প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
চাঁদপুরের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক চিত্র বিশেষ করে ৭১-এর উত্তাল টালমাটাল দিনপঞ্জির কথা বা মুক্তিযুদ্ধকালীন উল্লেখযোগ্য সশস্ত্র যুদ্ধের ওওর লিখিত আকারের কিছু একেবারে ছিল না বললেই চলে। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরপর এক পর্যায়ে যা-ও নেয়া হয়েছিল, অজ্ঞাত কারণে ৭০ এর দশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী এবং ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের সবাইকে সেই উদ্যোগ সম্পৃক্ত করা হয়নি। সবাই সম্পৃক্ত করতে পারলে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস সংরক্ষণ করা যেত।
‘২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাঙালির অত্যাচারের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস...।’ জলদগম্ভীর স্বরে কথাগুলো ইথারে ভেসে আসতেই বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে রেডিওর সামনে গেলাম। শরীরের কোষে কোষে শিহরণ জাগিয়ে তুলে ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরে বর্তমান অবস্থার সাথে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে নেতা আমাদের লক্ষ্য স্থির করে দিলেন। নেতার সে সভায় দলবেঁধে কষ্ট করে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। যাই হোক, সেদিন থেকে ২৫ এর কালরাত্রি পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রমে এক প্রবল জোয়ারের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল।
২৬ মার্চ সকালে ঢাকার খবর শুনে মিশ্র অনুভূতির সাথে সবকিছু পেছনে ফেলে অনিশ্চিতের পথে চলা শুরু হলো। দুর্বলতায় আনমনা হওয়ার পরক্ষণেই নেতার নির্দেশ মনে পড়ায় সব ঝেড়েঝুরে পরবর্তী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওয়াপদার পিকআপ আনিয়ে রেহান মিয়ার দোকান হতে কয়েকটা মাইক ফিট করলাম। অতঃপর চাঁদপুরবাসীকে পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা, নিরস্ত্র মানুষকে আক্রমণের ভয়াবহ চিত্র জানাতে শুরু করলাম। ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিরামহীন ঘোষণায় শহর এবং আশেপাশের এলাকা চষে ফেললাম। সন্ধ্যার পর পাক বাহিনীর চাঁদপুর আসা ঠেকাতে হাজীগঞ্জ গিয়ে বড় পুল দুটির মধ্যে পূর্বদিকের পুলটি ভাঙার জন্যে ৩/৪ টি বাসভর্তি ছাত্রলীগের কর্মী নিয়ে শাবল-কোদাল-খন্তা দিয়ে পুলের উভয় গোড়ার রাস্তা কাটা শুরু করলাম। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।
'চাঁদপুরের মধুর ক্যান্টিন' খ্যাত ওয়ানমিনিট ছিল সেই ১৯৬৫ সাল থেকেই আমাদের অফিস কাম হেডকোয়ার্টার। ওয়ানমিনিটকে ঘিরে সকাল-বিকাল চলত সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং বন্ধু সম্পদ সাহার বদান্যতায় বিনে পয়সায় চা-মিষ্টি-সিঙাড়া। মাঝে মাঝে প্রয়োজনে নগদ অর্থও যোগান দিত সে। এজন্যে সম্পদ সাহাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে ৭১ এর আগেই। ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের পর সামরিক শাসনে প্রতিনিয়ত হয়রানী ও সম্পদের অনুজ চম্পকের মাসাধিককাল হাজতবাসসহ অনেক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তার এ ত্যাগ তেমনভাবে কখনো মূল্যায়িত হয়নি যদিও। ২৭ মার্চ সকাল ৯টায় আম্মা আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জানালেন, সম্পদ তার দোকানের কর্মচারি রাজেশকে পাঠিয়ে আমাকে যেতে বলেছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ওয়ান মিনিটে ঢুকতেই সে আমাকে তার বাসায় নিয়ে দুজন অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। একজন বয়ষ্ক,নাম দীপক চক্রবর্তী। আরেকজন সুরজিত ঘোষাল, কোলকাতার 'যুগান্তর' এর সিনিয়র রিপোর্টার ও ফ্রিল্যান্সার। আলাপে জানলাম, তারা ১৮ তারিখ যশোর-খুলনা-বরিশাল হয়ে চাঁদপুর এসেছেন আমাদের সংগ্রামের অনদি স্পট খবরআসংগ্রহের জন্যে।
দুপুর ১২ টার,দিকে তাদের নিয়ে আমি শহর পরিক্রমায় বের হলাম। আমার বাসার নীচে ওয়াপদার 'চাঁদপুর সিআইপি প্রজেক্ট' এর পরামর্শদাতার লিড শিল্ড ডি লিউর অফিসের ৫০ সিসি ছোট হোন্ডায় আমরা তিনজন ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। বিকেল ৪টায় আনসার ক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ দেখে তারা হতাশ হলেন। বিশেষ করে ৩০৩ রাইফেল ছাড়া আর কিছু না থাকায় দীপকদা বললেন, এসব দিয়ে তোরা পাকিস্তানীদের ঠেকাবি? কোন ধারণা আছে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে? সন্ধ্যার পর হাসান আলী হাই স্কুলের পশ্চিম দিকে হানিফ পাঠানের নেতৃত্বে করা একতলার ছাদে পাক বাহিনীর জন্যে একটা এমবুশ পয়েন্ট দেখতে গিয়ে দীপকদা রীতিমতো হতাশ হয়ে বললেন, এই হাতবোমা দিয়ে ইয়ার্কি না করে চল আমার সাথে। দেখি আগরতলায় তোদের জন্যে কিছু অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা করা যায় কী না। তাদের এ কথায় আমি খুব উজ্জীবিত হয়ে নেতার কাছে নিয়ে গেলাম। পুরাণবাজার মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে। পরিচয় পর্ব শেষে সুরজিতদা সারাদিনের অভিজ্ঞতায় আমাদের প্রস্তুতির দুর্বল অবস্থাকে দাদার কাছে তুলে ধরলেন এবং আমাদের প্রস্তুতি জোরদারে সাহায্যের কথাও দাদাকে জানালেন। সব শুনে দাদা বললেন, ঠিক আছে, তোমরা মুনিরকে নিয়ে যাও,আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সাথে সাথে তিনি টাউন হলে ফোন করে জাফর ভাই এবং লেঃ সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। এমনকি ফেনীতে আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমদকে ফোন করে আমাকে বর্ডার ক্রস করার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্যে বললেন। আমরা টাউন হলে চলে আসলাম। মেহমানদের টাউন হলে না নিয়ে সম্পদের কাছে রেখে আমি জাফর ভাই এবং সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে কথা বলে পরদিন ২৮ মার্চ ভোরে রওনা হওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক করে নিলাম। সিদ্দিক ভাই আমাকে তাঁর এমপিএ-র প্যাডে প্রত্যয়ন পত্র বা পরিচয়পত্র হাতে লিখে দিলেন যা আগরতলায় কাজে লেগেছিল। ফেনীতে রাত ৮ টায় খাজা আহমদ ভাই জীপ নিয়ে আমাদেরসহ বর্ডার এর পথে রওনা দিলেন। ৯ টার মধ্যে আমরা বর্ডারে পৌঁছলাম। আমাদের আউটপোস্টে কেউ ছিল না। বর্ডার ক্রস করতেই ৩/৪ জন অস্ত্রধারী অন্ধকার ফুঁড়ে উদয় হয়ে আমাদের থামাল। খাজা ভাই পরিচয় দেয়ায় তারা সসম্মানে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে নিয়ে গেল। অফিসার খসজা ভাইকে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করলেন। বোঝা গেল তিনি আগেভাগেই খবর দিয়ে রেখেছেন। আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে গেলেন। বিএসএফ এর অফিসার জোয়ানরা আমাদের নিয়ে চেকপোস্টে পৌঁছে রাত ১২ টায় বিএসএফ এর ব্যাটেলিয়ন হেড কেয়ার্টারে রওনা করিয়ে দিলেন। ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার কমান্ডিং অফিসার আমাদের স্বাগত জানিয়ে ভোর ৪ টায় আগরতলা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। দীপকদা আমার পরিচয়সহ চাঁদপুর তথা পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরলেন। ভোরে একজন শিখ মেজর আমাদের নিয়ে আগরতলায় রওনা হন। আগরতলায় ত্রিপুরা সচিবালয়ে ঢুকে ত্রিপুরা সরকারের চীফ সেক্রেটারির কামরায় গেলাম। সেখানে ত্রিপুরা পুলিশের আইজিও উপস্থিত ছিলেন। সিদ্দিক ভাইয়ের দেয়া প্রত্যয়নপত্র পেয়ে চীফ সেক্রেটারি টেবিলের নীচ থেকে একটা ডসিয়ারমতো কিছু বের করে দেখে নিয়ে মাথা নাড়লেন এবং আবারও আমাকে স্বাগত জানালেন। পরে দীপকদা বলেছিলেন যে, সেক্রটারি সত্যতা যাচাই করছিলেন। দীপকদা বিস্তারিত জানিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামের অপ্রতুলতার কথা বলে কীভাবে আমাদের সাহায্য করা যায় তার দাবি জানালেন। উচ্চপদস্থ এই দুই সরকারি কর্মকর্তা মন দিয়ে সব শুনে ঢাকার অবস্থা জানতে চাইলেন। আমি যা জানি সবকিছু বললাম। এ সময় সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজনের কথাও বললাম। তা শুনে উভয় কর্মকর্তা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে আমাকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডযধঃ ধৎব ুড়ঁৎ ৎবয়ঁরৎবসবহঃং ুড়ঁহম সধহ?’ আমি একটুখানি ভেবে আমাদের হাতে থাকা ৩০৩ রাইফেলের চাইতে উন্নত মেশিনগান, মর্টার, কামান চেয়ে বসলাম। আমার কথায় দুজন হেসে বললেন, বোঝা গেল, তোমার এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। এগুলো চালানোর বীঢ়বৎঃরংব আছে তোমাদের? প্রশিক্ষিত জনবল আছে? আমার কোন জবাব ছিল না। ওনারা বললেন, ঠিক আছে, তুমি ফিরে গিয়ে টেকনিক্যাল পারসন যারা এসব বোঝে তাদের পাঠাও। আমি থম ধরে গেলাম। এর মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য চলে আসলে আমরা কী দিয়ে ঠেকাব? দীপকদা সান্ত¡না দিয়ে বললেন, তুই ফিরে গিয়ে আনসার ক্লাবের যে এক্স আর্মি অফিসার বা জেসিও আছে তাদের নিয়ে আয়। আমরা ১২ টায় সচিবালয় থেকে বের হলাম। দীপকদা আমাকে নিয়ে আগরতলার পূর্ব প্রান্তে বিধানসভা হোস্টেলের কাছে এক বাসায় নিয়ে আসলেন এবং বাসার মালিক অনিল ভট্টাচার্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অনিলবাবু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ, কোলকাতায় যুগান্তর পত্রিকাতে পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা আসামের সংবাদদাতা। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক্সেন্টেই কথা বলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে মুহূর্তেই আপন করে নিলেন। পরবর্তীকালে ভারতে তিনিই আমার অভিভাবক হয়ে গেলেন। গৌরি বৌদিও আমাকে প্রথম আলাপেই আপন করে নিলেন।
যাই হোক, প্রথম ধাক্কা শেষ হওয়ার পর আমার ফেরার কথা মনে হলো। সন্ধ্যার আগে বর্ডার পার হতে হবে। আমি ২টার মধ্যে সোনামূড়া রওনা হয়ে গেলাম। দীপকদা আমাকে একা ছাড়লেন না। সঙ্গেই আসলেন। সোনানূড়া রাস্তায় চৌদ্দগ্রামের এমপি অ্যাডঃ মীরু ভাইয়ের সাথে দেখা। আলাপ করিয়ে দিলাম। তিনি কুমিল্লা শহর থেকে এসেছেন। কুমিল্লার কথা বলতেই দীপকদা বলে উঠলেন, দাদা আমি কুমিল্লা যাব।। ব্যবস্থা করে দিন। আমি নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলাম। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট শহর,বিপদ হতে পারে। কিন্তু কোন কথা শুনলেন না। অসম সাহসী দীপক দা। একজন সিনিয়র সাংবাদিক কী রকম সাহসী হন তাকে দেখে বুঝলাম। আমাকে বর্ডারের দিকে কাঠালিয়ার পথে রওনা করিয়ে দিয়ে দীপকদা ও সুরজিত মীরু ভাইয়ের সাথে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন এক সেলুনের দোকানের পাশে। তখন গো আর বুঝিনি, আর কখনো দেখা হবে না। মাত্র দুদিনের পরিচয়ে কত না আপন করে নিয়েছেন!
সন্ধ্যার আগেই বর্ডার ক্রস করে মিয়ার বাজার পৌঁছে গেলাম। ১০ টার মধ্যে লাকসামের কোন একটা বাড়িতে আশ্রয় পেলাম। ৩০ তারিখের মধ্যে চাঁদপুর পৌঁছে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অন্যান্যদের সবকিছু জানালাম। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম এর নেতৃত্বে দুজন সেনাবাহিনীর সদস্যসহ ২৭ জনের একটা দলকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। লেঃ দিদার আমিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ছুটিতে চাঁদপুর হয়ে সন্দীপ যাওয়ার সময় গুরুকে দেখতে এসে আটকা পড়েন এবং আনসার ক্যাম্পের দায়িত্ব লাভ করেন। ৩০ তারিখ আমার মনে অন্য একটি বিষয়ের উদয় হওয়ায় পুরাণবাজার গিয়ে মিজানুর রহমান দাদাকে বলি, চলেন দাদা, আমরা আগরতলায় যাই। আপনার মতো একজন বড় মাপের নেতা গেল সাহায্য পেতে ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে এগুনো যাবে। তিনি দোনোমনা করে বললেন, নেতার খবর জানি না। নেতারও কে কোথায় আছেন তা জানি না। কোন কিছু না জেনে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি জিদ ধরে বললাম, আপনার অবশ্যই যাওয়া দরকার। আপনি দুর্দিনে দলের হাল ধরেছেন, বর্তমানেও আপনার কিছু করণীয় আছে। রীতিমতো জোর করেই নেতাকে আগরতলা যেতে রাজি করালাম। ৩১ তারিখ বড় স্টেশন থেকে ইঞ্জিনসহ একটি বগি আনিয়ে ছোট একটা ব্যাগে দাদার কাপড়-চোপড়সহ দাদাকে নিয়ে সকাল ৯ টায় লাকসামের উদ্দেশ্যে রওনা করি। ১২ টায় নাঙ্গলকোট নেমে ইঞ্জিনসহ বগি ফেরত পাঠাই। মিজান ভাইকে দেখে লোকজন জড়ো হয়ে গেলো। সারাদেশে তিনি জনপ্রিয়। লোকচক্ষু এড়ানো তাই খুবই মুশকিল। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানবেন, মিজান চৌধুরীর মতো বড় নেতা নিয়ে জনতার চোখ এড়িয়ে এগুনো কত কঠিন! ৪ টার মধ্যেই মিয়ারবাজার পৌঁছি। বর্ডার পার হয়ে সন্ধ্যার মধ্যে কাঠালিয়া হয়ে সোনামূড়ার পথ ধরি। রাত ৮ টার দিক আগরতলা রওনা হয়ে ১১ টায় অনিলদার আাসায় পৌঁছি। আমাদের পেয়ে অনিলদা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এতোবড় একজন নেতা তাঁর বাসায়। বৌদির হাতে রাতের খাবার তৈরি হলো এবং তা খেয়ে আমরা অনিলদার ঠিক করা বিধানসভা হোস্টেলে গেলাম থাকতে। মিজান ভাই ও আমি একরুমে ভিন্ন বিছানায় ঠাঁই পেলাম। সকালে ঘুম থেকে জেগে অনিলদার বাসায় যাই। দুপুর ১২ টার দিকে জীপে করে নোয়াখালী থেকে মালেক ভাই, চৌদ্দগ্রামের জহিরুল কাইউম ভাই, নোয়াখালীর নূরুল হক, চট্টগ্রামের জহুর আহমদসহ আরো কয়েকজন এবং খুলনা মহসীনভাইসহ সদলবলে বিধানসভার হোস্টেলে হাজির। অনিলদা সবাইকে নিয়ো বাসায় আপ্যায়ন করালেন। সাথে সাথে বিধানসভা জোস্টেলে কয়েকটা রুমের ব্যবস্থা করে সবাইকে উঠিয়ে দিলেন। আমি অনিলদার সাথেই সারাক্ষণ। তিনি বোধ হয় এ ব্যাপারটা ত্রিপুরা সরকারের কাউকে জানালেন। অনিলদার বাসায় সন্ধ্যার পর নেতাদের সভার ব্যবস্থা হলো। এতো বড় বড় নেতাদের মধ্যে আমার মতো এক সাধারণ কর্মী উপস্থিতিকে স্বপ্ন মনে হয়। সভায় বিস্তারিত আলোচনা হলো। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোসহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় উঠে আসলো। সবকিছু ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেক, কীভাবে আছেন সেই কথাই সভাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। নেতারা কে কোথায় আছেন সে বিষয়ে না জানা থাকায় সভা শেষে কোলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে সহযোগিতা ও ত্রিপুরা সরকারকে জানানোর দায়িত্ব অনিলদাকে দেয়া হলো। অনানুষ্ঠানিক হলেও এ সভার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। অনিলদার আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ আছে। ত্রিপুরা সরকারের একজন মন্ত্রী জনাব মুনসুরউদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হলো যোগাযোগ রাখাসহ কোলকাতা যাওয়ার বিমানে সিট ব্যবস্থা করার জন্যে। ৫/৬ এপ্রিল দুইদিনে নেতাদের বিমানযোগে কোলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। আমি মিজান ভাইকে বললাম চাঁদপুরে ফেরত আসার কথা। তিনি আমাকে তাঁর সাথে কোলকাতা যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশে ৫/৬ তারিখ আমিও বিমানযোগে কোলকাতায় যাই। পাশের সিটে আ স ম আব্দুর রব। গৌহাটিতে যাত্রা বিরতি এবং আসাম সরকারের ভিআইপি স্ট্যাটাসের লাঞ্চের আয়োজন হলো। সন্ধ্যায় কোলকাতা পৌঁছানোর পর দুটো গাড়িতে বিশেষ প্রহরায় শহরে ঢুকলাম এবং কিছুক্ষণ পর ২নং ল্যান্স ডাউন রোডে এক বাড়িতে গেলাম। পরে জানতে পারলাম, তা বিএসএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদারের বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া! নেতাদের অনেকেই, তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, মনসুর আহমেদ, কামারুজ্জামানসহ কে নয়? আমরা বলতে আমিসহ আমার মতো আরও কয়েকজন তখনকার মতো অখ্যাতরা ড্রয়িংরুমে বসা। পাশের বড় একটা রুমে নেতারা সভায় বসলেন। জানা গেল বা কিছুই। রাত ১০ টায় সভা শেষ হলো। সভা থেকে বের হওয়ার পর সবাইকে বিভিন্ন আস্তানায় পাঠানো হলো। মিজান-মালেক ভাই এক জায়গায়। আমার জায়গা আরেক দলের সাথে। রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই, যদ্দুর মনে পড়ে সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, সাইদ সাহেব নামে ঢাকার এক বড় ব্যবসায়ী নেতাদের যিনি ঘনিষ্ট, আমার বয়সী আর একজন জনাব হাসনাত। পরে জানতে পারলাম ইনি সেরনিয়াবাত সাহেবের ছেলে। বঙ্গবন্ধুর ভাগনে। এক রুমে আমরা ৫ জন। তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাই, সাইদ ভাই আলাদা চৌকিতে, আমি এবং হাসনাত বড় এক চৌকিতে, ভাবানীপুরে পিরোজপুরের বিখ্যাত নেতা চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট এক নেতা ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে শুনেছি। এই বাড়ি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। ভবিষ্যতে সময় সাপেক্ষে তা বলবো।
সূচনায় যে কথা বলে শুরু করেছিলাম, সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করতে পারলে অনেক বিভ্রান্তি এড়িয়ে সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসতো। গল্পগাথার ফানুস ওড়ানোর চেষ্টা হোত না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহঙ্কার, গৌরবগাথা যা জেনে আগামী প্রজন্ম বড় হবে, আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাবে। ইতিহাসকে অসত্যের ওপর দাঁড় করালে তা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে ব্যাহত করবে, নড়বড়ে করে দেবে। সঠিক নয় যে তথ্য, তার ওপর শক্ত ভিত তৈরি হবে না। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সোনালি ভবিষ্যত নির্মাণে আগামীতে পথ চলার ভিত্তিই হচ্ছে ৭১ এ অর্জিত বিজয়ের মূল চেতনাকে সমুন্নত রেখে অগ্রসর হওয়া। সত্য এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির এ বছরে এ লক্ষেই দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে হবে।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
মুনির আহমেদ : মুক্তিকালীন সক্রিয় ছাত্রনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।