রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

বিএনপি-আওয়ামী লীগ : দ্বৈরথ-দ্বৈরাজ্য বাংলাদেশ

অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার

বিএনপি-আওয়ামী লীগ : দ্বৈরথ-দ্বৈরাজ্য বাংলাদেশ
অনলাইন ডেস্ক

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলেছে অনেক। পাকিস্তান আমল থেকে অদ্যাবধি যে কোন বিরোধী দলের জন্য গণতান্ত্রিক কিংবা বৃহত্তরভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই অসহনীয় ও দুঃসাধ্য অবস্থায় এসে ঠেকেছে। আজকের এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর জন্য মূলতঃ দায়ী আদর্শগতভাবে গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলা। এক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব এবং প্রতিপক্ষকে সমূলে উচ্ছেদ করার দুরভিসন্ধিও কাজ করেছে পর্দার অন্তরালে-ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ২০০৪-এর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার জামিন ও তার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি এগুলো অন্যতম উদাহরণ।

দলীয়ভাবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক চরম সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে বিএনপি। এই দলটিকে হয় আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে নতুবা এর অস্তিত্ব নিভুনিভু প্রদীপের মতো আরো ¤্রয়িমান হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক সচেতন মহল। অর্থাৎ বলতে হয় রাজনীতির অরণ্যে ‘Political Wilderness’-এ হারিয়ে যাবে। এ দেশের ইতিহাস সেটিই বলছে।

১/১১-এর পর থেকে কিংবা ২০০৮-এর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর থেকে বিএনপির রাজনীতিতে দেখা দেয় সাংগঠনিক নানান জটিলতা ও দুর্বলতা। ২০০৮-এর নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আজ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিগত ১৩ বছরে সাংগঠনিকভাবে না ঘর গোছাতে পেরেছে বিএনপি, না জনগণকে টেনে আনতে পেরেছে গণআন্দোলনের কোনো কার্যকর পথে। এ অবস্থার জন্য দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মূলত দায়ী করছে বিএনপি। বিএনপি দলীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন, দেশে এখন গণতন্ত্র কিংবা আইনের শাসন কোনোটিই নেই। সর্বত্র চলছে এক নজিরবিহীন দলন-পীড়ন, ফ্যাসিবাদী হামলা, মামলা ও অপশাসনের তা-ব। তবে ভুললে চলবে না, এ পরিস্থিতি এক সময় ৭২ বছরের পুরানো দল আওয়ামী লীগকেও ভোগ করতে হয়েছে। এ দলের নেতাদের ভাষায়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশে চলছিল সামরিক শাসন। এ সময় আওয়ামী লীগের জন্যও সংগঠন করা কিংবা আন্দোলনের পথে নামা দুঃসাধ্য ছিল।

বিএনপির মতে, সরকার দেশে প্রকৃত অর্থেই বিরোধী দলের, বিশেষ করে বিএনপির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে চায়। সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মী ছাড়া কোনো নির্বাচনেই বিরোধীরা মাঠে নামতে পারে না। এমনকি ভোটও দিতে পারে না। দেশব্যাপী রাজনীতি ও নির্বাচনী পরিবেশকেই বিপন্ন করে তুলেছে সরকারের পুলিশ, লীগ ও ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী।

প্রকৃত বিরোধী দলের অংশগ্রহণ এবং প্রার্থীর অভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে এখন সরকারি দলের প্রার্থীরাই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে মারামারি করছে। জাল ভোট ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে কারচুপির ফলে সম্পূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থাটিই এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির শাসনামলে বিরোধী শিবিরে থাকা আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করেছে।

রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে যে কোনো সরকারব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে কলুষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা শক্তিশালী হয়ে উঠে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মত প্রকাশ করছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গণতন্ত্র থেকে পিছু হটার তালিকায় বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার উপাধি হচ্ছে ‘হাইব্রিড ও কর্তৃত্ববাদী’। সেখানে ভারতের গণতন্ত্রেও অবক্ষয় দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এসব নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এই বলে যে, তা না হলে বিশে^র অনেক জনবহুল দেশগুলো থেকে ক্রমেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি সাঙ্গ হয়ে স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদ এবং স্বেচ্ছাচারিতার রাজনীতি আরো বিস্তার লাভ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স’-এর ২০২১ সালের ‘বৈশ্বিক গণতন্ত্র পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সে প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, বাংলাদেশের মত কিছু ‘হাইব্রিড, কর্তৃত্ববাদী-স্বেচ্ছাচারিতা’র দেশে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ওই নির্বাচনগুলো পুরোপুরি প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক, স্বাধীন-নিরপেক্ষ বা অনিয়মমুক্ত হয় না।

বৈশি^ক মহামারী ও সংকটকালেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা নিয়ে অধিকাংশ দেশবাসী গর্ব বোধ করা শুরু করেছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা কিংবা নির্বাচনে কারচুপি বা অনিয়ম নিয়ে কোনো মন্তব্য আমাদের অবশ্যই হতাশ করে। আর তারা শুধু বাংলাদেশকে নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলেনি, বলেছে বিশে^র অনেক গণতান্ত্রিক দেশকে নিয়ে, যেখানে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ‘পলিটিকো’র খবর মাধ্যম জানা গেছে, বিশে^র ১১০টি দেশ নিয়ে ডিসেম্বর মাসে গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এটি হতাশার ও উদ্বেগের। নির্বাচন বিষয়ে দীর্ঘকাল এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা-গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য খুবই অমঙ্গল। অপরদিকে বলতে হয়, এর আগে অর্থাৎ বিএনপির শাসনামলে আমরা শুনেছি দুর্নীতিতে বিশে^ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। সেটি বিএনপি কিংবা যার আমলেই ঘটুক, তার জন্য লজ্জিত বাংলাদেশীরা। আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই ধরনের অভিযোগ কাটিয়ে উঠতে কিংবা ঘোচাতে না পারলে উন্নয়ন আমাদের দুর্নাম মুছে দিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে একটি কষ্টার্জিত উন্নত দেশে বাস করছে বেশীরভাগ নীতি-নৈতিকতাহীন মানুষ।

১৯৭০ ও ৮০’র দশকে বিএনপি যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করত, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (২৭টি জাতি) গঠনের পর থেকে আঞ্চলিক কিংবা বৈশি^ক রাজনীতিতে আন্তর্জাতিকতা কিংবা বিশ^ায়ন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এতে বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন ও অবাধ চিন্তা-ভাবনা কাজ করা শুরু করেছে। আর এর মধ্যে বিদ্যমান বিশ্ব-পরাশক্তির ভবিষ্যৎ কী বিশ্বের অনেক দেশ অবলোকন করছে। এদিকে গণচীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)’ বাস্তবায়ন শুরু করেছে অত্যন্ত সুচিন্তিত-সুচারূপভাবে।

বিএনপি প্রকৃত অর্থে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী নয়। দীর্ঘ পাকিস্তানী শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় আন্দোলন-সংগ্রাম করে শেষাবধি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির নেতৃত্বদানকারী দলটি তাদের জাতীয়তাবাদকে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক আদর্শ বা নীতির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে। সে কারণেই তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ভারতের সমর্থন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীন ও জাপানের সহযোগিতা নিতে পারছে একযোগে। এ ছাড়া বাংলাদেশে জনগণের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যতটা হৈ চৈ হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সাধারণ মানুষ যতটা ভাবছে সরকার তেমনটা না ভাবলেও ভাবার চেষ্টা ও প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, তবে তার চেয়েও বেশি দেখছে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ। রাজনীতির ক্ষমতায় কে থাকলো কি থাকলো না তা নিয়ে সাধারণ মানুষ ততটা উদ্বেলিত নয়। যার ফলস্বরূপ বিরোধীপক্ষ যৌক্তিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাঠ গরম করতে পারছে না। বিগত প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবাজ, সুবিধাবাদী, দুর্বৃত্তায়ন ও হাইব্রিড নেতা-কর্মীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলেও সাংগঠনিকভাবে দলের শক্তি বৃদ্ধি করতে পেরেছে। এ অবস্থান থেকে বিএনপি সহজেই তাকে সরিয়ে ফেলবে, তা ভাবার এখন তেমন সহজ পথ নেই। তবুও বিএনপিকে গভীর আস্থা নিয়ে বাস্তবতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উৎপাদন, রপ্তানী-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারের স্থিতিস্থাপকতার প্রয়োজন রয়েছে। তাই বলে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রচর্চা কিংবা রাজনৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে মানবসম্পদ কিংবা জনগোষ্ঠীর কোনো কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণ সম্ভব নয়।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়