রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   বয়ারচর সংযোগ ব্রিজ ও বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
  •   জার্মানিতে কঠিন হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়
  •   ইতালির দ্বীপে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ ২১
  •   অভিভাবকহীনতায় দিশেহারা চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
  •   আহতদের দেখতে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে করণীয়

ড. মোঃ নাছিম আখতার
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে করণীয়

কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যখন শ্রমশক্তিতে পরিণত হয় অর্থাৎ পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বেশি হয় তখন সেই অনুপাতকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) মতে, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বয়সী মানুষ তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাভোগী।

শতকরা ৬৮ ভাগ মানুষ কর্মক্ষম। জনমিতির হিসাবে বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মতো সুবর্ণ সময় পার করছে, যা ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল কি শুধু বয়সের সংখ্যাগত মানের ওপর নির্ভরশীল? কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক।

একজন অটোরিকশাচালক জানলেন, তার বয়স ৩৩ বছর।

কথায় কথায় নিজের পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি আমার সঙ্গে শেয়ার করলেন। বললেন, ‘স্যার, বর্তমানে অটোরিকশা চালানো ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারি না। প্রায় ক্ষেত্রেই মাজায় টান পড়ে।’ ৩৩ বছরের একজন যুবকের এমন অভিজ্ঞতা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অশনিসংকেত।

বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় অটোরিকশাচালকরা কোমরের ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ফলে ৬০ বছরের অনেক আগেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। ঢাকা শহরে চলে পায়ে চালিত রিকশা। একদিন মিরপুরে একজন সুঠামদেহী রিকশাচালকের রিকশায় উঠে বললাম, পায়ে চালিত রিকশা চালানোর পরও আপনি মোটা রয়ে গেছেন কিভাবে? উত্তরে রিকশাচালক বললেন, ‘আগে সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। বসা কাজ। মোটা হয়ে গিয়েছিলাম। নানা রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। নিজের শরীরকে বাঁচাতে সোয়েটার ফ্যাক্টরির কাজ ছেড়ে রিকশা চালানো শুরু করেছি। আগের তুলনায় অনেক মোটা কমেছি।’ স্থূলতা নীরব ঘাতক হলেও আমাদের দেশে কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধুলার অভাবে তা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে শতকরা ৩.৯ ভাগ মানুষ স্থূলতায় ভুগলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে শতকরা ৫.৪ ভাগ।

এবারের কোরবানি ঈদের দুদিন আগে বাড়ির কাছের বাজারে গিয়েছিলাম বাজার করতে। বাজারের পরিমাণ ২০ কেজির নিচে না। ব্যাগ টানতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সামনে দিয়ে চলে যাওয়া অটোরিকশাকে আমার গন্তব্যের নাম বলে যাবে কি না জিজ্ঞেস করলাম। রিকশাচালক প্রশ্ন করলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে নামবেন, নাকি ভেতরে?’ আমি বললাম, ‘আপনি তো ব্যাটারিচালিত রিকশায় নিয়ে যাবেন, ভেতরে গেলেই কী? আর সামনে থাকলেই বা কী?’ বোঝা গেল যুক্তি শুনে অটোরিকশার ড্রাইভার আমার ওপর খুব বিরক্ত হলেন। কোনো কথা না বলে তিনি চলে গেলেন। বিষয়টা ক্ষুদ্র, কিন্তু এর তাৎপর্য গভীর। মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকে তার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার কারণে। কিন্তু বর্তমান যুগে আমি মানুষের মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার ঘাটতি দেখছি প্রকটভাবে।

বর্তমানে দেশে প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে চলছে অরাজকতা। কোনো এক অফিসে অফিস সহায়ককে ভোর ৬টায় ২০ বার ফোন দিলেও ফোন ধরে না। ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমায়। পরে জানা গেল সারা রাত সে ফোনে কথা বলে, টিকটক করে। এমন অবস্থা শুধু ওই অফিসে নয়, সারা বাংলাদেশের চিত্র। প্রথিতযশা চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘আমাদের ডিজিটাল পদ্ধতি বা মোবাইল ফোনের যেভাবে অপব্যবহার হচ্ছে তাতে মনে হয় না আমাদের এই প্রজন্ম খুব বেশিদিন প্রতিবন্ধী না হয়ে থাকতে পারবে।’ তিনি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাতের সময়টাকে সম্পন্নভাবে এড়িয়ে চলতে বলেছেন। তা না হলে আমাদের রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘১০ বছর থেকে শুরু করে সব বয়সের রোগীদের একই সমস্যা- কানে শুনি না, লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারি না।’

মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে ৪০ শতাংশ শিশুর চোখ চরমভাবে আক্রান্ত। চোখের জলীয় অংশ শুকিয়ে গেছে আরো ৬০ শতাংশ শিশুর। চোখের শুষ্কতাবিষয়ক প্রথম উচ্চতর গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। পুরো ব্যাপারটিকে মহামারি আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যে জীবন প্রণালী আমাদের সম্পূর্ণরূপে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে সেটি কি উন্নয়ন, নাকি আধুনিকতা, নাকি জাতির সর্বনাশ তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

মানুষ শারীরিক পরিশ্রম না করলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। তখন মানুষ খোঁজে সহজে অর্থ আয়ের রাস্তা, যা সম্প্রতি আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, ‘অনলাইন জুয়ায় জড়িত ৫০ লাখ মানুষ।’ আমার পরিচিত একজনের বাস্তব জীবনের গল্প বলছি- প্রত্যন্ত গ্রামের ওই যুবক অনলাইন জুয়ায় ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সাত লাখ টাকা আয় করে। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামের আরো অনেকেই অনলাইন জুয়ায় জড়িত হয়। সম্প্রতি অন্যদের জুয়ায় উদ্বুদ্ধ করা সেই যুবক অনলাইন জুয়ায় ঋণগ্রস্ত হয়ে বাবার জমি বিক্রি করে ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করল।

নিজের প্রয়োজনে এক অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বড় ভাইকে ফোন করলাম। অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় সময়ে তখন সেখানে রাত সাড়ে ৯টা। ফোন করলে ঘুম ঘুম কণ্ঠে ভাই বললেন, তিনি ঘুমাচ্ছেন। আমি তো তাজ্জব। আমি জিজ্ঞেসা করলাম, এত দ্রুত কিভাবে ঘুমাচ্ছেন ভাই? উত্তরে তিনি বললেন, সকাল ৫টায় ঘুম থেকে ওঠেন এবং দূরবর্তী প্রতিষ্ঠানে অফিস করেন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে। সুতরাং তাড়াতাড়ি না ঘুমালে অফিস করা কঠিন হয়। আমাদের দেশে অফিস, স্কুল, ব্যাংক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান সব কিছুই খুব সকালে শুরু করলে কর্মরত সবার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাতের ঘুম নিশ্চিত করতে পারলে শারীরিক ও মানসিক অনেক রোগ থেকেই মানুষ রক্ষা পাবে।

জাপানের মতো উন্নত দেশে ছেলে ও মেয়েরা হাতে টানা রিকশা চালানোকে জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি। এক কোটি ৭০ লাখ মানুষের জন্য সাইকেল আছে দুই কোটি ৩০ লাখ। সেখানে প্রায় শতভাগ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সামর্থ্য রয়েছে। তবু সাইকেল তাদের প্রথম ও একমাত্র প্রেম। সাত বছর বয়স থেকে শুরু হয়ে এই প্রেম ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত অটুট থাকে। স্কুল, অফিসসহ সবখানে যেতে তারা সাইকেলে চেপে বসে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা একান্ত জরুরি।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়