প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আজকে আমরা যাদেরকে দক্ষ-বর্ষীয়ান, ঝানু রাজনীতিবিদ বলি তারা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন। তারা একটি কমিটমেন্টের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক আদর্শকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষা স্বীকার করে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আজকের রাজনীতিতে কে কী ভাবে যে সোনার কাঠি রূপার কাঠির পরশে বড় নেতা বা এমপি, মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছেন তা বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ করেই বড় রাজনীতিবিদের তকমা লাগিয়ে কোটিপতি বনে যাওয়াও নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা ঘটলেই দেখা যায়, একেকজন দুর্নীতির মহাদানব। আগে রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনায় যেমন উষ্ণতা বাড়াইতো তেমনি পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রতিষ্ঠার খোরাক জোগাতো। আর এরূপ আলাপ-আলোচনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনমত সৃষ্টি হতো এবং উক্ত জনমত নেতৃত্বের প্রতিফল ঘটতো। কিন্তু আজকালের রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনায় প্রাণ নেই, রসবোধও নেই, আছে শুধু ভোগসংলাপ। এখনকার রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনার বিষয়বস্তু হলো কোন্ মন্ত্রী, এমপি, নেতা-নেত্রীর দুর্নীতির মাত্রা কত? কয়টা বাড়ি, কয়টা গাড়ি (এমনকি কোন্ মডেলের গাড়ি), কোন্ দেশে বাড়ি? আমেরিকা না কি কানাডায়? সিঙ্গাপুর না কি মালয়েশিয়ায় ইত্যাদি।
প্রাচীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ঞযব চড়ষরঃরপং’-এ বলেছেন ‘মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব’। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি সমাজে বাস করে না সে হয় পশু, না হয় দেবতা।’ মানুষ জন্মের পরই সমাজে ও রাষ্ট্রে বসবাস করে এবং সমাজের মধ্যেই একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার গঠন করে রাজনৈতিক দল। কতগুলো গুণাবলির সমন্বয়ে রাজনৈতিক ‘নেতৃত্ব’ শব্দ চয়ন বা বাক্য চয়নটি সংহত। নেতৃত্বে পৌঁছাতে হলে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। সাধারণ কর্মী থেকে এই যাত্রা শুরু। আদর্শের কষ্টিপাথরে শুদ্ধ হয়ে সিঁড়ির একেক ধাপ পেরিয়ে অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে একেকজন রাজনৈতিক কর্মীকে নেতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছতে হয়। এমনভাবে বেড়ে ওঠা নেতারাই দেশ ও জাতির উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু রাজনীতির আঁতুড়ঘরের বাইরে কিংবা টেস্টটিউবে জন্ম নেয়া নেতা এবং পারফিউম-কসমেটিকসের জোরে যারা নেতা বনে যান, তারা রাজনৈতিক পদ-পদবিকে ব্যবসায়িক পণ্যে রূপান্তর করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলেই ব্যস্ত থাকেন বেশি। দেশ ও জাতির চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। কোনো আদর্শিক প্রক্রিয়া ছাড়াই এমপি, মন্ত্রী হওয়ার ‘ভেলকি’ দেখান এই কসমেটিকস নেতারা।
রাজপথ পরিহার করে, আন্দোলন-সংগ্রামে না থেকে, জেল-জুলুমের শিকার না হয়ে, আদর্শ চর্চা না করে কসমেটিকস ব্যবহার করে নিশিরাতে নেতার বাসায় হাজিরা দিয়ে ‘খাম’ বিনিময়ে কিংবা খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়াটাই বেশি সুবিধার। তাই আজকাল আদর্শিক নেতার পরিবর্তে ক্যাডার নেতা কিংবা ব্যবসায়িক নেতারই জন্ম হচ্ছে বেশি। রাজনীতি চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের দখলে। আদর্শহীন ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করলে অবৈধ রোজগারে টাকার ‘কুমির’ হওয়াদের কাছে পদ বিক্রি করে তারা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হন তেমনি ব্যবসায়িক নেতাদেরও সংসদ, মন্ত্রণালয়ে জায়গা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এক সময় না একসময় টাকাওয়ালা ব্যবসায়িক নেতাদের টাকার জোরে আদর্শবান রাজনৈতিক নেতারা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।
রাজনীতির এই বিকৃত-পরিবর্তন আদর্শিক-রাজনৈতিক নেতার পরিবর্তে তোষামোদি নেতার জন্ম দিচ্ছে। এই তোষামোদি নেতারা আবার মাঠের ঘাম ঝরানো কর্মীর পরিবর্তে টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসী বাহিনী লালন করে রাজনৈতিক কর্মীদের দমন করার চেষ্টা করেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ-দখলবাজি, ঘুষবাণিজ্য, লুটতরাজ করে কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এ নেতাদের কাছে আদর্শিক নেতারা অসহায়। ফলে এদেশের বরেণ্য ও ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাদের ইতিহাস চাপা পড়ে যাচ্ছে আজকালকের এ তোষামোদে নেতাদের অনাদর্শিক কর্মকা-ের কারণে। রাজনীতি আজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নিলামে তোলা হচ্ছে পদ-পদবি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পদ কেনার লোকেরও অভাব হয় না। ঘাম না ঝরিয়ে সারাদিন ব্যবসা করে টাকা কামিয়ে কসমেটিকস মেখে রাতের আঁধারে দামি হোটেল-রেস্তোরাঁ বা নেতার আড্ডা খানায় হাজির হয়ে শীর্ষ পদ বাগিয়ে নিয়ে নামের সাথে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক বিশ্লেষণ যোগ করে ব্যবসা করাটাও বেশ মজার। সবাই সম্মানও করে, আবার জি¦-হুজুর করার লোকেরও অভাব হয় না। সবই কসমেটিকস আর টাকার খেলা। এ প্রক্রিয়ায় সামরিক-বেসামরিক আমলারাও বড় বা শীর্ষ রাজনীতিবিদ হতে পারছেন। রাজনীতির এ বেহালদশায় আদর্শ চলে যাচ্ছে জাদুঘরে আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে অনাদর্শিক ব্যবসায়ী, আমলা, ক্যাডার, দুর্বৃত্তায়নদের হাতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা কায়দা করে নানা ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছেন তারাও জানেন, রাজনীতির তাদের জন্যে নিরাপদ চারণভূমি নয়। তাই সময় থাকতে লুটেপুটে খেয়ে নিচ্ছেন তারা। এটাই বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতা বললে অত্যুক্তি হবে না।
ভারত উপমহাদেশে অনেক প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতার জন্ম হয়েছে। যাঁরা দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যেই রাজনীতি করেছেন। ভোগ-বিলাসিতা তাঁদের আদর্শকে স্পর্শ করতে পারেনি। উদাহরণকল্পে বলা যায়, বাংলা ভূমে জন্ম নেয়া শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, যিনি বাংলার ‘বাঘ’ নামে খ্যাত। তিনি কৃষক-প্রজাদরদি নেতা ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র নামে ডাকা হতো। আর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যাঁকে মজলুম জননেতায় ভূষিত করা হয়েছিলো। দিনমজুর, শ্রমিক, গরীব, অসহায় মানুষের অধিকার রক্ষা করার জন্যে তিনি আজীবন আন্দোলন করে গেছেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ প্রায় এগারটি বছর কারাবরণ করেছেন। এদেশের মানুষের স্বাধিকার আদায়ের জন্যে এবং বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র ¯্রষ্টায় মহানায়ক। এছাড়া আরো অনেক নেতার জন্ম হয়েছে এ বাংলায়। তারা একেকজন রাজনৈতিক আদর্শের লালন ও পালনকর্তা ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ চর্চা-কর্মের ইতিহাস বর্ণাঢ্য ও চকচকে স্বচ্ছ। দেশ ও মানুষই ছিলো তাঁদের রাজনীতির উপাদ্য।
ইদানীংকালে তরুণরা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, এটা ভালো। কিন্তু তারা আদর্শহীন রাজনীতিতে দীক্ষিত হচ্ছে। তারা রাজনৈতিক নেতার পরিবর্তে রাজনৈতিক ক্যাডার নামে পরিচিতি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের আদর্শ বাস্তবায়ন না করে কোনো বিশেষ নেতার লোকে পরিণত হচ্ছে।
আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, রাজনীতিতে নষ্ট চরিত্রের লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নানা কৌশলে প্রতারণায় এমনকি প্রকাশ্যে সমাজে দুর্বৃত্তায়ন সৃষ্টি করে চলছে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে এবং হচ্ছে আর দুর্বৃত্তদের শক্তির মহড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজ, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রে বিভাজন-বিবেধ সৃষ্টিকারী এই ব্যবসায়িক, কসমেটিকস ও ভেলকিবাজি রাজনীতিকরা প্রকৃত অর্থেই গণতন্ত্র ও কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রব্যবস্থার শত্রু এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার চিত্র খুবই ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক। তাই তরুণ প্রজন্মের যারা রাজনীতিতে আগ্রহী কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত তাদের কাক্সিক্ষত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বার্থে আদর্শবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি চর্চা করা একান্তভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার : সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা।