বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০

রেমাল তাণ্ডবের ক্ষতির চিহ্ন ফুটে উঠছে

চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের ১২৬ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত

সমাজকল্যাণমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েলের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন

মিজানুর রহমান ॥
চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের ১২৬ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত

চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় রেমাল তাণ্ডবের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন ফুটে উঠছে। চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার অংশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুরো জেলায় অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়েছে বহু। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। প্রায় ২৪ ঘন্টা পুরো চাঁদপুর জেলা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিলো। রোববার শেষ রাত থেকে সোমবার শেষ রাত পর্যন্ত প্রায় ২৪ ঘন্টা চলে রেমাল তাণ্ডব। রেমাল বিধ্বংসী রূপ নেয় সোমবার দুপুর ২টার পর থেকে। রাত ১০টা পর্যন্ত প্রায় ৭ ঘণ্টা চলে রেমাল তাণ্ডব। কিছুক্ষণ পর পর থেমে থেমে তীব্র বেগে ঝাপটা মারে ঝড়ো বাতাস। এতো দীর্ঘসময় ঘূর্ণিঝড় ইতিপূর্বে কেহ দেখেনি। ঘূর্ণিঝড়ের সময়টাতে প্রবল বেগে বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস পরিস্থিতিকে বেসামাল করে তোলে।

রোববার রাত আটটার দিকে উপকূলে আছড়ে পড়ার মধ্য দিয়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালাতে শুরু করে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। আঘাত হানার পর কিছুটা দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে রূপ নিলেও প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চালায়। এর প্রভাব থেকে বাদ যায়নি নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা চাঁদপুর।

চাঁদপুরের মেঘনা পাড়ের মানুষ যেনো সুনামি দেখেছে। সোমবার বিকেল হতে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে চলে মেঘনার ঢেউয়ের তাণ্ডব। নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় শহর রক্ষাবাঁধের আটটি পয়েন্টের প্রায় কয়েকশ’ মিটার এলাকা। বসতঘর, গোয়ালঘর, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সোমবার সকাল থেকে চাঁদপুরের উপর দিয়ে তুমুল ঝড় বৃষ্টি বইতে থাকে। চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা নদী সাগরের মত উত্তাল হয়ে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে শহর রক্ষাবাঁধ ও নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে।

এদিনের প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার রনাগোয়াল হতে হরিসভা, বাকালিপট্টি, দোলমন্দির পর্যন্ত ১৬৫ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধের পাশে থাকা ১০-১৫টি বসতঘর, গোয়ালঘর ও দুটি মন্দিরের অংশ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব ও নিম্নচাপ কেটে যাবার পর নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ২৭ মে সোমবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মেঘনা নদীর বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের উপর। সমুদ্রের ঢেউও যেনো হার মেনেছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নদী এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে রেখে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন ফুটে ওঠে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় প্রতিনিধি ও চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল ছুটে আসেন নদীর ভাঙ্গন স্থান দেখার জন্যে।

স্থানীয়রা জানান, সোমবার বিকেল থেকে পদ্মা মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এ সময় তীব্র ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে বড় বড় ঢেউ চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধে আঘাত এনে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়ে। বিশেষ করে পুরাণবাজার রনাগোয়াল, হরিসভা, পুরাতন ফায়ার সার্ভিস, মাছবাজার, বাকালী পট্টি, রামঠাকুর দোলমন্দির ও বাজার সংলগ্ন তালুকদার বাড়ির প্রায় ১০ থেকে ১৫টি বসতঘর মেঘনার প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙ্গে নদীতে তলিয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আরও অনেক পরিবার ঘর-বাড়ি ছেড়ে মালপত্র সরিয়ে নিয়েছে। চাঁদপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ আলী মাঝি বলেন, বিকেল ৩টার পর মেঘনা নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। এলাকাবাসী জানায়, এমন ঢেউ আমরা আগে কখনো দেখেনি। পৌরসভার সাবেক কমিশনার নজু বেপারী জানান, এই ঝড়ের কারণে পুরাণবাজার হরিসভা এলাকার মন্টু গাজীর ভাড়াটিয়া বাবুল ঢালীর বসতঘর ও মাংস ব্যবসায়ী শাহাদাতের বসতঘর, গরুর খামার নদীতে বিলীন হয়। তার দুটি গরু নিখোঁজ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত নদীর পাড়ের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্যে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। এদিকে এই পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চালায়।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুর পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমেলের প্রভাবে মেঘনা নদীতে জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পেয়ে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় এবং প্রবল বেগে দমকা ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। এতে সাগরের মত বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে বাঁধের উপর।

চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার অংশের ৮টি পয়েন্টের প্রায় ১৬৫ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো সংরক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালিভর্তি জিওব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু করেছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র পরিচালক সালাউদ্দিন মোঃ বাবর জানান, নদীর পাড়ে তাদের জায়গার উপর বাবা-মায়ের নামে একটি মাদ্রাসা করা হয়। সেটি জলোচ্ছ্বাস ঢেউয়ের আঘাতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

পাশের আরেকজন ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি তার সরিষা তেলের মিলের ভেতর ছিলেন এবং দেখেছেন অনবরত ঢেউয়ের তাণ্ডব। এমন ঢেউ তিনি সুনামিতে বা উত্তাল সাগরে হতে দেখেছেন। তার মিলের পেছনের অনেক সিসি ব্লক দেবে গেছে।

বাকালী পট্টির মাংস ব্যবসায়ী সাহাদাত জানান, তার বসতঘর, গোয়ালঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গোয়ালঘরের দুটি গবাদি পশুর এখনো খোঁজ পাননি।

হরিসভা জগন্নাথ মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সহদেব ডাক্তার জানান, ঝড়ের তাণ্ডবে হরিসভা মন্দির এলাকার দুটি মন্দির ও ৮-১০টি বসতঘরের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

কার্তিক সাহা বলেন, বর্ষা এলে প্রতি বছর নদীতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এরই মধ্যে অনেকেই বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ভাঙ্গন দেখা দিলে কর্মকর্তারা আসেন নদীতে বালির বস্তা ফেলতে। আমরা স্থায়ী সমাধান চাই। যে পরিস্থিতি, রাতে বাড়ি-ঘর টেকে কি-না তা নিয়ে শঙ্কিত।

ক্ষতিগ্রস্ত সাবিত্রি সাহা ও সবিতা সাহা বলেন, ঘর ভাঙ্গনের আর কিছু নেই। আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। বাঁধ ভাঙ্গার কারণে এবারও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের কাছে দাবি করছি, এখানে যাতে দ্রুত স্থায়ী বাঁধ করা হয়।

২৮ মে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শহরের পুরাণবাজার হরিসভা মন্দির ও বাকালি পট্টি এলাকাসহ কটি স্থানে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গন স্থানে শ্রমিকরা জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলা অব্যাহত রেখেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মকর্তারা কাজের তদারকি করছেন।

এদিকে ভাঙ্গন স্থান পরিদর্শন করেছেন চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল। তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপির পক্ষ থেকে আমি ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের কাছে ছুটে এসেছি। নদী ভাঙ্গনে পুরাণবাজার এলাকায় ১০-১২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে। আপনারা জানেন, আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের প্রচেষ্টায় চাঁদপুর শহর রক্ষায় এখানে স্থায়ী বাঁধ হবে, সেটির টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান। ৮২৭ কোটি টাকার শহররক্ষা বাঁধ প্রকল্পটি হয়ে গেলে আর আমাদের মধ্যে আতঙ্ক থাকবে না।

জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, পুরাণবাজার শহর রক্ষা বাঁধে ভাঙ্গনের খবর পেয়েছি। এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু করেছে। ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। আশাকরি বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবে না।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে চাঁদপুরে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বহু গাছপালা উপড়ে পড়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বসতঘরের চালা উড়ে গেছে। চাঁদপুর থেকে লঞ্চ ও ফেরি চলাচল বন্ধ ছিলো দুদিন। প্রায় ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল চাঁদপুরবাসী।

স্থানীয় আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানানো হয়, সোমবার বিকেল ৩টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় চাঁদপুর জেলায় ১০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর সকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৭২ মিলিমিটার। দুপুর আড়াইটার পর থেকে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ৩১ নটিক্যাল মাইল বা ৫৭ কিলোমিটার।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে ২৭ মে সোমবার সারাদিন চাঁদপুর জেলায় ভারি বৃষ্টিপাত এবং ঝড়ো হাওয়ায় গাছ উপড়ে ফরিদগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলায় বিদ্যুৎ লাইনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সোমবার সারাদিন চাঁদপুর জেলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ চালু না হওয়ায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের চিঠির আলোকে কচুয়া ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়