রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

আমার দেখা ভাষা আন্দোলন
মিজানুর রহমান চৌধুরী

চাঁদপুরের ‘সূর্যসন্তান’ নামে খ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী ‘রাজনীতির তিন কাল’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন ২০০১ সালের জানুয়ারিতে। এ গ্রন্থের ‘নতুন জোয়াল : আর এক উপাখ্যান’ অধ্যায়ে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যা লিখেছেন তা ‘আমার দেখা ভাষা আন্দোলন’ শিরোনামে চাঁদপুর কণ্ঠের ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরপূর্তির আজকের বিশেষ সাময়িকীতে সংক্ষিপ্তভাবে পত্রস্থ করা হলো :-

মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় গঠিত হয় অধিকার-সচেতন সংগ্রামী ছাত্র সমাজের একক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর আহ্বায়ক হলেন নাঈমউদ্দিন আহমদ। এ সংগঠনই ছিলো বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার। আমি তখন কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। তাছাড়া ছাত্রত্বের অবসানও তখন আমার হয়নি। মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ আমাকে আলোড়িত করলো। আমি যোগ দিলাম এতে।

আমাকে চাঁদপুর মহকুমার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হলো। এ সময় '৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। ওই বছরের মার্চ মাসের ২১ তারিখে জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় আসেন। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমাবেশে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘টৎফঁ ধহফ টৎফঁ ংযধষষ নব ধহফ সঁংঃ নব ঃযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ’. জিন্নাহ সাহেবের এ আকস্মিক ঘোষণায় সারা দেশ হতভম্ব হয়ে যায়। প্রতিবাদী হলো ছাত্র সমাজ। কার্জন হলে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে জিন্নাহ সাহেব একই বক্তব্য দিলে সেখানে ‘ঘড়’ ‘ঘড়’ ধ্বনি উঠলো। স্বল্পসংখ্যক বাদে বাকি শিক্ষিত সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি তুললেন উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এটা তো স্বীকার করা হলোই না; বরং পোস্টকার্ড, এনভেলপেও ইংরেজি এবং উর্দু স্থান পেলো, বাংলা ভাষার কোনো স্থান হলো না। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে গোড়া থেকেই অবিশ্বাস দানা বেঁধেছিলো। এ ঘটনায় প্রমাণিত হলো যে, বাঙালিদের স্বার্থ পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নিরাপদ নয়। পশ্চিমারা দ্বিগুণ উৎসাহে পূর্ব বাংলাকে তাদের শোষণের লীলাক্ষেত্র বানানোর অপপ্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করলো। একটি নতুন রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, সার্বিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- স্বাধীন দেশের নিরিখে পরিচালনা করা-এসব কিছুই ঢাকা থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত হলো। যার বিষময় ফল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আবহমানকাল যে অবস্থায় ছিলো, সেই অবস্থায়ই রয়ে গেলো। পাকিস্তানের রাজধানী করাচি, সামরিক সদর দপ্তর রাওয়ালপিন্ডি, নামে স্বাধীন হলেও পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনিতে পরিণত হলো। সামরিক ও বেসামরিক ব্যুরোক্র্যাসিতে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখ করার মতো কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিলো না। কারণ বাঙালি মুসলমানরা অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে খুব কমই ছিলেন।

পাকিস্তানের দু-একটা শাখা অফিসের মতো শিল্প-বাণিজ্য এবং অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া স্বাধীন দেশের প্রমাণবাহী কোনো কিছুই পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হলো না। ভারত প্রত্যাগত আইসিএসরা সিএসপি হলেন, কলকাতা-বোম্বে বন্দরের পায়ে হাঁটা দালালরা কেন্দ্রীয় সরকারের আনুকূল্যে বৃহৎ শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় বড় ডিল হাতিয়ে নিলেন এবং এগুলোর যে শাখা অফিস ঢাকা-চট্টগ্রামে ছিলো, সেখানেও পূর্ব পাকিস্তানীরা ড্রাইভার, কেরানী, বড়জোর এক-আধটা সোশ্যাল রিলেশন অফিসারের চেয়ে উঁচু পদের কোনো চাকরি পেলো না। এভাবে বাংলাভাষী এবং উর্দুভাষীদের মধ্যে একটা বিরাট দূরত্বের সৃষ্টি হলো, যা ক্রমান্বয়ে দুরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়ালো। সামরিক বাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা ছিলো হাতেগোণা কয়েকজন। সিন্ধু এবং পূর্ব পাকিস্তানের কোটা আড়াই + আড়াই ভাগ অর্থাৎ পাঁচ পার্সেন্ট। আর বাকি শতকরা ৯৫ ভাগ পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের জন্য।

আমরা বাঙালিরা পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি থাকা সত্ত্বেও সশস্ত্রবাহিনীতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব শতকরা মাত্র আড়াই ভাগ। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতেও অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক বাঙালি ছিলেন। ৬০-এর দশকে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী সাহেব কৃষিমন্ত্রী থাকাকালে বাঙালিদের চাকরি দেয়া নিয়ে সচিবের সঙ্গে বাদানুবাদের কারণে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন।

যা হোক, জিন্নাহ সাহেবের ওই ঘোষণার পর থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুরু হয় । ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনেক আগে থেকেই অনুভূত হয়ে আসছিলো। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে দীর্ঘদিন থেকেই এ ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। কবিগুরু রবিঠাকুর তার তিনটি প্রবন্ধে স্বভাবসুলভ ভাষায় বাংলাকে বাঙালিদের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অনেক জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন। প্রবন্ধগুলো হলো-শিক্ষার হেরফের, শিক্ষার বাহন এবং ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ । ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে জ্ঞান তাপস ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঘোষণা করেন, আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা’।

এ যখন অবস্থা তখন অধিকার-সচেতন রাজনীতিকরা আর চুপ থাকতে পারলেন না। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের শামসুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলো। স্বাধীন দেশের প্রথম বিরোধী দল। অনেক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ দলে সমবেত হলেন। একই বছরের ১১ অক্টোবর ঢাকার আর্মানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গভর্নমেন্ট হাউজের দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে ভুখা মিছিল বের করা হয়। '৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গ্রেপ্তার হন। '৫০ সালের পয়লা জানুয়ারি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই স্বাধীন পাকিস্তানে বিরোধীদলীয় কর্মকা- প্রসার লাভ করতে থাকে।

এদিকে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ সাহেব মৃত্যুবরণ করলে খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন।...........

রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্য এবং প্রশাসনে, আইন প্রণয়নে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার উলঙ্গ অপপ্রয়াস অল্প সময়েই সচেতন মানুষ বুঝে ফেললো। এমনি একটা সময়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবার পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। লিয়াকত আলী খান ক্ষমতায় বসার পর শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে বিপিসিবিরোধী আন্দোলন। এ সময় খান সাহেবের কতগুলো উক্তি সাধারণ্যে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে। তিনি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে ‘বিদেশীদের লেলিয়ে দেয়া কুকুর’ বলে আখ্যায়িত করার ধৃষ্টতাও দেখালেন। সোহ্রাওয়ার্দীর অপরাধ তিনি গান্ধীজীর সাথে মিলে সারা ভারতে, বিশেষ করে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বন্ধে কাজ করেছেন। যে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান, সেই মুসলমানদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য কলকাতায় গান্ধীজীর সাথে কাজ করার অপরাধে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব হলেন ভারতীয় দালাল (!), অথচ জিন্নাহ সাহেব তাঁকে পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর পদ পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন, তিনি রাজি হননি। নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান সাহেব একজন আয়েশী প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারাদি সম্পর্কে যা জানা যায় তা এখানে উল্লেখ না করাই শ্রেয়। তবে তিনি ছিলেন তীব্র ভারতবিদ্বেষী, চরম প্রতিক্রিয়াশীল এবং বিরোধী দলের প্রতি তার আক্রমণের প্রচলিত ভাষা ছিলো ‘শের কুচাল দেঙ্গে’ (ঘাড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেবো)।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, লিয়াকত আলী খান সাহেবের আমলে নাকি দেশে সাধারণ নির্বাচনের সময় হয়নি, কারণ পাকিস্তান শিশুরাষ্ট্র। যদি দু-এক বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে পাকিস্তানের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। গণতন্ত্রকে কোনো ফেয়ার

ট্রায়াল করতে দেয়া হলো না। রাজনীতিতে বেসামরিক, সামরিক আমলা, সরকার সৃষ্ট পুঁজিপতি-এ তিন অপশক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে একটা ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যুদয় সম্ভব হলো না। শুরু হলো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, যার বলি হলেন লিয়াকত আলী খান নিজেই। লাহোরে এক জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। তবে নিরাপত্তায় নিয়োজিত কোনো একজনের গুলিতে আততায়ীও নিহত হলো। ষড়যন্ত্রের মূল হোতা বের করা সম্ভব হলো না।

বাঙালিদের মধ্যে যারা মুসলিম লীগ করতেন, তাদের সবাই যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধামাধরা ছিলেন এমনটা নয়। কেউ কেউ সব অঞ্চলের স্বার্থ বজায় রেখে একটা ফেডারেল কাঠামোর পাকিস্তান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে অল পাকিস্তান মুসলিম লীগ কনফারেন্সে সোহ্রাওয়ার্দীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান দাবি ছিলো বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা দেয়া। এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনে ছাত্র সমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো। মজার ব্যাপার হলো, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী খোদ ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কথা বললে অনেক সময় ঢাকার উর্দুভাষাভাষি আদি বাসিন্দাদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হতো। এককালে মোগলদের নিযুক্ত আমলা এবং পরবর্তীকালে ইংরেজদের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার নবাবদের প্রভাবে ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা (সাধারণভাবে যারা ‘ঢাকাইয়া হিসেবে পরিচিত), উর্দু-পার্সির সঙ্গে বাংলাকে মিশিয়ে একটা খিচুড়ি উর্দুভাষা ব্যবহার করতেন। বাংলাভাষাকে এরা মুসলমানদের ভাষা বলে মনে করতো না। স্থানীয়ভাবে ঢাকায় এ ‘ঢাকাইয়া’ শ্রেণীর বিরোধিতার কারণে অতি সংগোপনে ও সুকৌশলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রচার কাজ চালাতে হতো। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান পরিষদেও ভাষার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি আসে। মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশসহ কয়েকজন বিধায়ক এ প্রশ্নে বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করলে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ সদস্য খান সাহেব ওসমান আলীকে তার নারায়ণগঞ্জের বাসায় দৈহিক নির্যাতন চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা, মুসলিম লীগ সরকারের কোনো কর্মকা-ের বিরোধিতাকে সে সময় রাষ্ট্রের প্রতি বিরোধিতা বলা হতো এবং সেই বিরোধী কণ্ঠকে ভারতের দালাল হিসাবে আখ্যায়িত করা হতো। আশ্চর্যের ব্যাপার, অখ- ভারত থেকে পাকিস্তান ছিনিয়ে আনার জন্য যাদের অবদান সর্বাধিক, যাদের অবদানের ফলে পাকিস্তান অর্জিত হলো, সেই নেতৃত্বকেই সরকারের বিরোধিতা করার কারণে ভারতীয় অনুচর বলে চিহ্নিত করা হতে লাগলো। একজন রাজনীতিকের জন্য এর চেয়ে বড় অবমাননাকর গ্লানি আর কী হতে পারে? এটা বোধহয় কোনো কোনো রাজনীতিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে ভিনদেশী দালাল বলা, কুচক্রী বলা আর ধর্মীয়ভাবে বিরোধীদের কাফের বলার ট্রেডিশন আজো চলছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত জনগণের বিচারে অর্থাৎ জনগণের রায় দেয়ার সময় যখন আসে তখন দেখা যায় আসল কুচক্রী কারা-১৯৫৪ সালের নির্বাচন সেটাই প্রমাণ করে।

যা হোক, ভাষা আন্দোলন ক্রমেই শহর থেকে গ্রামের নিভৃত অঞ্চলে পৌছুতে শুরু করে এবং মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে দেশের সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রবন্ধকারসহ সবাই (দু-চারজন বাদে) যার যার সাধ্যমতে কাজ করে যেতে লাগলেন। এতে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে জোরালো জনমত সৃষ্টি হলো। আন্দোলনও দিনে দিনে তীব্র হয়ে উঠতে থাকলো। এর ধারাবাহিকতায় ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা বাংলা ভাষার পক্ষে মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে শহীদ হন। সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশব্যাপী গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা বাঙালি সমাজকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, তারা ভাবতে শুরু করলো, পাকিস্তানি শাসক, শোষক এবং তাদের এদেশীয় অনুচরদের হাতে বাঙালির স্বার্থ নিরাপদ নয়। শহীদদের স্মরণে আজকের মেডিকেলের পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলো। কিন্তু শহীদ মিনার নির্মাণের পাঁচ দিনের মাথায় ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তা গুঁড়িয়ে দেয়।

২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলন দমনে সরকার নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। সারা দেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতার করা হতে থাকে। আন্দোলনকারীদেরকে ভারতীয় অনুচর বলে আখ্যা দেয়া হয় । ২ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন, ভারতীয় অনুচরেরাই এ নির্মম হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত।' সরকারি নির্যাতন ও অপপ্রচারে আন্দোলনে সাময়িক ভাটার সৃষ্টি হয় । (সংক্ষিপ্ত)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়