প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গণঅভ্যুত্থানের একমাস পূর্ণ হওয়ায় শহীদদের স্মরণ
চাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের ‘শহীদি মার্চ’ পালন
ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্ণ হওয়ায় শহীদদের স্মরণে চাঁদপুরে ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ, চাঁদপুর। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেলে চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড প্রাঙ্গণে সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় নতুন বাংলাদেশের সংস্কার সাংবিধানিকভাবে হোক এমন প্রত্যাশার কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের চাঁদপুরের আন্দোলনকারী সমন্বয়করা।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ, চাঁদপুর-এর আয়োজনে একটি মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। সেখানে শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। র্যালিটি বাসস্ট্যান্ড ফয়সাল মার্কেট, ইলিশ চত্বর হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে গতকাল ৫ সেপ্টেম্বর। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ক্ষমতাচ্যুত সদ্য সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। এ গণঅভ্যুত্থান সফল করতে দেশের প্রায় এক হাজার মানুষ জীবন বিলিয়ে দেন। আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকশ ছাত্র-জনতা। নিহতদের স্মরণে ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
গত জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগসহ তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা-নির্যাতনের এক পর্যায়ে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে সরকারি নির্দেশে পাখির মতো গুলি করে মারা হয় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীকে। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা। যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে।
এদিকে সরকার পতনের পর গত ৩০দিনে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আর্থিক খাতসহ নানা পর্যায়ে বেশ কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে অন্তর্র্বতী সরকার। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে। সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে বিভিন্ন অঙ্গনে।
এর আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। একই দিনে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ ঘোষণা করেন। পতিত সরকারের ইশারায় দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে ২০২০ সাল থেকেই কারান্তরীণ ছিলেন তিনি। ওই দিনই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের নিয়োগ বাতিল করে ময়নুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে নতুন ডিএমপি কমিশনার নিয়োগসহ পুলিশ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল আনা হয়। পরদিন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ পদত্যাগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ আগস্ট পর্যন্ত পদত্যাগ করেন মোট ৬৭ জন আইন কর্মকর্তা।
এর আগেই ৮ আগস্ট সিনিয়র আইনজীবী মোঃ আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। একই দিন শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্র্বতী সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৬ আগস্ট শপথ নেন আরও চার উপদেষ্টা। তার আগে ১০ আগস্ট ফুলকোর্ট সভা ডেকে পরে তা বাতিল করেন পতিত সরকারের আমলের প্রধান বিচারপতি। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওইদিনই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সৈয়দ রিফাত আহমেদ নিয়োগ পান সেদিনই। ১২ আগস্ট আরও চার বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
অন্যদিকে, হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে পদ থেকে সরে দাঁড়ান বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ আগস্টের উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠক থেকে বাতিল করা হয় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সরকারি ছুটি। ১৫ আগস্ট সারা দেশের নেতা-কর্মীদের ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে জমায়েত হওয়ার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ ও অবস্থানের কারণে তারা সে কর্মসূচি পালন করতে পারেননি।
ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার ফোকলা হয়ে যাওয়া অর্থনীতির ব্যাপক সংস্কারেও মনোনিবেশ করে। এর অংশ হিসেবে লুটপাটকারীদের দোসর ও বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পদত্যাগ করেন ১০ আগস্ট। তিন দিন পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। একইদিন শেয়ারবাজার ও অর্থ লুটপাটকারী শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গ্রেফতার হন। এরপর একে একে গ্রেফতার করা হয় জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি তানভীর হাসান সৈকত এবং এনটিএমসির ডিজি ও বহু গুম-খুনের হোতা জিয়াউল হাসানকে। লটুপাটকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে একে একে ভেঙ্গে দেওয়া হয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ।
১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। এরপর সারা দেশে শেখ হসিনা ও তার মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে মামলার হিড়িক পড়ে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে পতিত সরকারের শেষ সময়ে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় অন্তর্র্বতী সরকার।
আগামী নির্বাচন এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সম্প্রতি মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। গত সোমবার স্পিকারের পদ থেকে সরে দাঁড়ান ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন কাজী হাাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
প্রশাসনে সংস্কারের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বঞ্চিত আমলাদের পদোন্নতি দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে কয়েকটি জেলার প্রশাসককে। এসব জায়গায় পদায়ন করতে ফিট লিস্ট তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নিয়মিত গ্রেফতার অভিযান চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত মঙ্গলবার রাত থেকেই সারা দেশে একযোগে যৌথ অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।