রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

জোবায়ের মিলন

বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা-উপর তলের জল নয়। এর ইতিহাস হাজার বছরের বা তার চেয়েও বেশি সময়ের। কালের সাক্ষীতে গণনা করলে দিন মাস বছর বের হবে, ভাবের চিহ্নে এ এক পুরাণ। অতি প্রাচীনে না গিয়ে আবহমান কালে হিসাব করলে বৃটিশকাল থেকেই বাংলাভাষা উজ্জ্বল রেখায় সামনের লাইনে দাঁড়িয়েছে তার নিজস্বতার দাবি নিয়ে। বীজ থেকে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়েছে এর আপন মহিমা। চলেছে স্বরে সুরে মজবুত রস নিয়ে। কখনো পড়েছে খাদে, কখনো পড়েছে গিরিখাদে, কখনো অতলে হারিয়ে যেতে যেতে ভেসে উঠেছে সাহসের বলে। উনিশশ’ সাতচলি¬শের পর এই ভাষার ওপর সরাসরি খড়গ চলতে থাকে নীরবে ও প্রকাশ্যে। এ অজানা নয় কারো। বাংলা, বাংলাভাষা ছিল, থাকবে এই প্রত্যয়ের রশ্মি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাতে একদল পিশাচ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো তাদের নিজেদের আত্ম-অহংকার জারি করার জন্য। নিজেদের শাসনের শোষণের ছড়ি ঘুরানোর জন্য। তারা জানতো বাংলা থাকলে, বাংলাভাষা থাকলে তাদের আঁতে-ঘা পড়বে। নিপীড়নের ষোলকলা তারা পূর্ণ করতে পারবে না নিপুণ দাগে। তারা জানতো স্বভাষায় অধিকার দিলে বাঙালি বিজয়ের পথ থেকে নামবে না, নিশ্চিত বিজয় কেড়ে নেবে অপশাসনের হাত থেকে, নির্যাতনের খোলস থেকে। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান নামে যে ভূখ-কে বৃটিশ বেনিয়ারা কুচক্রান্তের লালায় ম- তৈরি করে দিয়েছে বা জিন্নাহ্রা যে লালসায় বেনিয়াদের বুঝিয়েছে তাতেই চক্রান্তের নীল নকশা লুকিয়ে ছিল গভীর মোড়কে। জিন্নাহ আর বৃটিশ অপয়ারা জানতো সরিষার মধ্যে ভূত আছে, জেনেও চুপ ছিল এক খেইল থেকে বের হয়ে আরেক খেইলে গুটি চালানোর নেশায়। তাদের দাবার চাল ব্যর্থ হয়নি। জিন্নাহ বাহিনী স্বাধীনতা পেতেই পরাধীন করে তুলেছিল এই বাংলাকে। তারা মুখে এক সংসার বললেও দ্বি-সংসারের মতো বিমাতা সুলভ আচরণ শুরু করে। ভূ-গত কারণে পূর্ব বাংলার যোগাযোগ ভারত ভূমির সাথে বেশি ছিল বলে পশ্চিম পাকিস্তান ধরেই নিয়েছে এই বাংলা তাদের নয়। কারণহীন শঙ্কায় ভুগতে ভুগতে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে অশুভ ছোবল বসাতে শুরু করলো বাঙালিদের সত্তায়। মৌলিক ব্যাখ্যা ছাড়া কেবল দ্বিজাতি তত্ত্বের মন্ত্রে বিভাজিত বৃটিশ-ভারত ভাগ থেকে উদ্ভূত পাকপশুরা অনুধাবন করেছিল, যে মতোন্নতিতে বিশাল খ-কে টুকরো করা হয়েছে তা ভঙ্গুর; প্রীতিই জাগতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার মন্ত্র। তাই একপেশে রুলার চালাতে আর ভুল করলো না। জন্ম-লগ্ন থেকেই হিসাবের করা খাড়া করে ঠকাতে শুরু করলো বাংলাকে। অর্থনৈতিক থেকে সামাজিক সাংস্কৃতিক সকল বিকাশ তারা শুষে নিতে লাগলো জোঁকের মতো। এক সময়ে এসে রস তলানিতে ঠেকলে বাঙালি দাঁড়ালো ঘুরে। সত্তাকে বিসর্জন দিতে চাইলো না বাংলার গণমানুষ। ধান চাল জমি জিরত সব নেয়ার পরও চুপ ছিল এ জাতি। রব করলো মায়ের গায়ে আঘাত লাগায়। মায়ের ভাষায় ঘাত পড়ায়। পাকিস্তান হায়নারা ঘোষণা দিলো, উর্দুই হবে সর্ব-পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা। উর্দুই হবে কথার লেখার ভাব প্রকাশের একমাত্র বাহন। বাংলাকে মেনে নেয়া যাবে না। বাংলা মানেনি সে আদেশ। রক্তের দোলে দোল খেয়ে উঠেছিল পথ-প্রান্তর। যে ভাষাতে এই বাংলা গান গায়, ছড়া পড়ে, কবিতা লেখে, রাগ ক্ষোভ প্রকাশ করে, চাঁদনী রাতে মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনে, বাবার সাথে অংক কষে, বোনের মমতা মাখে, ভাইয়ের আদর নেয়, প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করে সে ভাষা পাল্টে যাবে, সে ভাষা ব্যবহার করা যাবে না, সে ভাষায় মা’কে মা ডাকা যাবে না, বাবাকে বাবা বলা যাবে না তা কী করে হয়? মাত্র তো বছর চার-পাঁচ, তার মধ্যেই সবখেকোদের সব খাবার এমন আক্রোশ! বাঙালির বুঝতে বাকি রইল না, হিং¯্র পাকিরা আর কী কী করতে পারে। প্রতিবাদ আর প্রতিস্বরে না-রাজি দিলো, পথে নামলো মায়ের ভাষার জন্য, প্রাণের ভাষার জন্য, বাংলা ভাষার জন্য। অ, আ, ক, খ-এর জন্য। শুরু হলো আন্দোলন। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন।

ক্রমে ক্রমে এর পটভূমি রচিত হলেও উনিশশ’ বায়ান্ন সালে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। উনিশশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, আটই ফাল্গুন তেরশ’ আটান্নতে ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’ এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল জনতা আর রাজনৈতিক কর্মী মিলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল শুরু করে। মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আসলে পাক-পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর বর্বরোচিত কায়দায় গুলি চালাতে শুরু করে। গুলিতে গুরুতর আহত ও নিহত হন রফিক সালাম জব্বার শফিউরসহ অনেকে। ভাষার দাবিতে রাজপথ রঞ্জিত হয় বাঙালির লাল রক্তে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে আগুনের ফুল্কির মতো। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালির কাছে নতি স্বীকার করে উনিশশ’ ছাপ্পান্ন সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। উনিশশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির জাগ্রত চেতনার পথ ধরেই উনিশশ’ একাত্তর সালে এক নদী রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর বুকে লেখা হয়েছে নতুন ইতিহাস। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সতেরই নভেম্বর ঊনিশশ নিরানব্বুই খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। ইউকেস্কোভুক্ত বিশে^র একশত আটাশিটি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আান্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ সম্মান জানিয়ে চরম আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটি বাঙালি জাতির গর্বের বিষয়।

কিন্তু সমকালে এসে এ গর্ব কতটুকু বহন করি আমরা? নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী কতটা অনুধাবন করে অন্তরে? নতুন সময়, সময়ের বিবর্তন, বিশ^ময়তা এক খোলসে হাজির, হাতের কাছে পৃথিবীর নথি-নকশা পাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম না হয় পথ থেকে পথের ঢালে নেমেছে ভুলে! যারা প্রবীণ, যারা ভাষা আন্দোলনের তাপদাহ পেরিয়ে বর্তমানে হাজির, যারা সেকালের দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন, বুঝেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা কোথায়? তারা কী বহন করেছেন এতটা কাল? আর কীভাবেই বহন করেছেন যে তা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারছেন না সঠিক সূত্রে? অপবাদ বা অভিযোগ নয়, এই কথা উঠে আসে কথায় কথায়। সেও না হয় বাদ দিলাম এক কথায়। প্রবীণরা হয়তো সময়ের সাথে সাথে দুর্বল আর এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েন প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু একটি জাতির কৃষ্টি কালচার আচার আচরণ তো একটি নির্ভরশীল নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়োজিত থাকে। তারা কোথায়? কী করছেন প্রজন্মের বিপথ-গমনের এ কালো সময়ে? এ সময়ের একজন নবীনকে দেখা যায় বাংলার চেয়ে হিন্দি, ইংলিশ বা হ-য-ব-র-ল এক ভাষায় পারদর্শী। তারা বাংলা বললেও ভাষাকে রূচিহীন ভাবে উপস্থাপন করে। আপন বৈশিষ্ট্যে দাঁড় করাতে এখনো তারা ব্যর্থ। এ দায় কি শুধু তরুণদের? নিয়ম কানুন যারা বানান, যারা তা রক্ষণ সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন তারা কোন্ মানদ-ে, কোন্ নিয়মে তা পর্যবেক্ষণ করেন, জানতে ইচ্ছে হয়।

পৃথিবী এগিয়েছে। অর্থনৈতির সামাজিক উৎকর্ষতা, অগ্রসরতা যে কাউকে টানবে, এটাই সত্য। ইংরেজি ভাষার দেশ বা সমাজ বাংলা ভাষার দেশ বা সমাজের চেয়ে অগ্রসর তা মানতে দ্বিধা নেই। উন্নত বিশে^ সুযোগ সুবিধা পেতে সে দেশের কৃষ্টি কালচার সমাজ সংস্কৃতি অন্য দেশ বা দেশের আগ্রহী মানুষ গ্রহণ করবে, জানার চেষ্টা করবে, শিখার প্রয়াস চালাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, দ্বিমত নেই, অসুবিধাও নেই। দ্বিমত হলো সেখানে, যেখানে আপন সত্তা ভুলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে বি-সত্তায় আর সে হুমড়ি খেয়ে পড়াকে নজরহীনভাবে পাশ কেটে যায় সে দেশের কর্তামহল। কথায় বলে ছাড়া গরু দৌড়বে, কিন্তু রাখাল তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে তার কৌশলে। প্রজন্মের কথা যদি বলি, এরকমই বলতে হয়। তবে এ কথা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। অনুভূতি, প্রেম, ভালবাসা, দায়-দয়িত্ব, কর্তব্য বলতে গেলে প্রায় সব কিছুই মানুষ দেখাদেখি শেখে। যে তরুণ-তরুণী প্রেমে পড়ছে তারাও অগ্রজ কাউকে না কাউকে দেখে, কোনো না কোনো মাধ্যমে বুঝে তার প্রক্রিয়া শিখেছে। আপনা থেকে বা গায়েবিভাবে কেউ কিছু শিখে না। আমাদের নবীন প্রজন্মকে অগ্রজরা শেখাতে হবে। তারা যদি সন্ন্যাসীবেশ নেন, তবে কে আর পথ দেখাবে? প্রবীণরাই তো নবীনদের মধ্যে অনুভূতির বীজ বুনে দেবেন ধীরে ধীরে কৌশলে। ব্যক্তিত্ত্ব সত্তা তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব বড়দের, দায়িত্বপ্রাপ্তদের। আজকের যে শিশু, আজকের যে কিশোর সে কোথা থেকে জানবে একুশ কী? সে কোথা থেকে বুঝবে ফেব্রুয়ারির মর্মকথা? তার মধ্যে কী করে প্রেম জাগবে? সালাম রফিক জব্বার কারা সে তা কোথা থেকে শুনবে? সে তো সংগ্রাম দেখেনি, যুদ্ধ দেখেনি, ত্যাগ দেখেনি, দাউ দাউ পুড়ে যাওয়া গ্রাম-নগর দেখেনি, তবে সে কেমন করে যা দেখেনি তার প্রতি অনুরাগী হবে, প্রেমময় হবে, ভালবাসায় ব্যথিত হবে? যে শিশুটি তার মা’কে অসুন্দর বাংলায় বা মিশ্রিত বাংলায় কথা বলতে শোনে, যে কিশোর তার বাবাকে স্টারপ¬াস বা ডিসকভারি দেখতে দেখে সারাক্ষণ, সে কী করে শিখবে আঁধার আর আধারের পার্থক্য, নীচ আর নিচ-এর পার্থক্য? তার কী করে আগ্রহ জন্মাবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি. . .র প্রতি? সে তো বিদেশি ভাষা আর কৃষ্টিতে বেড়ে উঠবেই। তাকে আমরা দোষ দেবো কোন্ বিচারে?

এতো গেল শিখার আর জানার ধারা। জেনেও যখন ভুল ব্যবহার আর উদাসীনতায় বেয়ে চলে রাঘব বোয়াল আর পুঁজিবাদি মনোবৃত্তির ইঞ্জিন নৌকা তখন কী বলার থাকে? কাকেই বা বলা যায় সে কথা? আমাদের সমাজে দেশে এখন একটি শ্রেণি দাঁড়িয়ে গেছে যারা বাংলাকে প্রায় অস্বীকারের পর্যায়ে এনে ঠেকিয়েছে। তারা কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বিরক্ত হন। তারা শত শত উক্তি আর যুক্তি পকেটে ভরে রাখেন বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনিয়মের পক্ষে। যার যেমন ইচ্ছে তেমন বলছেন, লিখনে, ব্যবহার করছেন। তাদের দেখার যেন কেউ নেই বাংলায়। রব সরব হলে কর্তাদের টনক নড়ে। নড়ে তারা নিজেরই নরম হয়ে যান কেন বা কী করণে তা ভূতে বলতে পারবে। আমরা বলতে গেলে তেড়ে আসতে পারে নেকড়ে। এসবের মধ্যে চোখ এড়ায় না অনিময়ের ইচ্ছেপূরণে। পথে ঘাটে অফিসে আদালতে চলতে গেলে হাজার হাজার অপব্যবহৃত বাংলা চোখে পড়ে। চোখে জল আসলেও কে শোনে কার কথা! এখনো আমরা বাংলা একাডেমিকে অনেক কাগজে অ্যাকাডেমি লিখতে দেখি। সুপ্রিমকে সুপ্রীম ঝুলে থাকতে দেখি বড় বড় আইনজ্ঞদের ফটকে, দরজায়। কখন কী পরিববর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হচ্ছে তার খোঁজ যেমন কেউ রাখছি না, তার খোঁজ কেউ সঠিক নিয়মে দিচ্ছেও না। া, -িকার, ী-কার-সব নিয়ে তো এক অরাজকতা আছেই। তারপরও এই ভাষার উচ্চারণ নিয়ে রয়েছে কত না তেলেসমাতি। আরেক শ্রেণি তো আমাদের ভাষাকে দেখিয়ে দিচ্ছে দশ-হাত। জানি না কতটুকু যৌক্তিক আর কতটুকু অযৌক্তিক তবে তারা পাঁচ মিশালিতে ভরিয়ে তুলছে আমাদের কর্ণ। এর পক্ষেও রয়েছে হাজার মত। বলছে ভাষা তার নিজ গতিতে চলবে। . . .চলবে সত্য। কিন্তু অচল যে হচ্ছে বা একটি কৌশল যে অচল করার চেষ্টায় রত তার খবর কে রাখছে? লিখতে অনিময় হচ্ছে, বলতে অনিয়ম হচ্ছে, আবেগে অনুভূতিতে অনিয়ম হচ্ছে, এতসব অনিয়ম কেন চলছে? কারা চলতে দিচ্ছে? আজও আমাদের কোনো নিয়ম নেই, যে সঠিকভাবে বাংলা ভাষা বলতে লিখতে ও ব্যবহার না করলে তার দ-ভার বহন করতে হবে। প্রত্যেক অনিয়মেরই তো দ- হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনিময়ের কেন দন্ড হয় না? কেন এর সঠিক দেখভাল হয় না? কেন একে গুরুত্ব দেয়া হয় না? যে ভাষার জন্য এতো প্রাণ গেল সে ভাষার এমন করুণ দশা কারা করলো, কাদের ঔদাসীন্যে এমন হলো, তা কি কেউ প্রশ্ন করেছে কখনো? অতল কি খুঁজেছে তার? লিখতে পড়তে বলতে ব্যবহার করতে এই অবহেলা বাড়তে বাড়তে ঝাপসা আলোয় নামা বাংলায় একদিন যদি কারালগ্রাস নেমে আসে তবে আমরা কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? আমাদের মায়ের ভাষা, মাতৃভাষার রূপ যদি আমরা নিজেরাই ম্লান করে দেই আমাদের স্বার্থের লালাসায় সে কলঙ্ক কার হবে?

এটি যুগের দাবি কিনা জানি না। সময়ের বিবর্তনের প্রতীক কিনা জানি না। সব দেশে, সব কালে এমন হয় কিনা জানি না। তবে ব্যক্তিগত মত থেকে বলতে পারি, হয়তো হয়। যে রাত দেখেনি সে রাতের সম্পর্কে আগ্রহী হবে না, যে দিনের আলো দেখেনি সে দিনের আলো সম্পর্কে আগ্রহী হবে না এটাই বাস্তব। যারা আলো দেখেছেন, যারা রাত দেখেছেন, যারা জানেন দেশমাতৃকার ইতিহাস, যারা এর শেকড়ের সাথে আবদ্ধ, যারা এর মূল জানেন কানায় কানায়, যারা দেশ-রাষ্ট্র-জাতি জাতীয়তা রক্ষায় নিয়োজিত তারা চতুর চোখ রাখবেন চারপাশে। তারা জাতি ও জাতীয়তা রক্ষার পক্ষে বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষার ব্যবহার ও এর অপব্যবহারের দিকে নজর দিয়ে তা রোধ করার চেষ্টায় রত হবেন, এটা আমরা আশা করতেই পারি। অনেক সময়ই কেবল ব্যক্তি খেয়ালে অনেক কিছুই রক্ষা বা সংরক্ষণ করা যায় না। অনেক সময় অনেক কিছুতেই বাধ্য করতে হয় বিরাট জনগোষ্ঠীকে। ওই যে বলেছি, ছাড়া গরু, কথাটি নেতিবাচক ভাবে না নিয়ে ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে মুক্ত মানুষকে বিধি নিষেধের মাধ্যমে শৃঙ্খলায় আনতে হয় অনেক সময়ই। ইদানিং আমরা দেখি, বাংলা একাডেমি ভাষার ব্যবহার ও বানান রীতি নিয়ে বেশ কর্মযজ্ঞে আছেন। এই উদ্যোগ অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তবে তা প্রচার ও প্রসার করতে হবে। একটি নিয়ম চালু করে বা পরিবর্তন করে ঘরে বসে না থেকে তা কী করে অল্প সময়ে প্রচার ও প্রসার করানো যায় তার দিকেও খেয়াল দিতে হবে। শুরু করতে হবে গাছের আগা থেকে নয়, শেকড় থেকে। স্কুল পর্যায় থেকে জানিয়ে দিতে হবে এ পরিবর্তনের আধুনিক নিয়ম। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিতদের হাতে একাডেমিকে নিজ থেকে তুলে দিতে হবে কর্মপ্রণালী। যখন যা পরিবর্তন হয় তখন তা গণমাধ্যমের সহায়তায় জানিয়ে দিতে হবে বিশাল জনসাধারণকে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যারা আছেন তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া আরও আধুনিক করে তা ব্যবহার করতে হবে। সরকারের কর্তাব্যক্তি বা দায়িত্বরত ব্যক্তি যারা তারা নিজেরাও আরও সচেতন ও কর্মঠ হয়ে উঠবেন তা আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি। না হলে বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষার ব্যবহার কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা মুশকিল। এখন এই অত্যাধুনিক যুগেও আমরা বড় বড় বিলবোর্ডে, টিভির পর্দায়, দৈনিকের পাতায়, সরকারি নথিতে এমন কি এই অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় চোখে পড়ার মতো শব্দের ভুল বানান আমাদেরকে ব্যথিত বৈ আনন্দিত করতে পারে না কোনো ভাবে।

আশা করতে পারি, আগামীতে এই শহরে একটি বিলবোর্ডে ভুল বানানে বা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মতো বহুল প্রচারিত টিকিটে ভুলভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামটি ভুলভাবে হলেও প্রকাশ করলে তার উত্তম শাস্তি বা বিচার বিবেচনা নির্ধারিত হবে ক্ষুদ্র সময়ে। আশা করতে পারি, টিভির পর্দায় অসুন্দর বাংলা ব্যবহারকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে সংশোধনের চেষ্টা থাকবে তাদের, যাদের ওপর বাংলা ভাষা প্রয়োগ ও ব্যবহার দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত আছে। তারা দেখভাল করবেন বহুল প্রচারিত মাধ্যমগুলোর অসচেতন প্রকাশ ও গুরুত্ব পাশ কাটিয়ে প্রচারের দিকেও। ক্ষুদ্র হলেও বাংলা ভাষাকে ব্যবহারে অসম্মান করাকে অপরাধের দৃষ্টিতে নিয়ে তার বিহিত করার উপায় বের করবেন পরিদর্শকেরা আমরা সেটা কামনা করতেই পারি। সেই সাথে বলতে পারি, অন্য ভাষা অন্য কালচার শিক্ষার জন্য, কখনো কখনো পেশার জন্য আয়ত্ত করবো, করতে পারি কিন্তু আমরা আমাদের যে সত্তা, আমাদের যে ভাষা, আমাদের যে বৈশিষ্ট্য, আমাদের যে নিজস্বতা, আমাদের যা ছাড়া চলে না, মায়ের ভাষা- মাতৃভাষাকে যেন আমরা অপমান না করি। আমরা যেন এই ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি, আমাদের নিজেদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করি। আমরা যেন আমাদের যা নিজের তা বিশ^ দরবারে আমাদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উঁচু করে তুলে ধরি। অবহেলা করতে করতে এক সময় হেলায় হারালে তা আর ফিরে পাওয়া সহজ হবে না। তখন আর আমি বা আমিত্ব বলেও কিছু থাকবে না। তখন হায় হায় করা ছাড়া আমাদের পক্ষে কোনো পথই খোলা রবে না চোখের সামনে। এমনটি হবার আগেই আমাদের ফিরে দেখা উচিত আমাদের বাংলা ভাষা ও ভাষার ব্যবহার কোথায় এসে পৌঁছেছে। সে তুলনা করে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া ব্যক্তি পর্যায় থেকে সরকারি পর্যায় পর্যন্ত ভেবে দেখা দরকার। শুভ হোক বাংলা, বাংলা ভাষার। এ প্রত্যয় বাংলা ভাষা-ভাষী হিসেবে আমাদের।

জোবায়ের মিলন : বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি, ঢাকা। সেল : ০১৯১৪০২৩১৭৭

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়