প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
বিশ্বের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপার্সে অন্তত ৮ বাংলাদেশির নাম পাওয়া গেছে। সোমবার বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে ওয়াশিংটনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) ফাঁসকৃত গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্রে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
প্যান্ডোরা পেপার্সের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্রে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত কোম্পানির মালিক ওই ৮ বাংলাদেশি। আইসিআইজের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্যান্ডোরা পেপার্সের গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় দফায় ১৫ হাজারেরও বেশি অফশোর কোম্পানি, ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট এবং অন্যান্য সংস্থার সুবিধাভোগী মালিকদের তথ্য প্রকাশ করছে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট।
পানামার আইনি সংস্থা অ্যালেমান, কর্ডেরো, গ্যালিন্ডো অ্যান্ড লি (অ্যালকোগাল) এবং ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের সদর দফতরে অবস্থিত ফিডেলিটি করপোরেট সার্ভিসেসের কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে আইসিআইজে। বিশ্বের ১১৭টি দেশের দেড়শ গণমাধ্যমের ৬ শতাধিক সাংবাদিকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে আর্থিক এই কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়েছে প্যান্ডোরা পেপার্সে।
দ্বিতীয় দফার এই গোপনীয় নথিপত্র প্রকাশের মাধ্যমে আইসিআইজের অফশোর লিকস ডেটাবেসে এখন ৮ লাখের বেশি অফশোর কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। যা ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি তথ্য ফাঁসের ঘটনা থেকে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইসিআইজে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক এই কনসোর্টিয়ামের কাছে ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের মানুষ এবং কোম্পানির গোপন অর্থের হদিস মিলেছে।
প্যান্ডোরা পেপার্সে যে ৮ বাংলাদেশির নাম পাওয়া গেছে তাদের সবারই অন্যান্য দেশের নাগরিকত্বও আছে। এসব দেশের মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং আর্জেন্টিনা।
তবে এই তালিকায় ঠাঁই পাওয়া বাংলাদেশিদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি যে সাংবাদিকরা এই তথ্য ফাঁস করেছেন তারাও সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি।
দ্বিতীয় দফায় প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপার্সের তালিকায় নিহাদ কবীর নামের এক বাংলাদেশি নারী ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ইন্দিরা রোডে তার একটি বাসা রয়েছে বলে নথিতে বলা হয়েছে। ক্যাপিটাল ফেয়ার হোল্ডিংস লিমিটেড নামে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি রয়েছে। ২০০৮ সালের আগস্টে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অফশোর কোম্পানি হিসেবে এটি নিবন্ধিত হয়।
বহুল আলোচিত এই প্যান্ডোরা পেপার্স তালিকায় ইসলাম মঞ্জুরুল নামের আরেক বাংলাদেশি আছেন। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে ওরিয়েন্টাল এগ্রিকালচারাল কেমিক্যাল কোম্পানি নামে নিবন্ধিত একটি কোম্পানির মালিক তিনি। যুক্তরাজ্যে বসবাসের পরিচয়ের পাশাপাশি ঢাকার গুলশানের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন তিনি।
এছাড়াও অনিতা রানি ভৌমিক, সাকিনা মিরালি, মোহাম্মদ ভাই, ওয়াল্টার প্রহমাদ, ড্যানিয়েল আর্নেস্তো আয়ুবাতি ও সাইদুল হুদা চৌধুরী নামে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে; যারা বাংলাদেশি পরিচয় ব্যবহার করেছেন। তাদের মধ্যে সাইদুল হুদা, সাকিনা মিরালি এবং মোহাম্মদ ভাই গুলশানের ঠিকানা উল্লেখ করেছেন এবং অনিতা রানি ভৌমিক চকবাজারের ঠিকানা দিয়েছেন।
এই বাংলাদেশিদের মধ্যে সাইদুল হুদা বেবেন ইন্টারন্যাশনাল, অনিতা রানি এন্টারপ্রাইজ হোল্ডিংস লিমিটেড, সাকিনা মুন রেকার সার্ভিসেস করপোরেশন, মোহাম্মদ ভাই ১৯৩৬ হোল্ডিংস লিমিটেড, প্রহমাদ স্লিন্ট লিঙ্ক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড এবং ডেনিয়েল কুদেল লিমিটেড নামের কোম্পানির মালিক।
এর আগে, গত ৩ অক্টোবর প্রথম দফায় বিশ্বের প্রভাবশালী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পেশাদার সেবা দিয়ে নামমাত্র কর অথবা করবিহীন ব্যবসা ও সম্পদ কেনার কাজে সহায়তা করেছে এমন ১৪টি কোম্পানির ১ কোটি ২০ লাখ গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে তথ্য ফাঁস করা হয় প্যান্ডোরা পেপার্সে। সেই সময় আব্দুল আওয়াল মিন্টু নামের এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে প্যান্ডোরা পেপার্সে পাওয়া যায়। তিনি নেপাল থেকে ব্যবসা পরিচালনা করেন বলে জানানো হয়।
প্যান্ডোরা পেপার্স কী?
গত ৩ অক্টোবর প্রথম দফায় বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ রাষ্ট্রপ্রধান, ৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের ৩ শতাধিক রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রায় একশ ধনকুবেরের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য ফাঁস হয় প্যান্ডোরা পেপার্সে। এটি ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক গোপনীয় দলিলপত্র ফাঁসের ঘটনা।
এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিকদের অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে গোপনে বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য হাজির করা হয়।
কীভাবে ব্যাংক এবং আইনি সংস্থাগুলো জটিল করপোরেট কাঠামো নকশা করার জন্য অফশোর পরিষেবাদানকারীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে-প্যান্ডোরা পেপারস তদন্তে সেসবও উন্মোচিত হয়েছে। নথিপত্রে দেখা যায়, প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেনে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে ব্যবসা না করার ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও অফশোর কোম্পানিগুলো সেবাদানকারী গ্রাহকদের সবসময় চেনে না।
নথিপত্র এলো কীভাবে?
প্যান্ডোরা পেপার্সের গোপনীয় আর্থিক দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় দফায় সোমবার ১৫ হাজারেরও বেশি অফশোর কোম্পানি, ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট এবং অন্যান্য সংস্থার সুবিধাভোগী মালিকদের তথ্য প্রকাশ করছে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট।
এর আগে, গত অক্টোবরে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ নথি পায় আইসিজে; যার বেশিরভাগই অগোছালো ছিল। এসব নথির অর্ধেকের বেশিই (৬৪ লাখ) ছিল টেক্সট আকারে। যার ৪০ লাখের বেশি পিডিএফ, যা ১০ হাজার পৃষ্ঠারও বেশি। প্যান্ডোরা পেপার্সের নথিপত্রে পাসপোর্ট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ট্যাক্স ডিক্লারেশন, কোম্পানির অন্তর্ভুক্তির রেকর্ড, রিয়েল এস্টেট চুক্তিও আছে। এছাড়া এতে ৪১ লাখের বেশি ছবি এবং ই-মেইলও ছিল।
নথিপত্রের ৪ শতাংশ ছিল স্প্রেডশিট আকারে; যা ৪ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। শুধু তাই নয়, আইসিআইজের কাছে আসা নথিতে অডিও, ভিডিও ও স্লাইডও ছিল।
প্যান্ডোরা নাম কেন?
গ্রিক উপকথায় বিশ্বের প্রথম মানবী প্যান্ডোরা। উপকথায় আছে, সেই প্রথম মানবী প্যান্ডোরা একটি বন্ধ বাক্সের মুখ খুলে দেন। যে বাক্স থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে অশুভ শক্তি। একবার সেটি খুলে দেওয়ার পর আর এর লাগাম টানা যায় না।
উপকথার সেই প্যান্ডোরার নামে বিশ্বের প্রভাবশালীদের গোপন সম্পদের খবর ফাঁসের এই ঘটনার নামকরণ করা হয়েছে। গোপন তথ্য অনুসন্ধানকারী ও ফাঁসকারী প্রতিষ্ঠান আইসিআইজের পরিচালক জেরার্ড রাইল বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘গোপন নথিপত্র ফাঁসের এই নাম দেওয়া হয়েছে প্যান্ডোরা পেপার্স। কারণ আমরা অনেক বিষয়ের একটি বাক্স খুলছি।’ সূত্র : ঢাকা পোস্ট।