প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
২২ ডিসেম্বর ১৮৮৭, তৎকালীন মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে এক অজ পাড়াগাঁয়ে গণিতের বিস্ময় বালক শ্রীনিবাস রামানুজন (ঝৎরহরাধংধ জধসধহঁলধহ)-এর জন্ম। বালক বললাম কারণ, বালক বয়সেই গণিত বিষয়ক কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া বিস্ময়কর সব কাজ করে বিশ্বের সেরা গণিত গবেষককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
একটি স্কুল বা একজন শিক্ষক পৃথিবীর অনেক মানুষকেই বিখ্যাত করেছেন, এই ইতিহাস পৃথিবীতে আছে। কিন্তু একটি বইও যে একজন মানুষকে অনুপ্রাণিত করে পৃথিবীর মানুষকে চমকে দেওয়ার মতো বদলে দিতে পারে তার সাক্ষাৎ উদাহরণ হলেন শ্রীনিবাস রামানুজন।
রামানুজনের বাবা কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন। অত্যন্ত অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। রামানুজনের বয়স যখন ৫, তখন তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। বাসা বদলানোর কারণে তাকে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বদলাতে হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৯৭ সালে রামানুজন গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। পরের বছর ১৮৯৮ সালে তিনি মাদ্রাজ থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরের এক স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময় স্কুলের সকল বিষয়েই ভালো করার সাক্ষর রাখেন। তখনো গণিতের প্রতি তার আলাদা আকর্ষণ তৈরি হয়নি।
তার বয়স যখন ১৫ তখনই তিনি একটি বই হাতে পান। ‘ঝুহড়ঢ়ংরং ড়ভ ঊষবসবহঃধৎু জবংঁষঃং রহ চঁৎব ধহফ অঢ়ঢ়ষরবফ গধঃযবসধঃরপং’ বইটি লিখেছেন জর্জ সুব্রিজ কার (এবড়ৎমব ঝযড়ড়নৎরফমব ঈধৎৎ)। এই একটি বই তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আনে। বইটিতে গণিতের হাজারেরও বেশি থিওরি যার অধিকাংশের কোনো সমাধান ছিল না আর যেগুলোর সমাধান ছিল সেগুলোও খুবই সংক্ষেপে।
এই একটি বই তাকে গণিতপ্রেমী বানিয়ে দিয়েছিল। রামানুজন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। ততদিনে গণিতের প্রতি প্রেম তাকে অন্য সকল বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি।
শ্রীনিবাস রামানুজন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের বিখ্যাত অধ্যাপক গডফ্রে হার্ডিসহ আরও অনেকের কাছে চিঠি পাঠান। অধ্যাপক হার্ডি তার কিছু কাজ দেখে বিস্মিত হয়ে তাকে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন।
মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই জটিল। মস্তিষ্ক হলো অসংখ্য নিউরন এক্সন (অীড়হ) দ্বারা সংযুক্ত নেটওয়ার্ক। যখন মানুষ একটি বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা করে তখন ব্রেইনের একটি নির্দিষ্ট অংশের নিউরন (স্নায়ু কোষ) একসঙ্গে জ্বলে উঠে। এই নিউরনগুলো যতবেশি বার জ্বলবে নেটওয়ার্কের কানেকটিভিটি ততই জোরালো হয়ে নিউরনগুলোর গড় দূরত্ব কমিয়ে আনেবে। তার মানে সে স্নায়ু কোষগুলো মিলে একটি ছোটখাট পৃথিবী তৈরি করে। এভাবে যতবার সে নেটওয়ার্ক উদ্দীপ্ত হবে, ততবেশি নেটওয়ার্কটি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
অনুশীলন মানুষকে নিখুঁত করে তোলে। এই কথার সেরা উদাহরণ হলো আমাদের মস্তিষ্ক। আর মস্তিষ্ককে অলস রাখলে নেটওয়ার্কের কানেকটিভিটি দুর্বল হতে থাকে। নিউরো সায়েন্সের ভাষায়, মস্তিষ্ককে যতবেশি ব্যবহার করা হবে, মস্তিষ্ক ততবেশি সক্রিয় থাকবে, অন্যথায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।
জর্জ সুব্রিজ কারের সেই বইটি সম্ভবত মস্তিষ্কের যেই অংশ গাণিতিক কাজে ব্যবহৃত হয় সেই অংশ এত বেশি এবং এত তীব্রভাবে জ্বলেছে যে, ওই অংশের নেটওয়ার্কটি ম্যাজিক্যাল পাওয়ার অর্জন করে ফেলে। এই পাওয়ার দিয়ে তিনি একা একা গণিতের অসাধারণ সব সমস্যা এবং থিওরির সমাধান করতে থাকেন।
কোনো চাকরি ছাড়া, একবারে দরিদ্র অবস্থায় থেকেও রামানুজন গণিতের ওপর কাজ চালিয়ে যান। ১৯০৯ সালে রামানুজন একটা স্থায়ী চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন। সেইসময় সরকারি চাকুরীজীবী রামচন্দ্র রাও তার গণিতের ওপর দক্ষতা দেখে খুশি হয়ে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে চান, কিন্তু রামানুজনের আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রখর, তাই তিনি তার সাহায্য নেননি।
১৯১১ সালে তিনি তার প্রথম আর্টিকেল ভারতীয় গণিত সোসাইটি থেকে প্রকাশিত জার্নালে প্রকাশ করেন। তখনই ভারতের গণিতবিদরা গণিতে তার অসাধারণ মেধার কথা কিছুটা জানতে পারেন। অনেকেই তখন তাকে ইংল্যান্ডের বড় কোনো অধ্যাপকের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের বিখ্যাত অধ্যাপক গডফ্রে হার্ডি (এড়ফভৎবু ঐ. ঐধৎফু)-সহ আরও অনেকের কাছে চিঠি পাঠান। অধ্যাপক হার্ডি তার কিছু কাজ দেখে বিস্মিত হয়ে তাকে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেন।
আমাদের উচিত এই ধরনের মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানানো। আমাদের উচিত শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো। আমাদের উচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান বাড়াতে কাজ করা।
১৯১৪ সালে রামানুজন ক্যামব্রিজে যান এবং সেখানে প্রথমবারের মতো হার্ডির তত্ত্বাবধানে আনুষ্ঠানিক গণিত শিক্ষা লাভ করেন এবং হার্ডির সাথে যৌথভাবে আর্টিকেল প্রকাশ করেন। গণিতের ওপর রামানুজনের দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। একবার রামানুজনের সাথে গল্প করার জন্য অধ্যাপক হার্ডি ক্যাব নিয়ে রামানুজনের বাসায় যান। সেখানে গিয়ে তাকে বললেন, যেই ক্যাবে করে গিয়েছেন সেই ক্যাবের নম্বর ১৭২৯ এবং বললেন, এটি খুবই বোরিং একটা নম্বর। রামানুজন একটু পরে বললেন, এটি মোটেও বোরিং না, কারণ এটি দুইভাবে দুটো নম্বরের কিউবিক পাওয়ার করে পাওয়া যেতে পারে। যেমন, ১৩+১২৩ এবং ৯৩+১০৩!
তাৎক্ষণিক এই উত্তর শুনে অধ্যাপক হার্ডি হতবাক। এই নম্বরকে এখন হার্ডি-রামানুজন নম্বর বলা হয়। এছাড়া গণিতের অনেক সিরিজ তিনি আবিষ্কার করেছেন। একজন সত্যিকারের শিক্ষক, একজন সত্যিকারের গবেষক যে মেধাকে মূল্যায়ন করতে পারেন তার প্রমাণ হলো অধ্যাপক হার্ডির চেষ্টায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় রামানুজনকে ‘ব্যাচেলর অফ আর্টস বাই রিসার্চ’ দেওয়া হয়, যা ১৯২০ সাল থেকে পিএইচডি ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯১৭ সালে রামানুজন প্রচ- অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা বলেই দিলেন, সম্ভবত তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। যদিও তিনি কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে তার শরীর খুব দ্রুত খারাপ হতে থাকায় তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং ২৬ এপ্রিল ১৯২০ তারিখে তিনি মারা যান।
মাত্র ৩২ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, প্রায় ৩৯০০ গাণিতিক সমস্যা সমাধান করেন যার অনেকটাই ছিল নতুন। কিছু কাজ ছিল পুরানো কিন্তু তিনি তা জানতেন না। আর কিছু কাজ ছিল গণিতের বিস্ময়। এখনো তার নোটবুকে লেখা কিছু কাজ গণিতবিদরা প্রমাণ করতে পারেননি।
মানুষ ১০০ বছর বেঁচেও অনেককিছু করতে পারেন না, তিনি মাত্র ৩২ বছরের জীবনেই তা করে দেখিয়েছেন। মাঝে মাঝে ভাবি এইরকম প্রাকৃতিকভাবে মেধাবীরা কেন ক্ষণজন্মা হন? ভাবুন নজরুলের কথা, ভাবুন বব মার্লের কথা।
শ্রীনিবাস রামানুজনের মেধার স্বীকৃতি ও তাকে যথোপযুক্ত সম্মান দিতে ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে উপমহাদেশের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়ী অধ্যাপক আব্দুস সালামের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান রামানুজনের নামে ২০০৫ সালে গণিতে একটি পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেন। পুরস্কারটির নাম রাখা হয় ওঈঞচ জধসধহঁলধহ চৎরুব ভড়ৎ ণড়ঁহম গধঃযবসধঃরপরধহং এবং পুরস্কারটি দেওয়া হয় উন্নয়নশীল দেশের গণিতবিদদের মধ্য থেকে যারা সেরা তাদেরকে।
এই পর্যন্ত ১৭ জন এই পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে ২০২১ সালে ভারতের নীনা গুপ্তা এই পুরস্কার পান। তিনি ছাড়াও আরও ৩ জন ভারতীয়, ৭ জন ব্রাজিলিয়ান-আর্জেন্টিনিয়ান, ৩ জন চাইনিজ, ১ জন মেক্সিকান, ১ জন গাবনের এবং ১ জন ভিয়েতনামের। কোনো বাংলাদেশি এখনো পর্যন্ত এই পুরস্কার পাননি। আইসিটিপির দেওয়া এই পুরস্কার রামানুজনের প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
রামানুজনের জীবনী থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। একজন রামানুজন তৈরি করলে বিশ্বের দরবারে দেশের সম্মান কোন উচ্চতায় উঠবে বুঝতে পারছেন? একটি বই, একজন শিক্ষকের গুরুত্ব কী বুঝতে পারেন? একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কী বুঝতে পারেন?
গণিত দিয়ে, রামানুজনের কাজ দিয়ে দেশের কী লাভ? এইসব প্রশ্ন কেবল বোকার দেশেই হতে পারে। আমরা বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তির ওপর বেশি নজর দিয়ে ফেলছি। এতে আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হতে পারবো কিন্তু প্রযুক্তি উদ্ভাবক হতে পারবো না। উদ্ভাবনের জন্য প্রথমে বিজ্ঞানে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।