প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
বছর ছয়েক আগের কথা। আমি তখন কানাডায় প্রফেশনাল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতাম। আমার শহর অ্যাডমন্টন থেকে ঘণ্টা দেড়েকের ড্রাইভিং দূরত্বে এক সাইট পরিদর্শনে যাওয়ার পথে হঠাৎ দেখি গাড়ির ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না।
বরফের কারণে রাস্তাও ছিল পিচ্ছিল। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার। ডিভাইডারের একপাশে আমি উত্তর দিকে যাচ্ছিলাম, অন্যপাশে বিপরীত দিকের গাড়ি চলছে। মোট ছয় লেনের রাস্তা। আমি কোনোভাবে ডিভাইডারে গাড়ি আটকে দিয়ে বড়ো ধরনের দুর্ঘটনা থেলে রক্ষা পেলাম। ঘর্ষণে গাড়ির সামনের দিকের একটি চাকার হাওয়া চলে যায়। তাই, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার বিকল্প ছিল না।
বিপদ কখনো একা আসে না। পকেটে হাত দিলাম সহায়তা পেতে মোবাইল ফোনে পুলিশ ডাকব বলে। কিন্তু, ফোনটি পেলাম না। তার মানে, ভুলে বাসায় রেখে এসেছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে ছিল, কিন্তু গাড়ির ইনস্যুরেন্সের কাগজটি মানিব্যাগে নেই। বিপদে পড়ে বুঝলাম, ওসব ডকুমেন্ট সাথে রাখা কতটা জরুরি।
বাইরে ঠা-া, মাইনাস টেন। রাস্তার পাশে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব সেও অসম্ভব। অগত্যা গাড়ির ইমার্জেন্সি লাইট অন করে আমার গাড়ির পাশ দিয়ে কোনো পুলিশের গাড়ি যায় কি না সে অপেক্ষায় রইলাম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রমহিলার গাড়ি আমার পাশে এসে থামল। তিনি জানালার কাছ নামিয়ে জানতে চাইলেন আমি পুলিশে ফোন দিয়েছি কি না। ফোন সাথে নেই জানাতেই উনি তার নম্বর থেকে ফোন দিয়ে পুলিশে ঘটনাটা জানালেন। তাকে ধন্যবাদ দিতেই তিনি গাড়ি চালিয়ে তার গন্তব্যে রওনা দিলেন।
পরের মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুলিশ এলো। একজন নয়, দুজন, দুটি আলাদা গাড়ি করে। প্রথমেই তারা আমি ঠিকঠাক আছি কি না জানতে চেয়ে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ইনস্যুরেন্সের কাগজ দেখতে চাইলেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখালাম, আর, ইনস্যুরেন্সের কাগজ সাথে নেই জানালাম। তারা অনলাইনে চেক করে ইনস্যুরেন্সের তথ্য খুঁজে বের করলেন। তারপর জানতে চাইলেন, তারা আমাকে এ পরিস্থিতিতে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন?
আমি বললাম, আমাকে সাইট পরিদর্শনে যেতে হবে এবং আমার গাড়িটি কোনো রিপেয়ারিং ওয়ার্কশপে দিতে হবে। তারা জানতে চাইলেন, আমার পছন্দের কোনো ওয়ার্কশপে দেবেন, নাকি, যেকোনো ওয়ার্কশপে দিলে চলবে? আমি নির্দিষ্ট করে একটি ওয়ার্কশপের নাম বললে তাদের একজন নামটা কম্পিউটারে নোট করে নিলেন।
এক পুলিশ গেলেন ওয়ার্কশপে আমার গাড়ি পাঠানোর কাজে, আর, অন্যজন আমাকে নিয়ে চলে গেলেন আমার সেই পরিদর্শনের সাইটে। গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার সময় জানতে চাইলেন বাসায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সহায়তা লাগবে কি না। আমি না জানালাম। এই হলো কানাডার মতো উন্নত দেশে পুলিশি সহায়তার নমুনা। এসব দেশে পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা অপরিসীম। আপদে বিপদে আক্ষরিক অর্থেই পুলিশ জনগণের বন্ধু।
আজ এতদিন পর উপরের ঘটনাটি পাঠকদের জানানোর একটি বিশেষ কারণ আছে। গত রাতে ঢাকায় বসবাসরত আমার এক ভাতিজার সাথে কথা হচ্ছিল। নাম, সাকিন। আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে তার অফিসের তিন সহযোগীকে সাথে নিয়ে সে নিজের গাড়িতে করে জাফলং বেড়াতে গিয়েছিল।
জাফলং থেকে সিলেট শহরে আসার পথে তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলো। রাত এগারোটার মতো হবে। রাস্তাঘাটে লোকজন তেমন নেই। বিপরীত মুখে চলা একটি ট্রাক আরেক ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে সাকিনদের গাড়ির মুখোমুখি হয়ে গেলে তাদের গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত রাস্তা ছেড়ে পাশে মাটির উপর চলে যায়। একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়িটি থামে।
গাড়ির গতি খুব বেশি থাকলে তাদের কারো বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না। সামনের আসনে বসা দুজন নাকে, মুখে, বুকে আঘাত পেলেও সংজ্ঞা হারায়নি। তবে, গাড়ির পাশ থেকে ধাক্কা খেয়ে এক পথচারী কিছুটা আহত হন। গাড়িটার এক পাশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওদিকে, ট্রাকটি দ্রুত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে স্থানীয় কয়েক লোক জড়ো হলেন। তাদের মধ্যে একজন নিজেকে স্থানীয় ইউপি সদস্য বলে পরিচয় দিলেন। নিজেরা আহত হলেও তা আপাতত উপেক্ষা করে সাকিনরা আহত পথচারীকে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে ইউপি সদস্যকে অনুরোধ জানাল। সাকিনদের কাছ থেকে নগদ দশহাজার টাকা নিয়ে ইউপি সদস্য অপর এক সহযোগীসহ আহত লোকটিকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।
পরদিন সেই আহত লোকটি সাকিনকে ফোন দিয়ে বলেন চিকিৎসার জন্য আরও টাকা দরকার। এ যাবৎ কত খরচ হয়েছে জানতে চাইলে লোকটি জানালেন প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। সাকিন তখন চিকিৎসা খাতে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে জানালে লোকটি বলেন, ইউপি সদস্য তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তাকে হাসপাতালে রেখে চলে গেছেন। তার মানে, মোট টাকার অর্ধেকের খবর নেই।
সাকিন দেরি না করে তার এক সামরিক অফিসার বন্ধুকে বিষয়টা জানালে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওই ইউপি সদস্য আহত লোকটির হাতে আরও চারহাজার টাকা দিয়ে এলেন। ওদিকে, সাকিন এবং তার আহত সহকর্মীরা একটা ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি সারানোর উদ্যোগ নিলো।
এতো বড় দুর্ঘটনায় পুলিশের কোনো সহায়তা নেওয়া হয়নি কেন বা দুর্ঘটনা যে ট্রাকের কারণে ঘটেছে সেটি চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নিতে পুলিশের শরণাপন্ন হলো না কেন, তা সাকিনের কাছে জানতে চাইলে সে তার এক হতাশাজনক অভিজ্ঞতা আমার কাছে তুলে ধরল।
কয়েক বছর আগে নাকি তার গাড়িকে আরেক গাড়ি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলে সে পুলিশের সাহায্য নিয়েছিল। পুলিশ থানায় আলামত হিসেবে আটকে রাখতে চেয়েছিল তার গাড়ি। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গাড়িকে ধরার চেষ্টা তো দূরের কথা। বরং, গাড়ির কাগজপত্রের বিভিন্ন ভুলত্রুটি ধরে তার কাছ থেকে হাজার দশেক টাকাও নিয়ে নিয়েছিল সেদিন। এ ঘটনা মনে হতেই এতো বড় দুর্ঘটনা সত্ত্বেও তারা সে রাতে পুলিশের সাহায্য চায়নি। বাংলাদেশের পুলিশের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা কোন্ পর্যায়ে নেমেছে তা এই একটি ছোট ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়।
‘বাংলাদেশে পুলিশ নিয়ে এতো অসন্তোষ কেন?’-এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কিছুদিন আগে বিবিসি বাংলা একটা জরিপ চালায়। ঢাকার একজন বেসরকারি চাকরিজীবী পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিবিসিকে বলেন, ‘একটা আতঙ্কের নাম পুলিশ। আস্থার চেয়ে অনাস্থাই বেশি। কারণ, তারা নিজেদের জনগণের প্রভু হিসেবে বিবেচনা করে।’
একই প্রশ্নের উত্তরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ বলপূর্বক অর্থ আদায় বা ঘুষের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত। আমাদের গবেষণায় ৭০ শতাংশ মানুষই বলেছেন ঘুষ না দিলে কোনো সেবাই পাওয়া যায় না।’ তার মতে এর সাথে রয়েছে পেশাদারিত্বের ঘাটতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার। নিয়োগ পদোন্নতি বদলিতে পেশাদারিত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক প্রভাব।
গত দু’দশক ধরে আমি দেশের বাইরে অবস্থান করলেও পত্রপত্রিকার কল্যাণে দেশের খবর নিয়মিত রাখি। রাজনৈতিক প্রভাবে বাংলাদেশের পুলিশ নিয়ন্ত্রিত হয় একথা কোনো বিশেষ দৃষ্টান্ত ছাড়াই স্বীকার করে নেওয়া যায়।
জনগণকে সেবাদানের চেয়েও পুলিশের দায়িত্ব হয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের সন্তুষ্ট রাখা বা সেবা দেওয়া। সেই সেবা যে সবসময় নিয়মনীতির ভেতরে থেকে হয় তাও কিন্তু নয়। অর্থাৎ, রাজনৈতিক প্রভাবে আইনের পাশাপাশি পুলিশের বেআইনি ব্যবহারও হয় বিস্তর। এ অবস্থা কেবল বর্তমান সরকারের আমলে নয়, কয়েক দশক থেকেই দেশে এ অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করছে। ফলে, ট্রিপল নাইন-এ ফোন দিয়ে সেবা পাওয়াও সবার ভাগ্যে জোটে না।
পুলিশকে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য সাজা দিতে হবে। তবেই, পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত হবে। অথচ, আমাদের দেশে পুরস্কার বা সাজা যথাযথ বিবেচনায় দেওয়া হয় না।
পুলিশে পেশাদারিত্ব বাড়াতে রক্ষাকারী এই সংস্থাকে প্রভাব মুক্তভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতে হবে। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকা- মনিটরিংয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজে প্রয়োজনে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো থেকে বিভিন্ন সময় দক্ষ পুলিশ সদস্যদের দেশে এনে আমাদের পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি, জনগণের কাছে পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এই সংস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে না পারলে পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ত্বরান্বিত করবে। তখন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে; ঘরে-বাইরে, রাস্তা-ঘাটে নিরাপরাধ মানুষের ভোগান্তিও উঠবে চরমে।
লেখক : এমএলগনি। কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট।
সূত্র : ঢাকা পোস্ট।
২২.
ভাষা কোন পোশাক তো নয়
বদলানো তা সহজ
ভাষা নয়কো চাদর-শাড়ি
লাগবে কয়েক শ’ গজ।
ভাষা নয়কো আইনী বিষয়
বিধান দিবে তা জজ
ভাষা হলো মায়ের মতো
কভু সে দেয় না ডজ।
ভাষা তো নয় আহার-বিহার
রাঁধুনীদের বিষয়
ভাষার জন্যে জিন্নাহ্ কাকার
রেসিপি আর কি সয়!
ভাষা তো নয় রোগের মত
কবিরাজের খেলা
ভাষা নিত্য শেকড় হতে
রক্তে মারে ঠেলা।
ভাষা তো নয় জমিদারের
পাইক-পেয়াদার হাঁকা
ভাষা হলো আম-মানুষের
চালায় মনের চাকা।
ভাষা হলো প্রাণের সুধা
মায়ের মধুর ধারা
বাঙালিরা বিকল বটে
বাংলা ভাষা ছাড়া।
২৩.
অন্তরে যার শ্রদ্ধা ও প্রেম
ভাষার জন্যে বাঁধা
ভিনদেশিদের হাজার চমক
লাগায় না তো ধাঁ ধাঁ।
দুই চোখে যার স্বদেশ ঘুমোয়
ভাবনাতে রয় মায়ে
বর্গী তাদের বাঁধতে শেকল
ব্যর্থ হয় দু'পায়ে।
যার দুহাতের দশ আঙুলের
ঐক্য থাকে কড়া
তাদের জীবন নদীর মতোন
পায় না মোটেই জরা।
ভাষার জন্যে যাদের প্রাণের
গভীর কোঠায় বাজে
গর্জে তাঁরাই উঠতে পারেন
জয়ধ্বনির ঝাঁঝে।
বাংলা ভাষার সুধার ধারায়
সেইদিন রাজপথে
রক্তগাঙের নহর ছোটায়
বুকেরই মাঝ হতে
তাঁদের প্রাণের দীপের আলোয়
আমরা একুশ পেয়ে
প্রভাতফেরির নগ্ন পায়ে
যাই তারই গান গেয়ে।
২৪.
ভাষার বিরোধী যত কূটামোদী
শুরুতেই ছিল গোণা
পাল গেলে চলে সেন এসে বলে
বাংলা যে পাপ শোনা।
পদবদেবী যত শোনে অবিরত
সংস্কৃতের বাণী
বাঙাল ভাষাতে মন্ত্র থামাতে
শুরু হলো কানাকানি।
রৌরবানলে মরে ওরা জ্বলে
যারা বাংলায় নমে
মরণের পরে কেটে থরে থরে
নুন দেয় তারে যমে!
মধ্য যুগের সুদিন সুখের
বাংলাকে রাজা পালে
ব্রাহ্মণ গেলে পুনরায় মেলে
বাংলাকে সমকালে।
কিন্তু কী হায়! হলো পুনরায়
বাংলা যে অসহায়
মরুভাষা এসে বাংলাকে পিষে
স্রষ্টার নামে তায়।
রেগে উঠে কবি স্বকালের রবি
বঙ্গবাণী কাঁ-পায়।
তারপরে এসে বেনিয়ারা ঠেসে
কোণঠাসা করে দেশ
ইংরেজি হেনে মারে তারা জ্ঞানে
লুটে করে সব শেষ।
এরই জের ধরে পাই টের পরে
উর্দু যখন হাঁকে
ভাষা কেড়ে নিয়ে পিলে চমকিয়ে
চেয়েছে মারতে মাকে।
জানে না তো ওরা মা’র বুক জোড়া
আছে বীর যত ছেলে
তারা রাখে মান প্রাণ করে দান
বুকের রক্ত ঢেলে।
ইতিহাস বলে বাঙালিরা জ্বলে
দেয়ালে ঠেকালে পিঠ
ভাষার এ মাসে তাই উচ্ছ্বাসে
প্রণামী মাতৃপীঠ।
২৫.
ভাষার মাসের পায়ে কুড়োল
মারছে কারা দিনরাতে?
হিন্দি ভাষায় গান বাজিয়ে
নাচায় ভূত আর জ্বীন সাথে!
শহীদ দিবস তুচ্ছ করে
নৃত্য করে পিকনিকে
কিংবা বিয়ের তারিখ ফেলে
খাওয়ায় দাওয়াত দিগদিকে!
তাদের দেখে মিনার হতে
বর্ণমালা হয় অবাক
ভাষার মাসে ভিন ভাষাতে
পাল্টে ফেলে হায় স্ব-বাক!
জাগরণের পূর্বরাতে
ছাদ-তালুতে পোড়ায় গোশ্
হুঁশ হারিয়ে তাল হারিয়ে
মাতাল জলে বেজায় খোশ্!
ভাষার মাসে যারাই নাশে
বাংলা মায়ের শিরের মান
তাদের জন্ম অনির্ণেয়
মুখোশ পরেই ধরে ভাণ।
২৬.
ফেব্রুয়ারি ছাব্বিশ তারিখ
সেই বাহান্ন সালে
আবুল কালাম শামসুদ্দীন
আবার আলো জ্বালে।
শহিদ স্মৃতি উদ্বোধনের
পুণ্য ইতিহাসে
সত্তর বছর পরে আজকে
তাঁর নামটাও আসে।
কিন্তু একী! উর্দি পরা
জান্তারা এক হয়ে
গুঁড়িয়ে দেয় শহিদস্মৃতি
মিনার গেল ক্ষয়ে।
পাষাণ-মিনার ভাঙলে তবু
কী আসে যায় তাতে
স্মৃতির মিনার মনে গাঁথা
অর্ঘ্যে দিনেরাতে।
আজকে যারা জুতো পায়ে
বেদির ওপর ওঠে
তাদের এমন অপকর্মে
কার না রক্ত ছোটে?
ইতিহাসকে এড়ায় যারা
জন্ম-ত্যাড়া ঘাড়ে
তারাই হলো পশ্চিমা বীজ
বাসুকী-বিষ ছাড়ে।
২৭.
ভাষার জন্যে লড়ল যাঁরা
রক্ত দিলো পথে
তাঁরাই ছিলো অদ্রি অটল
দেশের প্রেমের ব্রতে।
তাঁদের সে সব আত্মদানের
অতল অপার ঋণে
রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে আজ
পেলাম রক্তে জিনে।
রফিক সালাম বরকতেরা
যাদের গুলি খেলো
তাদের কিছু বর্জ্য বীজে
আজকে আবার এলো।
যাদের কাছে বাংলা আজি
অচল ভাষার নাম
তাদের মুখে লাগুক তবে
চিরস্থায়ী গাম।
বাংলা ভাষার মধুর বোলের
ছড়াক সুধা প্রাণে
আগামীতে কেউ যেন আর
বাংলাকে না হানে।
সাতশো কোটি মানুষ মুখে
বাংলা বলুক সুখে
রক্তদানের ফেব্রুয়ারির
ঋণ যাতে যায় চুকে।
২৮.
ভাষা বাঙালির হাতিয়ার ছিলো
ভাষা বাঙালির চালিকা
ভাষা বাঙালির কনক-মুকুটও
ভাষা বিজয়ীর মালিকা।
ভাষা বাঙালির প্রাণের প্রবাহ
ভাষা বাঙালির গরবও
ভাষা বাঙালির বারো মাসজুড়ে
তের উৎসব পরবও।
ভাষা গুঁড়ো করে তারা শুরু করে
বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন
সেদিনের থেকে পথ গেছে বেঁকে
হয়ে গেছে দিশ্ ভিন্ন।
ফেব্রুয়ারিকে বেঁধেছি ভাষাতে
বেঁধেছি ফাগুন মননে
বর্ণমালাকে পেয়েছি কণ্ঠে
বজ্রকণ্ঠ-স্বননে।
শহিদ মিনারে সদা স্মৃতি নাড়ে
ভুসুকু পা’য়ের বাণী
চর্যাপদের বাংলা ভাষাতে
এ ভূমি হয়েছে জ্ঞানী।
বায়ান্নে এসে সায়াহ্নে মেশে
ভাষার বিরোধী শ্বাপদ
তবু মাঝে মাঝে কিছু কানে বাজে
হায়েনামুখোর আপদ।