প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
॥ এক ॥
ভাষা হলো এক নদীর মতন
কল্ কল্ বোলে চলে
ভাষার বাহনে মনের ভাবেরা
বিকশিত দলে দলে।
ভাষা হলো মনে শেকড়ের টান
মায়ের নাড়িতে বাঁধা
ভাষার বাগানে কথার ফুলেরা
ফোটে লাল গাঢ় সাদা।
ভাষা হলো প্রাণে জীবনের গান
বাবার ঘামের ঘ্রাণে
ভাষার জমিতে কনক ধানেরা
ফুটে ওঠে অঘ্রাণে।
আমার ভাষার বর্ণমালারা
পলাশ-শিমুলে রাঙা
ফেব্রুয়ারিতে ভাষার কলিরা
মালঞ্চ করে চাঙা।
ফাগুনের রঙে রাঙানো একুশে
ভাষার আকুতি শুনি
বাহান্ন হতে নিজের শোণিতে
ভাষার স্বপন বুনি।
॥ দুই ॥
দুই জাতিতে বিভেদ হয়ে
বিভেদ হলো ভূমি
ভারত এসে কাঁদছি আমি
পাকিস্তানেই তুমি।
আমার ভিটে আমার মাটি
পূর্ব পাকিস্তানে
তোমার স্বজন কোলকাতাতে
কোথায় তা কে জানে!
বিভাজনের পরের সালে
জিন্নাহ্ দেখায় খেল্
উর্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা
বাংলা তবে ফেল!
পিচঢালা পথ তপ্ত হলো
নামলো বীরে পথে
বাংলাভাষার বীর সেনাদল
জাগলো শতে শতে।
সেই জাগরণ আনলো শেষে
বাহান্নেরই ভোরে
বাংলাভাষার রক্তনিশান
আকাশনীলে ওড়ে।
মায়ের ভাষা রক্তদামে
কেনার ফলশ্রুতি
ভাষাবীরের অগ্নিসেনার
বিরল আত্মাহুতি।
ফেব্রুয়ারি ভাষার মাসে
শোকের সাগর ডাকে
শহীদ-মিনার বেদী হতে
রিক্ত বুকের মাকে।
॥ তিন ॥
ভাষার জন্যে শেখ মুজিবও
লড়লো সেদিন রাজপথে
রক্তরাঙা ফাগুন ছিল
সত্তর সাল আজ হতে।
ভাষার জন্যে লড়াই হলো
জিন্নাহ্ দিলো ঘৃতাগ্নি
সেদিন হতে পাকিস্তানের
উঠলো জ্বলে চিতাগ্নি।
বীর বাঙালি ছাত্রীদিদি
তারাও এলো রাজপথে
জ্বললো আগুন দাবানলের
মাতৃরূপের সাজ হতে।
আটচল্লিশ বীজ রুয়ে দেয়
বাহান্নতে ফল ধরে
সেই ফলেরই ঘ্রাণের ঘোরে
মায়ের চোখে জল ঝরে।
সেদিন যারা বাংলা ছেড়ে
উর্দু-প্রেমে ডুবছিলো
আজকে দেখে যায় না বোঝা
তাদের কেমন রূপ ছিলো।
আজকে ভাষার মহান মাসে
জোর গলাতে বলতে হয়
শহীদানের স্বপ্নমালা
সত্যি হয়ে ফলতে হয়।
॥ চার ॥
ভাষার জন্যে জীবন মরণ
ভাষার জন্যে প্রেমে
ভাষার জন্যে রাজপথে সব
আসলো সেদিন নেমে।
পথচারীদের মিশে গেছে পথ
রক্তগাঙের ধারায়
মহাকালেরই সাগরের জলে
ভাষার সে ¯্রােত হারায়।
বরকত আর রফিক-সালাম
ইতিহাসে হলো তারা
তাদের আলোয় আমাদের পথ
আটকেনি শংকারা।
চুয়ান্ন সালে পাকিস্তানীরা
মেনেছে ভাষার দাবি
উর্দুর সাথে বাংলা পেয়েছে
রাষ্ট্রভাষার চাবি।
ছাপ্পান্নতে শাসনতন্ত্রে
সাফ সাফ লেখা থাকে
বাংলাও সম রাষ্ট্রভাষার
সুবাস শরীরে মাখে।
ওরা চেয়েছিলো আমাদের থেকে
কেড়ে নিতে রবি কবি
আমরা বলেছি তখন থেকেই
রবিতে বাঁচবো সবি।
ভাষা হলো এক শক্তি-সাগর
ভাষা হলো হাতিয়ার
ভাষাকে আগলে রাখে যারা, পিছে
থাকে না সে জাতি আর।
॥ পাঁচ ॥
মায়ের ভাষায় বিদ্যা নিতে
যে বা যারা রাজি নয়
কেমনে বলি এসব কিছু
দেশদ্রোহী কারসাজি নয়?
যে বা যারা ছড়ায় গুজব
বাংলা ¯্রষ্টা শোনে না
কেমনে বলি তাদের মাথায়
শয়তানে বীজ বোনে না!
যে বা যারা ভাবেন কেবল
বাংলা ভাষায় ধর্ম নয়
জেনো তারা ধর্মবাণীর
বুঝলো কোন মর্ম নয়।
মায়ের ভাষায় বিজ্ঞানে পাঠ
রক্তে যাদের ঢোকে না
বলবো তারা উন্নতদের
দেখে মোটেই চোখে না।
আইন-আদালত থানা-পুলিশ
ডাক্তারখানার চেম্বারে
বাংলাভাষার প্রচলনে
জনগণের জ্ঞান বাড়ে।
মনে-মুখে সবখানে হোক
বাংলা ভাষায় চর্চা সব
যাদের মুখে বিদেশি বোল
প্রমাণ হবে পর-ছা সব।
॥ ছয় ॥
ভাষার জন্যে শহিদ কারা
সঠিক সংখ্যা জানি না
পাঁচজনকে চিনি-জানি
আর বাকিদের মানি না।
একুশের যে প্রথম কবি
মাহবুুব লেখে চল্লিশজন
পরের দিনের পত্রিকা কয়
ছাব্বিশই হয় নির্বাপণ।
বাংলাদেশের তাজের ডায়রি
বললো শহিদ হয় বারো
নয় মরেছে অকুস্থলে
পাইনি হদিস আর কারো।
এম আর মুকুল বললো শেষে
শহিদ হবে হয়তো নয়
নিজের লেখায় মুকুল ফোটায়
নয় জনেরই পরিচয়।
কেউ বলেছে ছয় মরেছে
রাষ্ট্র ধরে নিলেন পাঁচই
দুহাজারে পাঁচ জনারে
একুশ-পদক দিয়েই বাঁচি।
ভাষার জন্যে শহিদ ক’জন
সেই হিসেবে থাকুক ফাঁক
একুশ নিজে ফিরিয়ে দেয়
সবার মুখে মায়ের ডাক।
॥ সাত ॥
ভাষার জন্যে রক্ত দিয়ে
সেদিন যারা মিনার হলো
ভাষার মিনার গড়তে গিয়ে
সইলো যারা ঘৃণার জলও
তাদের জন্যে ফেব্রুয়ারি
তাদের জন্যে ভাষার মাসে
গাছের শাখায় ফুল বাহারি
কৃষ্ণচূড়া-পলাশ হাসে
তাদের জন্যে রাজপথে আজ
আল্পনাতে হয় কারুকাজ
তাদের জন্যে বুকের ভেতর
বর্ণমালার শুনছি আওয়াজ।
ভাষার জন্যে সেদিন যারা
খেয়েছিলো পুলিশ-তাড়া
তাদের জন্যে ফুলের ডালি
প্রভাতফেরি হৃদয়-নাড়া
তাদের জন্যে আজ ফাগুনে
অর্ঘ্য সাজাই কাল না গুণে
তাদের জন্যে দিলাম রুয়ে
স্বপনতরুর বীজ এ ভূঁয়ে
ভাষার মাসে আজ একুশে
মনের গহীন উঠুক ফুঁসে
বর্ণমালার অতুল প্রেমে
আকাশ থেকে আসুক নেমে
বীর শহিদান বীরের ভূমে
বীর শহিদান বীরের ভূমে
আকাশ থেকে আসুক নেমে
আকাশ থেকে আসুক নেমে।
॥ আট ॥
ভাষার জন্যে আমতলাতে
মিটিং হলো সংক্ষোভে
শেষ বিকেলে ক্লান্ত রবির
তেজমাখা লাল রং ডোবে।
ভাষার জন্যে হাসপাতালে
মিটিং হলো মাঘ মাসে
একুশ তারিখ মিছিল নিয়ে
ছাত্র তো নয় বাঘ আসে।
ভাষার জন্যে ছাত্রীরা সব
রাজবন্দির মুক্তি চায়
এ জাগরণ জাগায় আশা
মুক্তো যেন শুক্তি পায়।
ভাষার জন্যে হয় অনশন
কারার ভেতর হয় প্রলয়
ফাগুন মাসের শিহরণে
বইলো মনে জয় মলয়।
ভাষার জন্যে বরকতেরা
রক্তনদীর হয় তরী
ভাষার জন্যে সালাম ভাইয়ের
চক্ষু দুটো হয় ঘড়ি।
ফেব্রুয়ারির জরায়ুতে
যে শিশুটি বাড়ছিলো
আজকে বিশ^ বলছে হেঁকে
সে যে বাংলা মা’র ছিলো।
বাংলা মায়ের এই শিশুটি
বিশ^জুড়ে হয় পালন
মাতৃভাষা দিবস সবার
পবিত্রতায় হোক লালন।