩/২০২২খ্রিঃ)। ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে কুমিল্লাসহ সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বেশ কিছু গণমাধ্যম দুর্ঘটনার বিষয় নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করলে এবং একই সাথে ঘটনাটি অত্যন্ত নির্মম ও হৃদয়বিদারক হওয়ায় র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লার গোয়েন্দা দল উক্ত ঘটনার সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনের জন্যে কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিকভাবে ভিকটিমের স্বামী রেজাউল করিমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তীতে রেজাউলের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের দেয়া তথ্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলে র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা-এর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
পরবতীতে ভিকটিমের মা, ভাই এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ করলে জানা যায়, ২০১৭ সালের শুরুতে রেজাউল করিম ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারের বাড়ির (চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ থানার ডিংগাভাঙ্গা) পাশে ‘পেইজ’ নামক একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি করতেন। উক্ত বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার সুবাদে রেজাউল করিমের সাথে ভিকটিমের মা বেবী আক্তারের পরিচয় হয়। সেই সুবাদে আসামী রেজাউল করিম ঋণের কিস্তির টাকা নিতে ভিকটিমের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো। আসা যাওয়ার এক পর্যায়ে ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারের সাথে রেজাউল করিমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। উক্ত প্রেমের সম্পর্কটি এলাকায় জানাজানি হলে ভিকটিমের পূর্বের স্বামী আনোয়ার হোসেনের সাথে ভিকটিমের তালাক হয়ে যায়। তাই খুব অল্প পরিসরে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রকার কাবিন ও ইসলামিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই রেজাউল করিম ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে রেজাউল করিম ভিকটিমকে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নেয়ার কথা বলে ভিকটিমের মাকে আশ্বস্ত করে তড়িঘড়ি করে মালদ্বীপ চলে যায়।
রেজাউল মালদ্বীপ গিয়ে ভিকটিমের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও ভিকটিমের চাপে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে না এবং ভিকটিম বিভিন্নভাবে রেজাউলকে দেশে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে গত ৭ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে রেজাউল মালদ্বীপ থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং অনেকটা বাধ্য হয়ে পরিবারের অমতে গত ১০ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার (পিতা মৃত আক্তার হোসেন, মাতা বেবী আক্তার, সাং : ডিংগাভাঙ্গা, থানা : মতলব দক্ষিণ, জেলা : চাঁদপুর)-এর সাথে রেজাউল করিম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর রেজাউল করিম ভিকটিমকে তার বাড়ি বরুড়া থানাধীন ডেউয়াতলী গ্রামে নিয়ে আসে। যেহেতু রেজাউল পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে সেহেতু রেজাউলের পরিবার ভিকটিমকে মন থেকে মেনে নেয়নি, অপরদিকে রেজাউলও ভিকটিমের সাথে দীর্ঘস্থায়ী পারিবারিক জীবনে অনাগ্রহী ছিলো। তাই ভিকটিমের পরিবার অর্থনৈতিভাবে অসচ্ছল জেনেও রেজাউল ভিকটিমকে যৌতুকের জন্যে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং এতে পারিবারিক কলহ দেখা দেয়। একদিকে রেজাউলের পরিবার অপর দিকে যৌতুকের চাপের কারণে তাদের পারিবারিক কলহ চরমে উঠে। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সামাজের ব্যক্তিবর্গ সালিসে বসে বিষয়টি সমাধান করেন এবং তাদেরকে একত্রে থাকতে বলেন।
সালিসে রেজাউল বিষয়টি মেনে নিয়ে একত্রে থাকতে শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। ভিকটিমের পরিবার ও স্থানীয়ভাবে এসব তথ্য প্রাপ্তির পর র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা-এর গোয়েন্দা দল আরও গভীরভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে এবং ভিকটিমের স্বামীর সন্ধানে একাধিক টিম নিয়োগ করে। পরবর্তীতে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা নজরদারির সূত্র ধরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-১১, সিপিসি-২-এর একটি আভিযানিক দল ২৮ মার্চ ২০২২ তারিখ ৯টার সময় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী থানাধীন ইপিজেড এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় রেজাউল করিম (৩০) (পিতা : আলতাফ হোসেন, সাং : ডেউয়াতলী মোল্লাবাড়ী, থানা : বরুড়া, জেলা : কুমিল্লা)কে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তাকে এই ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়।
গ্রেফতারকৃত রেজাউল করিম জিজ্ঞাসাবাদে জানান, গত ১০ মার্চ ২০২২ তারিখ বিকেলে রেজাউলের সাথে ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারের বিভিন্ন বিষয়ে কথা কাটাকাটি হলে রেজাউল ভিকটিমকে চড়থাপ্পড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান। রেজাউল ভিকটিমকে চড়থাপ্পড় মারলে রেজাউলের নখের আঁচড়ে ভিকটিমের গালের নিচে আঁচড় পড়ে। পরবর্তীতে আনুমানিক ৭টার সময় পুনরায় তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হলে রেজাউলের বাবা-মা তাদেরকে চুপ থাকতে বলেন। আনুমানিক ১০টার সময় রেজাউলের বাবা-মা ঘুমিয়ে গেলে পুনরায় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রেজাউল ক্ষিপ্ত হয়ে ভিকটিম ইয়াসমিন বেগমের গলায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলে ভিকটিম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রেজাউল তার স্ত্রী ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারের চোখে-মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করে এবং ভিকটিমের শ^াস ঠিক আছে বলে অনুধাবন করে। তার কিছুক্ষণ পরে রেজাউল ভিকটিমের গায়ে হাত দিয়ে দেখে ভিকটিমের শরীর ঠা-া হয়ে আছে। পরবর্তীতে সে বুঝতে পারে তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই। এমতাবস্থায় সে সারারাত চিন্তা করতে থাকে তার স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি পরিবার ও লোকমুখে জানাজানি হলে সে কী জবাব দিবে। চিন্তা-ভাবনার একপর্যায়ে ১১ মার্চ ২০২২ তারিখ আনুমানিক ভোর ৫টায় সে তার স্ত্রী ভিকটিম মৃত ইয়াসমিন আক্তারের সারা শরীরে তার ঘরে থাকা কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের ন্যায় ফজরের নামাজ পড়তে চলে যান এবং নামাজ শেষে স্থানীয় লোকজনের আগুন লাগার বিষয়ে কোনো আওয়াজ না পাওয়ায় সে পারিবারিক কবরস্থান জিয়ারতের উদ্দেশ্যে চলে যান। ইতিমধ্যে রেজাউল কবরস্থানে থাকা অবস্থায় স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে আগুন লাগার বিষয়ে জানতে পারে এবং অতিদ্রুত তার বাড়িতে যান। স্থানীয়দের আগুন নিভানোর সময় রেজাউল ও তাদের সাথে আগুন নিভানোর ভান করতে থাকে এবং বলতে থাকে, ঘরের ভিতর তার স্ত্রী ও তার বিদেশ যাওয়ার সকল কাগজপত্রসহ টাকা-পয়সা রয়েছে। এক পর্যায়ে রেজাউল জ্ঞান হারানোর ভান ধরে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন এবং তার স্ত্রীর জানাজা শেষে হাসপাতাল হতে সে আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি দ্রুত দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেন।
উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণের জন্যে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানায় হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন।