প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
বিশে^ সর্বপ্রথম ন্যায়পাল (ঙসনঁফংসধহ) পদটি ১৮০৯ সালে সুইডেন সংবিধান গ্রহণকালে সৃষ্টি করে। তার উদ্দেশ্য ছিল নাগরিক অধিকারকে প্রশাসনের দুর্নীতি থেকে রক্ষা করা। সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও বিচারকগণ দেশের আইন সঠিকভাবে পালন করছে কিনা, নাগরিকগণ তাদের দ্বারা কোথাও হয়রানির শিকার হচ্ছে কিনা ইত্যাদির ব্যাপারে অভিযোগ তদন্তকারী দপ্তর হিসেবে কাজ করার নিমিত্তেই ন্যায়পাল সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে সুইডেনে ন্যায়পাল সরকারের সকল বিভাগের ওপর অভিযোগ তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে। সুইডেনের পথ অনুসরণ করে পরবর্তীতে অনেক দেশই ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করে। ১৯১৯ সালে ফিনল্যান্ডের সংবিধানে, ১৯৫৫ সালে ডেনমার্কে, ১৯৬১ সালে নিউজিল্যান্ডে, ১৯৬৩ সালে নরওয়েতে, ১৯৬৭ সালে ‘ঞযব চধৎষরধসবহঃধৎু ঈড়সসরংংরড়হবৎ অপঃ’ পাশের মাধ্যমে বৃটেনে ন্যায়পাল পদের সৃষ্টি করা হয়। তবে বৃটেনে ন্যায়পাল নামটি গ্রহণ না করে ‘সংসদীয় কমিশনার’ নামে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়াতে এ পদের সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে প্রকিউরেটর (চৎড়পঁৎধঃড়ৎ) পদ্ধতি চালু আছে, যা ন্যায়পালের সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়নের বিধান রাখা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে পদটি রয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োগ আজও হয়নি।
নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রত্যেক দেশের বিচার বিভাগ কাজ করে থাকে। একটি দেশের বিচার বিভাগের অধীনে থাকে আদালত ও বিভিন্ন ধরনের ট্রাইব্যুনাল যা সকল ধরনের নাগরিক অধিকার লংঘন সংক্রান্ত বিষয় নিষ্পত্তিসহ প্রতিকার দিয়ে থাকে। তবুও প্রশ্ন জাগে, আদালত থাকতে ন্যায়পাল কেন। কিন্তু কারণ আছে বলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দপ্তরের (ন্যায়পাল) প্রতি জনগণ আকৃষ্ট। বাংলাদেশের জনগণ এর বাইরে নয়।
আদালত ব্যবস্থা সকল ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তিসহ প্রতিকার দিয়ে থাকলেও প্রায় সকল দেশের আদালতগুলোতেই দীর্ঘসূত্রিতা বিরাজ করে আর বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশে^র অধিকাংশ দেশে দেখা যায়, একটি সাধারণ মামলার চূড়ান্ত ফলাফল পেতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। ফলে মানুষ অধিকার লংঘনের যাতনা নিরবে সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। আবার আদালতে মামলা-মোকদ্দমা অনেক ব্যয়বহুল। কোর্ট ফি, বিভিন্ন স্ট্যাম্প ফি, বিভিন্ন দলিলপত্রাদি, সাক্ষী ইত্যাদির সংগ্রহখরচ এবং সর্বোপরি আইনজীবীগণকে মামলার প্রতি পর্যায়ে টাকা দিতে দিতে মক্কেলের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরার অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আদালত সমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র প্রতিকারের ঘোষণা দিয়ে থাকে কিন্তু প্রতিকার দিতে পারে না। প্রতিকার অনেক ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভর করে।
অপর দিকে অনেক সময় আদালত বা কোন ট্রাইব্যুনাল দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে সতর্ক হলেও কিছু কিছু মামলার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাজকর্ম জড়িত থাকে এবং এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের রিপোর্ট, মতামত বা বিভিন্ন কাগজপত্র আদালতে হাজির করার আবশ্যকতা রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে অথবা বাদীকে হয়রানি করার জন্য প্রশাসন কাগজপত্র বা রিপোর্ট দিতে অহেতুক দেরী করে। দেখা যায় প্রশাসনিক কাজকর্মের দ্বারাই সাধারণ মানুষ সর্বাধিক নির্যাতিত হয়। তবে প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ গ্রহণকারী যে সকল সংস্থা রয়েছে যেমন-দুর্নীতি দমন ব্যুরো (দুদক), প্রেসিডেন্ট ইন্সপেক্সন টিম প্রভৃতি, তা স্বাধীন নয়, মূল প্রশাসনের সাথে জড়িত। ফলে এসব সংস্থা কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন প্রশাসনের যে কোনো পর্যায়ে দুর্নীতির খবর পেলে বা অভিযোগ পেলে তদন্ত করে যে কোনো কর্মচারী, কর্মকর্তা বা আমলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়ের ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি প্রয়োজন। অনুমতি না দিলে দুদকের কিছু করার নেই। তাছাড়া দুদক শুধু মামলা দায়ের করতে পারে, দুর্নীতি দমনের জন্যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। সুতরাং দুদকের পক্ষে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। আরও উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দেওয়ানী মামলার কয়েকগুণ বেশি ফৌজদারী মামলা হয়। ফৌজদারী মামলাগুলো সবই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়ের করা হয়। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটগণ প্রশাসনিক অফিসার। প্রশাসনের সাথে জড়িত থাকার কারণে তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার প্রদান তেমন সম্ভব হয় না। তাছাড়া প্রায়ই শোনা যায়, ম্যাজিস্ট্রেটগণ ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে পক্ষপাতদুষ্ট রায় দিয়ে থাকেন।
কাজেই একজন ন্যায়পাল বা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তকারী স্বাধীন কর্তৃপক্ষ থাকলে নির্বাহী-কর্মকর্তাগণ স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না, ম্যাজিস্ট্রেট পক্ষপাতদুষ্ট রায় দিতে পারত না এবং পারবে না, লাল ফিতার দৌরাত্ম্যও কমে যেত এবং যাবে। বিভিন্ন দেশে ন্যায়পাল নিয়োগের ফলে এটাই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ ন্যায়পাল একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন দপ্তর। ইহা কেবলমাত্র সংসদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য, অন্য কারোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। প্রশাসনের যে কোনো পর্যায়ে দুর্নীতির খবর পেলে তিনি তড়িঘড়ি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আদালতগুলো সঠিক রায় দিচ্ছে কিনা, আইন সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি দেখার দায়িত্বও তার। প্রশাসনের যে কোনো পর্যায়ে ন্যায়পালের হস্তক্ষেপের ক্ষমতা থাকে। তিনি প্রতিকার দেয়ার আদেশ দিতে পারেন। কোনো কর্মকর্তা তার আদেশ অমান্য করলে তাৎক্ষণিক উপযুক্ত শাস্তির বিধান থাকে অথবা ন্যায়পাল প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ করতে পারেন। তাছাড়া তিনি পার্লামেন্টেও এ বিষয়ে তার সুপারিশসহ ফলাফল দাখিল করেন। তিনি কোনো দল বা ব্যক্তির ছত্রছায়ায় কাজ করেন না, স্বয়ং পার্লামেন্ট তথা সংসদের তার কাজের মধ্যে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। প্রশাসনের দুর্নীতির ও তার কাজের সকল রিপোর্ট পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। তখন ব্যাপক গণপ্রচার হয়ে থাকে এবং জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনগুলোতেও প্রচার করা হয়। ফলে তার আদেশ অমান্য করার সাহস প্রশাসনের থাকে না। তাছাড়া তার দেয়া রিপোর্ট যেহেতু জনসমক্ষে প্রচার করা হয়, সেহেতু সরকারকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রশাসনকে কলুষমুক্ত রাখতে সদা ব্যস্ত থাকতে হবে বৈকি।
পরিশেষে লক্ষ্য করার বিষয় এবং সচেতন নাগরিকপক্ষ হিসেবে বলতে হয়, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানেই ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়নের বিধান রাখা হয়, কিন্তু ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আইন প্রণয়ন করে এই পদটি সৃষ্টি করতে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ১৯৮০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ‘ঞযব ঙসনঁফংসধহ অপঃ ১৯৮০’ পাস করা হয়। কিন্তু আজ প্রায় ৪২ বছর এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেল অথচ আইনটিকে কার্যকর করা হয়নি। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার হয়তো ক্ষমতা ধরে রাখার তাগিদেই আইনটি কার্যকর করেনি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সকল দল-মত নির্বিশেষে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন করে এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বিএনপি সরকারও ন্যায়পাল পদটি কার্যকর করলোনা, তখনকার বিরোধীদলও আইনটি বাস্তবায়নের জন্য কোন কথা বলে নাই। প্রায় একযুগ এর বেশি সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি (আওয়ামী লীগ) বর্তমান ক্ষমতাসীন দল হিসেবে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি-রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান সরকারকে নীতির প্রশ্নে সমর্থন দিয়ে আসছে। আর তাদের নীতির বিষয় প্রশ্নে ১৯৭২ সনের মূল সংবিধান প্রতিষ্ঠিত করা নয় কি? আর যদি তাই হয় তবে বর্তমান সরকার ন্যায়পাল পদ সৃষ্টিকারী আইনটি বাস্তবায়ন করছে না কেন? তার কারণ হতে পারে, মন্ত্রী-এমপি, আমলা আর দূর্বৃত্তায়নকারীগণের দুর্নীতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করলে প্রশাসনের অচিন্তনীয় দুর্নীতি জনগণের সামনে প্রচারিত হয়ে যাবে এবং সুষ্ঠু, অবাদ-নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে পারে। ফলে পরবর্তীতে নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে। তেমনি বিরোধীদল তাদের আন্দোলন-কর্মসূচিতে এটিকে ইস্যু হিসেবে আনছে না। কারণ ক্ষমতায় গেলে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর বাস্তবায়ন করলে দুর্নীতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ক্ষমতায় থাকা ঝামেলাপূর্ণ হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সরকার ও বিরোধীদলগুলোর লক্ষ্য তাদের চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ করা তথা ক্ষমতায় যাওয়া এবং দুর্নীতি জিইয়ে রাখা।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি-চাঁদপুর জেলা জাসদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক।