প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
আগুনের সম্মার্জনা হাতে নিয়ে সকল প্রকার অন্যায়, শোষণ, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা দূর করার মানসে যিনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করেছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খলকে উপড়ে ফেলার সংগ্রামে আপোষহীন, তিনি হলেন মহাবিদ্রোহের মহাতূর্যবাদক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সমাজের বৈষম্য থেকে বিদ্রোহী চেতনা গ্রহণ করেছেন এবং ব্যক্তিসত্তার বিদ্রোহকে তিনি সবার মাঝে উদ্বোধন করতে চেয়েছিলেন।
নজরুলের জীবদ্দশায় তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, বর্তমানেও চলছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে কবি আব্দুল কাদির অনেক কাজ করেছেন। আব্দুল কাদির যদি সে সময়ে বাউ-েলে ও ছন্নছাড়া জীবন অতিবাহিত করা নজরুলের লেখনী ও তথ্য সংগ্রহ করে না রাখতেন, তাহলে নজরুলের অনেক রচনাই হারিয়ে যেত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নজরুলকে নিয়ে প্রথম গবেষণা-কর্ম শুরু করেন বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, ভাষাতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল হাই স্যারের নির্দেশনায় মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত হন। ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর গবেষণা কাজে কবি আব্দুল কাদির থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছেন। কমরেড মোজাফফর আহমদের সাথে কথা বলেও তিনি অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
নজরুল-গবেষণার প্রয়োজনে তিনি নজরুলের গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় যান। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও তাঁর পরিবার, প্রতিবেশী এবং আসানসোলের অগ্রজদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে লেখনীতে তুলে ধরেন; ফলে নজরুল সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য আমাদের গোচরীভূত হয়। ১৯৫৮ সালে শ্যাম বাজারের পাশ্ববর্তী নজরুলের বাসায় সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ড. রফিকুল ইসলামের। সেখানে তিনি নজরুল-স্ত্রী প্রমীলা এবং সন্তান কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধের সাথে আলাপ করেন। প্রায় মাসখানেক কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি প্রায়ই নজরুলের বাসায় যেতেন এবং প্রতিবারই নতুন নতুন তথ্য পেতেনÑযেটি নজরুলের জীবনীগ্রন্থ রচনা ও নজরুল নির্দেশিকা রচনায় কাজে আসে।
ড. ইসলাম নজরুলকে নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ নজরুল নির্দেশিকা (১৯৬৯), নজরুল-জীবনী (১৯৭২), কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও কবিতা (১৯৮২), কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য (১৯৯১), ‘নজরুল-সমীক্ষা’(১৯৯২), কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি (১৯৯৭), নজরুল প্রসঙ্গে (১৯৯৮), কিশোর কবি নজরুল (২০০০), নজরুল সাহিত্য (২০০৩), কাজী নজরুল ইসলাম : গীতি সংকলন ১ম-৩য় খ- (১৯৯৪-৯৬), নজরুল স্মৃতিচারণ (১৯৯৫), শতবর্ষে শতকবির নজরুল বন্দনা (২০০১), নজরুল রচনাবলী ১ম-১২শ খ- (প্রধান সম্পাদক, ২০০৭-১০), কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন (২০১২), নজরুলের বাংলাদেশ-আগমনের শতবর্ষ(২০১৩), নজরুল-জীবনী (২০১৩)।
রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নজরুল নির্দেশিকা’ (১৯৬৯) নির্ঘন্ট জাতীয় গ্রন্থ। নজরুল নির্দেশিকায় নজরুলের প্রায় সমস্ত রচনার কালানুক্রমিক ও বর্ণানুক্রমিক সূচি এবং উৎসপঞ্জি সংযোজিত হয়েছে। নজরুলের কোন্ রচনা কখন, কোথায় প্রথম প্রকাশিত হয়, সে তথ্য গবেষকদের গবেষণার মূল্যবান উপাত্ত স্বরূপ।
ড. রফিকুল ইসলামের ‘কিশোর কবি নজরুল’(২০০০) গ্রন্থটিতে নজরুলের শৈশব ও কৈশোরের জীবন এবং সেই সময়ে রচিত বিভিন্ন লেখা উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রন্থটির আলোচ্যসূচি হলোÑ ‘কিশোর কবি নজরুল’; ‘নজরুলের লেটো ও ছাত্র জীবনের রচনা,’ ‘ছাত্র কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সংকলন,’ কিশোর নজরুলের পালা-নাটিকা ও অন্যান্য গান’। কিশোর নজরুলের কবিতাকে ড. ইসলাম দুটি ভাগে বিভাজন করেছেন। এক, লেটো ও কবি দলের জন্যে রচিত পালা ও গান; দুই, স্কুলের ছাত্র নজরুলের লেখা কবিতা। লেটো বা কবি দলের রচনাগুলো, যারা পালা বা কবি লড়াই দেখতে আসতেনÑ সকল শ্রেণির ও সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য রচিত। আর ছাত্র নজরুলের লেখা কবিতাগুলো অন্তরের তাগিদে লেখা, যেখানে কিশোর নজরুলের মনের খবর পাওয়া যায়। লেটো কবি নজরুলের কিশোর বয়সের রচনা দীর্ঘদিন সংগৃহীত বা সংকলিত না হওয়ায় এসব রচনা অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। নজরুলের একগুচ্ছ পালা নাটিকা ও অন্যান্য গান আজিবুল হক তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যাভূতুম, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, আকবর বাদশাহর সঙ, যুধিষ্ঠিরের সঙ, রাজপুত্রের সঙ, কালিদাস কবির সঙ, দাতাকর্ণ, চাষার সঙ, মেঘনাদবধ-এর সঙ, শকুনি বধ-এর সঙ, অপ্রকাশিত গীতিগুচ্ছ এবং কবির লড়াই (কমিক যাত্রা) ইত্যাদি। বর্তমান গ্রন্থে কিশোর কবি নজরুলের সেই অপ্রকাশিত রচনাবলি সংকলিত করা হয়েছে, যার মধ্যদিয়ে নজরুলের লেটো রচনাবলি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নজরুল-সমীক্ষা’য় (১৯৯২) দেশ-বিদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচকদের ‘নজরুল-বক্তৃতামালা’য় প্রদত্ত বক্তৃতাবলির সংকলন। এতে প্রথম বক্তা ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ড.সুখময় মুখোপাধ্যায়। তিনি আলোচনা করেছেন মূলত নজরুল সঙ্গীত নিয়ে। আর শেষ বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী দীন মুহম্মদ। তিনি নজরুলের আরবি-ফারসি-তুর্কি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছেÑ আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘নজরুলের সাহিত্যচিন্তা’, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম-এর ‘আধুনিকতা ও নজরুল ইসলাম’, মাহবুব সাদিকের ‘মিথÑঐতিহ্যচেতনা এবং নজরুলের কবিতা’, রাজীব হুমায়ুনের ‘নজরুল সৃষ্টিতে বৈষ্ণব উপাদান’, নরেন বিশ্বাসের ‘নজরুল কাব্যে শব্দালঙ্কার’, আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখিত ‘চিত্রকল্পের স¤্রাট’, স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নজরুলের গানের বৈচিত্র্য’, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের ‘নজরুল গদ্যে শিল্পরূপ’, এস. এম লুৎফর রহমানের ‘অনুবাদ সাহিত্যে নজরুল’, আবু রুশ্দ রচিত ‘নজরুলের ছোট গল্প’, সুখময় মুখোপাধ্যায়ের ‘কবি নজরুলঃ কয়েকটি তথ্য’, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘নজরুলের কবিতায় আত্ম সম্বোধন’, কাজী দীন মুহম্মদের ‘কাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচিত গ্রন্থের নির্ঘন্ট’। প্রকাশনাটি নজরুল চর্চায় আগ্রহীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করি।
‘নজরুল প্রসঙ্গে’ (১৯৯৮) গ্রন্থটিতে ড. রফিকুল ইসলাম নজরুলের জীবন, সাহিত্য ও সঙ্গীত বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ সংকলন করেছেন। প্রবন্ধগুলো হলোÑ‘নজরুল-জীবনী রচনার কয়েকটি সমস্যা’, ‘নজরুলের শিল্পীসত্তা’, ‘নজরুলের নায়ক-নায়িকা’, ‘নজরুলের প্রথম পর্বের কাব্যে চিত্রকল্পের ব্যবহার’, ‘নজরুলের কথা-সাহিত্যে গদ্যরীতি’, ‘নজরুল-প্রশস্তি ও নজরুল-সংবর্ধনা’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন’, ‘নজরুল গবেষণার পথিকৃৎ আবুল কাদির’, ‘নজরুলের শিল্পী-জীবন’, ‘নজরুল-সংগীত’, ‘নজরুল-সংগীত : বিবর্তনের কয়েকটি পর্যায়’, ‘বাংলাদেশে নজরুল সংগীত-চর্চা’, ‘বাংলাদেশে নজরুলের একটি গান নিয়ে বির্তক’, ‘নজরুল-সংগীতে বিকৃতির স্বরূপ’, ‘বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলা কবিতা ও গান এবং কাজী নজরুল ইসলাম’। ‘নজরুল-জীবনী রচনার কয়েকটি সমস্যা’ প্রবন্ধে নজরুলের জন্ম তারিখ, স্কুল-জীবন, সেনাবাহিনীতে যোগদানের সময়, নজরুল-নার্গিস সম্পর্ক, নজরুল-প্রমীলার বিবাহে প্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে গবেষক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ( ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে )। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়’ (১৩৭১ বঙ্গাব্দ/ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে সুফি জুলফিকার হায়দার নজরুলের জন্ম তারিখ নিয়ে নতুন তথ্য দেওয়ায় নজরুলের জন্ম তারিখ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাঁর প্রদত্ত তথ্য হলো- ‘কবি নজরুলের জন্ম ১১ই বৈশাখ বলে কবির বন্ধু সেই জ্যোতিষী প-িত বি আর ব্যানার্জী বললেন। কবির কাছ থেকেই তিনিও শুনেছেন, এ কথা বললেন। এবং ১১ই বৈশাখ হিসাবেই তিনি কুষ্ঠিও গণনা করেছেন।’ তবে কবির সুস্থাবস্থায় ১১ জ্যৈষ্ঠ তাঁর জন্মদিবস পালিত হয়েছে এবং কবি তাতে আপত্তিও জানাননি। নজরুলের প্রথম জীবনীকার আব্দুল কাদির দৈনিক কৃষক পত্রিকায় (২৯ পৌষ ১৩৪৭) ‘নজরুল-জন্মবার্ষিকী’ এবং ঐ বছরের সাপ্তাহিক কৃষক পত্রিকার বিশেষ ইদ সংখ্যায় ‘নজরুল-জীবনী’ শিরোনামে কবির জন্ম তারিখ ১১ জ্যৈষ্ঠ উল্লেখ করেন। নজরুল প্রবন্ধ দুটিই পাঠ করেন এবং জন্ম তারিখ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। কবি যে মঙ্গলবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে কথা তিনি নিজেই আব্দুল কাদিরকে বলেছিলেন আর ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ছিলো মঙ্গলবার। নজরুলের জন্ম তারিখসহ অন্যান্য সমস্যার জরুরি সমাধান হওয়া প্রয়োজন বলে গবেষক মনে করেন।
‘নজরুলের বাংলাদেশ-আগমনের শতবর্ষ’(২০১৩) গ্রন্থটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অমর স্মৃতির উদ্দেশে। নজরুলের স্মৃতি-বিজড়িত স্থান এই বাংলাদেশ। এখানেই ঘটেছিলো তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য অনেক ঘটনা। নজরুল বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে অবস্থিত দরিরামপুরে সপ্তম শ্রেণির ছাত্ররূপে। সুস্থাবস্থায় তিনি শেষবার বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে। পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় অসুস্থ কবিকে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে বাংলাদেশে আনা হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। সুস্থাবস্থায় তিনি ত্রিশাল-দরিরামপুর, বরিশাল, কুমিল্লা-দৌলতপুর, ফরিদপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, রাউজান, সিলেট, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় যান এবং তাঁর অনলবর্ষী বক্তৃতা, জাগরণমূলক কবিতা ও গানের মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলেন। ‘কুমিল্লা-দৌলতপুর’ অংশের মাধ্যমে নজরুলের চাঁদপুরে আগমনের যে তথ্য পাওয়া যায় তা নি¤œরূপÑ ‘মুজফ্ফর আহ্মদ দু’দিন কুমিল্লায় থেকে ৮ই জুলাই নজরুলকে নিয়ে কোলকাতা রওনা হন। চাঁদপুরে এসে দেখা গেল ভাড়ার টাকা কম পড়েছে, তখন তাঁরা চাঁদপুর ডাক বাংলোয় উঠে কোলকাতায় আফ্জালুল হক সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম করলেন টাকার জন্যে। হক সাহেব ব্যাপারটি কুমিল্লার আশ্রাফউদ্দিন চৌধুরীকে জানালে, চৌধুরী সাহেব চাঁদপুরে শ্রীহরদয়াল নাগকে টেলিগ্রাম করে দিলেন। টেলিগ্রাম পেয়ে তিনি তাঁদের বারটি টাকা পৌঁছে দিলেন। নজরুল মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে প্রায় ছয় মাস পরে কোলকাতা ফিরে এলেন।’
রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নজরুলের নির্বাচিত জাগরণী গান’ গ্রন্থে মোট গান রয়েছে ৬৫ টি। এতে তিনি প্রথম গান ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’এবং শেষ গান ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ সংযোজিত করে একজন বিপ্লবী, স্বাধীনচেতা ও অসাম্প্রদায়িক নজরুলের পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল’ (২০১১) গ্রন্থে ড. রফিকুল ইসলাম ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল’ প্রবন্ধে বিভিন্ন তথ্য আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দু’জনই বাংলা সাহিত্য-সংগীতকে সমৃদ্ধ ও উৎকর্ষম-িত করেছেন। তাদের দু’জনের সম্পর্ক ছিল ¯েœহ-ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যরে। প্রবন্ধে ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে নজরুল ও তাঁর রচনাকে আক্রমণ এবং প্যারোডি রচনা; পরবর্তীতে সজনীকান্ত-মোহিতলাল কর্তৃক আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরা হয়। বিচিত্রা পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায় (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) ‘সাহিত্য ধর্ম’ প্রবন্ধের এক স্থানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সম্প্রতি আমাদের সাহিত্যে বিদেশের আমদানি যে একটা বে-আব্রুতা এসেছে সেটাকেও এখানকার কেউ কেউ মনে করছেন নিত্য পদার্থ; ভুলে যান, যা নিত্য তা অতীতকে সম্পূর্ণ প্রতিবাদ করে না।... এই ল্যাঙটপরা গুলি-পাকানো ধুলো মাখা আধুনিকতারই একটি স্বদেশী দৃষ্টান্ত দেখেছি হোলিখেলার দিনে চিৎপুর রোডে।’ অনেকে মনে করেন কবিগুরুর সমালোচনার তিরটি পরোক্ষভাবে নজরুলের উপর পড়েছে। তাই নজরুলও ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ প্রবন্ধে তাঁর সমালোচকদের বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লিখেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি বহুদূর গড়িয়ে যাওয়ায় এবং তর্ক-বিতর্ক অপ্রীতিকর ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় তা অবসানের জন্য মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন প্রমথ চৌধুরী। এই প্রবন্ধে গবেষক দার্জিলিং-এ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাক্ষাতকার (জুন,১৯৩১) এবং পরবর্তীতে তাঁদের মধ্যে পত্রালাপের (১৯৩৫ খ্রি./১৩৪২ বঙ্গাব্দ) তথ্যও আমাদের সামনে উপস্থাপন করে এই মহান দুই কবির পারস্পরিক ¯েœহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। এ সম্পকির্ত একটি উদাহরণ গবেষক পাঠকের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করেছেন তা হলোÑ‘রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুলের সংগীত পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের আপত্তি সত্ত্বেও সে ছবির মুক্তিলাভ। ঐ ছবির নির্মাতা নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তকে নিয়ে নজরুল সরাসরি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কছে চলে যান এবং তাঁর অনুমোদন নিয়ে আসেন। ফলে ছবিটি প্রদর্শনীর বাধা দূর হয়।’
‘নজরুল-পর্যালোচনা’ গ্রন্থটি নজরুল সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ সংকলন। গ্রন্থটিতে মোট ১১টি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলো হলোÑ ‘নজরুল-জন্মশতবর্ষ বক্তৃতা’, ‘শতবর্ষের বাংলা সাহিত্য ও সংগীত এবং কাজী নজরুল ইসলাম’, ‘একুশ শতকে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা’, ‘বিশ শতকের বিস্ময়কর কবিতা বিদ্রোহী’, ‘কুমিল্লা ও দৌলতপুরে প্রমীলা ও নার্গিস: নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ’, ‘অসাম্প্রদায়িকতা ও কাজী নজরুল ইসলাম’, ‘বাংলাদেশে নজরুল’, ‘নজরুলের চট্টগ্রাম সফর’, ‘নজরুল-জীবনে ফরিদপুর’, ‘নজরুল কাব্য-পাঠের ভূমিকা’ ও ‘আন্তর্জাতিক নজরুল’। নজরুল যখন সাহিত্য রচনা করেন, তখন অনেকেই তাঁর সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা ও স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নজরুলও এর সমুচিত জবাব দিয়েছেন এবং ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় বলেছেন, ‘বর্তমানের কবি আমি, ভবিষ্যতের নই নবি’। এই গ্রন্থটিতে বর্তমান সময়ে (একবিংশ শতকে) নজরুলের প্রাসঙ্গিকতাই প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়াও প্রবন্ধগুলোতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও আন্তর্জাতিকতা এই দুটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। এককথায়, সাম্প্রতিককালেও নজরুল কীভাবে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে, উঠেছেন তার চিত্র প্রাবন্ধিক আমাদের সামনে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন।
‘নজরুলের জীবনী’ (২০১৩) গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ কর্তৃক ১৯৭২ সালের ২৫ মে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ ৪০ বছর পর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত আকারে ২০১৩ সালের নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়। পাঠক সমাজে নজরুলের প্রামাণ্য পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থের যে অভাববোধ ছিল- গ্রন্থটি রচনার ফলে তা অনেকাংশেই দূর হয়। গ্রন্থটিতে যে বিষয়গুলো উপস্থাপিত হয়েছে, তা হলো- বাল্য ও কৈশোর, সৈনিক জীবন, সৈনিক কবি, সাংবাদিকতা, কুমিল্লা ও দৌলতপুরে, বিদ্রোহী, বিপ্লবী, সংসারী, সাম্যবাদী, বুলবুল, মসীযুদ্ধ, প্রেমিকা, মোহাম্মদী বনাম সওগাত, জাতীয় সংবর্ধনা, শিল্পী জীবন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, নীরব কবি, জীবনের শেষ দিনগুলি। গ্রন্থটিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে। পরিশিষ্ট-১ এ নজরুলের বিভিন্ন গ্রন্থের নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলা সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তিসমূহ; পরিশিষ্ট-২ এ রয়েছে কাজী সব্যসাচীর বাল্য-স্মৃতি।
‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা’ (১৯৮২) গ্রন্থটি দুটি ভাগে বিভক্ত। ১ম ভাগের শিরোনাম ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবনকথা’। এই ভাগের আঠারো অধ্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে; সাথে সাথে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের ওপরে। অধ্যায়গুলো হলোÑ বাল্য ও কৈশোর, সৈনিক জীবন, সৈনিক কবি, সাংবাদিক, দৌলতপুর ও নার্গিস, বিদ্রোহী, বিপ্লবী, রাজবন্দী, সংসারী, সাম্যবাদী, বুলবুল, মসীযুদ্ধ, প্রেম ও বিরহ, মোহাম্মদী বনাম সাওগাত, জাতীয় সংবর্ধনা, সুর সাধক, সম্বিতহারা, বাংলাদেশের মাটিতে। ‘নজরুলের জীবনী’ গ্রন্থেও উপরের বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটির ২য় ভাগের শিরোনাম ‘কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা’। এ অংশের প্রথম অধ্যায়ে সমকালীন বাংলা কবিতা, দ্বিতীয় থেকে সপ্তম অধ্যায়ে নজরুলের উদ্দীপনামূলক কবিতার ছয়টি পর্যায় এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ অধ্যায়ে কবির গীতি কবিতার পাঁচটি পর্যায়ের বর্ণনা রয়েছে। উদ্দীপনামূলক কবিতাগুলোতে নজরুলের বিদ্রোহ, বিপ্লব, সাম্যবাদ, স্বাধীনতা, ধর্ম, যৌবন প্রভৃতি বিষয় এবং গীতি কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, বিরহ, সৌন্দর্য প্রভৃতি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে নজরুলের কবিতা আলোচনার উপসংহার, পাদটীকা, নজরুল গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘন্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
‘কাজী নজরুল ইসলাম:জীবন ও সৃষ্টি’ (১৯৯৭) গ্রন্থটির তিনটি ভাগের প্রথম ভাগে ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবনকথা’ এবং দ্বিতীয় ভাগে ‘কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা’ অংশ গবেষকের ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা’ (১৯৮২) গ্রন্থে সংযোজিত রয়েছে। গ্রন্থটির তৃতীয় ভাগের শিরোনাম হলোÑ ‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সঙ্গীত’। এরমধ্যে প্রথম অধ্যায়ে প্রবন্ধ, দ্বিতীয় অধ্যায়ে গল্প ও উপন্যাস, তৃতীয় অধ্যায়ে নাটক এবং চতুর্থ অধ্যায়ে সঙ্গীত নিয়ে স্বল্প পরিসরে সহজ-সরল ভাষায় বিচার বিশ্লেষণ করে পাঠকদের তিনি নজরুলের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। পাঠকও নজরুলের গদ্যসাহিত্য ও সঙ্গীত সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবে বইটি পড়ে।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ড. রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার মৌলিক গবেষণা কর্মটি হলো ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃজন’(২০১২) গ্রন্থ। গ্রন্থটির তিনটি অংশের প্রথম ভাগে রয়েছে ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবনকথা’Ñ যেখানে আঠারোটি অধ্যায়ে নজরুলের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে, যা ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা’ (১৯৮২) গ্রন্থটিতে উল্লেখ রয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম ‘কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা’। এখানে তেরোটি অধ্যায়ের প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে সমকালীন বাংলা কবিতা সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম অধ্যায়ে রয়েছে উদ্দীপনামূলক কবিতাÑ যেখানে বিদ্রোহ, বিপ্লব, সাম্যবাদ, ইসলাম, যৌবন, চারিত্র্য এই বিষয়গুলো; অষ্টম থেকে দ্বাদশ অধ্যায়ে ‘প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা’ স্থান পেয়েছে এবং ত্রয়োদশ অধ্যায়ে নজরুল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটির তৃতীয় ভাগের শিরোনাম ‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সঙ্গীত’। এখানে চারটি অধ্যায়ে নজরুলের প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। পরিশিষ্ট অংশে সমসাময়িককালে নজরুলের মূল্যায়ন ও নির্দেশিকা সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের মাধ্যমে কেবল ঔপনিবেশিক সমাজের শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন, অত্যাচার, বন্দিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই ঘোষিত হয়নি; তাঁর সৌন্দর্যপিপাসু প্রেমিক মনের সাক্ষাতও পাই। ড. রফিকুল ইসলাম কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে যে সকল গবেষণা-কর্ম করেছেন, তাতে আমরা নজরুল সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পাই। বর্তমান সময়ে যারা নজরুলকে জানতে ও তাঁকে নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য ড. রফিকুল ইসলামের লেখা বইগুলো সহায়ক।
লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।