রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২২, ০০:০০

বদলে যাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ মানুষ ভুগছে একাকিত্বে
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার

মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। আর সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের প্রতিনিয়ত নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। পেশার ক্ষেত্রে, পারিবারিক কাজে, ধর্মীয় কাজে, চলাফেরার ক্ষেত্রে সর্বোপরি জীবনকে গতিশীল রাখতে তা অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন। কিন্তু ইদানীং কেন যেন মনে হচ্ছে চারপাশে ‘মানুষ’ পাওয়ার অভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। বলতে পারেন, সর্বত্র এতো মানুষ গিজ গিজ করছে, কোথাও একটু স্বস্তিতে দাঁড়ানোর উপায় নেই। আর আমি কিনা বলছি মানুষ পাওয়ার অভাবের কথা। সত্যি সত্যি বলতে হয়, সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে হয়তো জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু নিজ পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের দিকে একটু সচেতনভাবে তাকালে হিসাবটা কেমন যেন গোলমাল ঠেকছে। দেশের মোট জনসংখ্যা বাড়লেও কাছের মানুষের সদস্য সংখ্যা কমছে। দাদা-দাদী, বাবা-চাচা, আপনার সন্তানদের সংখ্যার প্রবণতা লক্ষ করলেই তা স্পষ্ট হবে। এ সংকট ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে।

আগের দিনে বিপদ-আপদে না ডাকতেই আত্মীয়-স্বজন এসে হাজির হতো। মাঝেমধ্যে তাদের বাড়িতে যাতায়াত হতো। এভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক গভীর হতো। এখন প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। তাদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যাও কমছে। পড়াশোনা বা কাজের সুবাদে দূরবর্তী কোনো না কোনো স্থানে অবস্থান করতে হচ্ছে। আর যারা বাসা-বাড়িতে থাকছে তাদেরও অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার, একক পরিবার থেকে অণু পরিবার ক্রমাগতভাবে বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের ঐতিহ্য বেশ দ্রুতই হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

সংখ্যাগত ঘাটতির দিকটা আমরা জেনে-বুঝেই গ্রহণ করেছি। তার ফলাফল দেখার জন্য হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মানুষের গুণগত দিকটা হুমকির মুখে বেশি পড়ছে। সহপাঠী, সহকর্মী, প্রতিবেশী ও এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আন্তরিক, সহানুভূতিশীল ও দরদি মানুষের সংখ্যা কমছে বৈকি। পুরানো মানুষগুলো বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেনো যেনো পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। এ কি শুধু আমারই ধারণা না অন্যেরও তাও বুঝে উঠতে পারছি না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল যোগাযোগের সুযোগ বহুগুণ বেড়েছে। চাইলেই প্রত্যাশিত মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় কিংবা যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। কিন্তু একান্ত মনের কথাগুলো বলার মতো মানুষ সত্যিকারের ক’জন রয়েছে বলতে কি কেউ পারেন? মোটিভেশনাল স্পিকাররা আমাদের সন্তানদের সফট স্কিলের নামে ভদ্রতা, উপস্থাপনা, বক্তৃতা ও গ্রহণযোগ্য আচরণ আজকাল শেখাচ্ছে। কিন্তু আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা ও আস্থার জায়গায় ঘাটতি ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। এখন মানুষের বাহ্যিক চাকচিক্য বা সৌন্দর্য ও বিলাসিতা যত বাড়ছে, অন্তরের কলুষতা বাড়ছে তার চেয়েও অধিক গতিতে। যা বলার অবকাশ রাখে না। হয়তো সে কারণেই আজকাল অধিকাংশ সম্পর্ক হয়ে গেছে বড্ড মেকি, লোক দেখানো। ভদ্রতায় মোড়া, আপাতদৃষ্টিতে সম্প্রীতির পরিবেশ, কিন্তু কেউ কাউকে বিশ^াস করতে পারছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে হয় কৌশলে নিজেকে রক্ষা করতে, নয়তো সুবিধা তুলে নেয়ার খেলায় সবাই তৎপর রয়েছে। সত্যিকারের শুভাকাক্সক্ষী, বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। পারস্পরিক আস্থা ও নিরাপত্তার জায়গা হচ্ছে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমাজ, কর্মক্ষেত্র এমনকি পরিবারে এমন চর্চা বাড়তে থাকায় কোথাও হয়তো নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে নিজেকে ঠেকাতে অতিমাত্রায় সচেতন হতে হচ্ছে। ফলে আজকাল প্রাণবন্ত আড্ডা, সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া কিংবা সত্যিকারের মেলবন্ধন হচ্ছে না। অনেক অনুষ্ঠানের জৌলুস বেড়েছে, সাজসজ্জার চমক বেড়েছে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের ‘প্রাণহীন’ অভিব্যক্তি গোপন করা যাচ্ছে না। ফলে জনবেষ্টিত পরিবেশে থেকেও আমরা বড় একা হয়ে যাচ্ছি।

মাঝেমধ্যে মনে হয়, আগের দিনে ‘বোকা’ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তাদের চাহিদা ছিল কম, ছিল ত্যাগের মানসিকতা। যৌথ পরিবারে থেকেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মুখের দিকে চেয়ে নিজের অনেক চাওয়া-পাওয়া কম্প্রোমাইজ করতো, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতো। এজন্য নানা কাজের মাঝেও চারপাশের মানুষগুলোর জন্য সময় বের করতে পারতো। কিন্তু বর্তমান সিস্টেম সবাইকে ‘চালাক’ বানাতে সচেষ্ট রয়েছে। একক পরিবারে থেকেও ‘আমি কেন বঞ্চিত হবো’ এ প্রশ্ন দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারছে। কেউ কারো থেকে পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়।

একসময় দূরবর্তী মানুষের চেয়ে নিজ গোষ্ঠী বা বংশ কিংবা পরিবার লাভবান হওয়ার চেষ্টা থাকতো। তারপর আত্মীয়-স্বজনদের চেয়ে নিজ পরিবার লাভবান হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রবল হয়। এখনতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যের চেয়ে নিজের ‘লাভ’ বোঝা লোকের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নিখাদ সম্পর্কগুলোতেও বিষ ঢুকে যাচ্ছে। এখন আর শুধু দূরের মানুষেরা আমাদের প্রতিপক্ষ কিংবা প্রতিযোগী নয়, বরং পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, মা-সন্তানের মধ্যেও তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ ছাড় দিতে রাজি নয়। নিজের স্বার্থ রক্ষা বা উদ্ধারে সবাই তৎপর। ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, মনের-টান থাকছে উপেক্ষিত। বাস্তব প্রয়োজনেই আমরা নিত্যদিন হরেক রকম মানুষের সঙ্গে মিশছি, কাজকর্ম করছি কিন্তু নির্ভর করা বা আস্থা রাখার মতো মানুষের সংখ্যা দ্রুতহারে কমছে। সবাই এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।

আর সেই অনিশ্চয়তার নিরাপত্তাহীনতার উপর ভর করে জমে উঠেছে নতুন পণ্যের বাজার। মানুষকে যত বিচ্ছিন্ন করা যাবে, অন্যদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ করে তোলা যাবে, হিংসা ছড়িয়ে দেয়া যাবে, প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হবে, ততই তাদের নতুন নতুন পণ্যের দরকার হবে। সেটা বোঝার জন্য বেশি দূরে যেতে হবে না, আপনার চারপাশে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতার লক্ষ্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অপরদিকে, এক-দেড় যুগ আগেও ডে-কেয়ার সেন্টারের ধারণাটি আমাদের দেশে বাঁকা চোখে দেখা হতো। নগরজীবনে এখন অনেকটা বেশ গ্রহণযোগ্য। ঠিক তেমনিভাবে দশ-বারো বছরের মধ্যে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ব্যবসাও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এমন ধারণার প্রচ- বিরোধী মানুষটি নিজেই সেখানে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করবেন। কারণ নগরে নিঃসন্তান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের এক-দু’টি সন্তান রয়েছে তারাও সফল হয়ে বড় শহর বা বিদেশে পাড়ি জমাবে। জীবনসঙ্গীও চিরদিন থাকবে না। তখন তো আপনাকে আমাকে সে পথেই হাঁটতে হতে পারে, তাই কি-না? আসলে অন্তর দৃষ্টিতে দেখতে দেখা যায়, চারপাশে অসংখ্য মানুষ থাকলেও দিন শেষে সত্যিকারের মানুষের বড্ড অভাব।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা, সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়