রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২২, ০০:০০

হে প্রবীণ, নবীনদের জন্যে কী রেখে গেলেন?
হাসান আলী

যারা এরই মধ্যে প্রবীণ হয়ে গেছেন কিংবা অদূর ভবিষ্যতে প্রবীণ হবেন তাদের কাছে নবীনদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আজকের প্রবীণরা তাদের যৌবনে ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুসংস্কার, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। দুর্ভিক্ষ-মহামারী ছিলো গত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। জাতিতে-জাতিতে, দেশে-দেশে দাঙ্গা, যুদ্ধ, মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। শুধু বিশ^াসকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে চরম হানাহানি, মারামারি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। দেশ দখল, মানুষ শাসন, সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়ী লড়াই ছিলো চরম ভীতিকর ঘটনা। ভয়ঙ্কর প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আমাদের প্রবীণরা তাদের শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনকে আজকের বর্তমানের জন্য উৎসর্গ করেছেন। আজকের নবীনরা এ জন্যে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে প্রবীণদের কাছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন এমনিতে চলে আসে নবীনদের মনে।

আজ যারা প্রবীণ হয়েছেন তারা কি সবাই সমাজটাকে বদলে দিতে নিবেদিত ছিলেন? সবাই নিবেদিত ছিলেন না। সেখানেও একদল দুর্বল মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করে জীবন বাজি রেখে কাজ করে গেছেন। বিনিময়ে বেঁচে থাকার জন্য মজুরি পেয়েছেন। আরেকজন মানুষ অর্থবিত্তের জোরে, বুদ্ধি খাটিয়ে কৌশলে এবং গায়ের জোরে সম্পদের মালিক হয়ে শাসন, নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ অব্যাহত রেখেছিলেন। অনেকেই শৈশব-কৈশোর- যৌবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং দেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একদল তরুণ-তরুণী সক্রিয় ছিলেন। লেখক, কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, উকিল, ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সারা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়!

হে প্রবীণ, দেশের অনেক উন্নয়নে আপনার ভূমিকাকে সবাই শ্রদ্ধা করে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে উন্নয়নের সুফল সব জায়গায় পৌঁছেনি। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ উন্নয়নের সুফল পেয়েছে। অভিযোগ উঠেছে বালিশ, পর্দা, বইয়ের দাম প্রায় শতগুণ বাড়িয়ে ক্রয় করা হয়েছে। দেশের উন্নয়ন করার জন্যে আগামী প্রজন্মের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা শহরের আশপাশের নদীগুলোর পানি দূষিত হয়েছে, নোংরা আর্বজনা দিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। খাল-বিল-নদী-নালা ভরাট হয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট, উঁচু দালান-কোঠা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। একটু বৃষ্টিতে শহর-উপশহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। যানজট মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট করে দিচ্ছে। অফিস-আদালতে গেলে মানুষ নানা রকমের ভোগান্তির শিকার হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো কাজ হবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত।

কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কৃষক উৎপাদিত পণ্যের উচিত মূল্য পায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ দৃশ্যমান। সনদ বিক্রি করা একশ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ। শিক্ষকদের একটি অংশ আজ নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। নারী-শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো এক শ্রেণির মানুষের নিয়মিত কাজে রূপান্তরিত হয়েছে। বিচারপ্রার্থী মানুষ বিচারের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে। সড়কে মৃত্যুর হার বাড়ছে। সড়ক ব্যবহারে জনগণের সচেতনতা নি¤œমানের। মূল্যবোধের অধঃপতন সর্বত্র বিরাজমান। চিকিৎসা ক্ষেত্রে চলমান বাণিজ্য আরও দৃঢ় হচ্ছে। বিত্তবান মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাচ্ছেন। বিত্তহীন বিশাল জনগোষ্ঠী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখছেন। রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোর দাপট দেখার মতো। ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পরাজিত হচ্ছেন। ব্যবসায় একচেটিয়া রূপ ধারণ করেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, শেয়ারবাজারের দরপতন, দখল, ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে এক শ্রেণির লোক প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। বিদেশে অর্থ পাচার আর কালো টাকার দাপট অর্থনীতির জন্য কোনো ধরনের সুসংবাদ হতে পারে না।

মাদক চোরাচালান, মাদক ব্যবহার, আশঙ্কাজনভাবে বেড়ে গেছে। মাদকাসক্ত মানুষ ধনী মানুষের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কারণ মাদকাসক্তরা অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো লড়াই করতে পারে না। ধনী মানুষের জন্যে বিবেকবান, সচেতন, ন্যায়পরায়ণ, সাহসী মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ। ধনী মানুষের পদলেহনকারী একদল মানুষ শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নের নামে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে ভূমিকা রাখে। সব উন্নয়নের আড়ালে একদল মানুষের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। রাজা-জমিদাররা নতুন নামে নতুন কায়দায় জনসাধারণের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বেতন-ভাতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, কোট-প্যান্ট-টাই, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা নিয়ে একদল শিক্ষিত দাস ধনী মানুষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে সচেষ্ট হয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামের কথা বলে, স্বপ্ন দেখিয়ে, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেন। বেশিরভাগ মানুষই ইহজাগতিক মুক্তির চেয়ে পারলৌকিক মুক্তির জন্য আকুল হয়ে উঠছেন। জাগতিক মুক্তির জন্য জনগণের সামনে সত্যিকার কোনো দল নেই।

দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে এবং একই সঙ্গে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যাও কমছে। এতে করে ধনী মানুষ কম মূল্যে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের শ্রম কিনতে পারছে। শ্রমজীবী মানুষ ক্ষুধার্ত এবং আশ্রয়হীন হলে দিনশেষে ধনী মানুষের জন্য ক্ষতিকর বটে। ধনী মানুষ নানাভাবে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ যতখানি সুযোগ-সুবিধা না পেলে বিদ্রোহ করবে ঠিক ততখানি সুযোগ-সুবিধাই পাবে। আমাদের প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ ন্যায়ভিত্তিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ কাঠামো নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন; কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। আমাদের প্রবীণরা নতুন প্রজন্মের জন্যে রেখে যাচ্ছেন ‘প্রতারণা’ নামক ভয়ঙ্কর এক মরণব্যাধি। ভেজাল প্রতারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, শিশুখাদ্যে ভেজাল। ভেজাল প্রতিরোধে সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা রয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো ভেজাল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি। সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘প্রতারণা’ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। রাস্তাঘাটা, ব্রিজ, দালানকোঠা নির্মাণে নি¤œমানের সামগ্রীর ব্যবহার কাক্সিক্ষত স্থায়িত্ব অর্জনে ব্যর্থ হয়।

সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত করকে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার মনমানসিকতা কিংবা জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ হয়নি। যারা প্রবীণ হয়েছেন কিংবা আগামীতে প্রবীণ হবেন তাদের মধ্যে সামর্থ্যবানরা সাধারণ মানুষের কল্যাণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহ অনেক কম। তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে, প্রমোশনে, প্রাইজ পোস্টিংয়ের জন্য অনেক ব্যাকুল। ক্ষমতার শীর্ষে নিজকে দেখার স্বপ্ন থেকে মুক্ত হতে পারেন না। সামর্থ্যবানরা শুধু নিজের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করে ক্ষান্ত হতে চান না। তারা ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যৎ যেন নিরাপদ এবং ঝামেলাবিহীন হয় তার একটি সুবন্দোবস্ত করে যেতে চান। অথচ তাদের ওপর ন্যাস্ত ছিল আগামী প্রজন্মকে ঝামেলাবিহীন, নিশ্চিদ্র চলাফেরা, লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। দুর্নীতি, পরিবেশদূষণ, ভেজাল থেকে নবীনরা রেহাই পায়নি। তারা এসব পাবে উত্তরাধিকার সূত্রে। নবীনরা প্রবীণদের সৃষ্ট আবর্জনা, অপশাসন, নৈরাজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস, নদনদী উদ্ধার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করতে হবে। নবীনদের জন্যে শুধু ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে গেলেই হবে না। বাংলাদেশকে বাসোপযোগী করে দিতে না পারলে প্রবীণরা প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। শুধু শারীরিকভাবে প্রবীণ হলেই সম্মানিত হওয়া যায় না। যারা সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে কাজ করেছেন তারাই অধিক সম্মানিত হবেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়