প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২১, ০০:০০
চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের বিভাজন স্পষ্ট
দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থানকারীরা এক প্লাটফর্মে
চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিরোধ বা বিভাজন এখন আর গোপন কিছু নয়। বিরোধটা এখন জনসম্মুখে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। দলীয় এবং জাতীয় নানা কর্মসূচি/অনুষ্ঠান এখন পৃথক পৃথকভাবে করা হয়। যেটি স্পষ্ট দেখা যায় ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এবং গত ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। এই বিরোধটা মূলত প্রকাশ্য রূপ নেয় চাঁদপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনের পর থেকে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে- এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন এমনকি দলীয় প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তারা সবাই এখন এক প্লাটফর্মে একত্রিত হয়েছেন। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থানকারীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বলয়ে গড়ে ওঠা গ্রুপে সক্রিয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে তারা একসাথ হতে না পারলেও এখন দলের বিভাজন সৃষ্টিতে এক হওয়ার কৃতিত্ব (?) তারা দেখাতে অবশ্য সক্ষম হয়েছেন। যদিও বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভরাডুবি জানান দিয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা অবস্থান।
|আরো খবর
গত ১৭ মার্চ ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী। গত বছরের এই সময়ে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদ্যাপিত হয় নি। তাই এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীও উদ্যাপন হয়েছে ১৭ মার্চ। ১৭ মার্চের মতো একটি উল্লেখযোগ্য দিবসের অনুষ্ঠান এবার পৃথকভাবে উদ্যাপন করেছে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ। একটি অংশ উদ্যাপন করেছে সংগঠনের জেলা সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর নেতৃত্বে, আর অপর অংশ উদ্যাপন করেছে জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মোঃ ইউসুফ গাজী ও ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুসহ আরো বেশ ক’জন নেতার নেতৃত্বে। উভয় গ্রুপের অনুষ্ঠান চাঁদপুর শহরেই হয়েছে। স্থানের দূরত্ব তেমন একটা ছিল না। তবে সময় খানিকটা আগ-পর ছিল। সেদিন শহরে অনেকটা উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করলেও আশার কথা হচ্ছে কোথাও কোনো ধরনের সামান্যতম সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে নি।
১৭ মার্চের পর গেলো ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনেও দেখা গেলো বিভাজন। জেলা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান করেছে দলীয় কার্যালয়ে, আর পৌর আওয়ামী লীগ করেছে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। এক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া নেতারা অপর অনুষ্ঠানে যান নি। চাঁদপুরে ক্ষমতাসীন দলে এভাবে প্রকাশ্যে দ্বিধা-বিভক্তি জেলায় এখন বেশ আলোচিত বিষয়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে এমন দ্বিধা-বিভক্তির অন্তরালে যাই থাকুক, প্রকাশ্যে যে বিষয়গুলো এসেছে তা হচ্ছে সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচন। এই তিনটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই মূলত প্রকাশ্যে এই বিরোধ-বিভাজন। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত চাঁদপুর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নূরুল ইসলাম নাজিম দেওয়ানের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন চাঁদপুর জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়া। অভিযোগ রয়েছে, দলের প্রার্থীর বিপক্ষে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন জেলার কিছু নেতা। যদিও এ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে এবং তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। একইভাবে ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম রোমানের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ভূঁইয়া। তাকেও জেলা আওয়ামী লীগের কিছু নেতা সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই বিদ্রোহী প্রার্থীরও জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং চরম ভরাডুবি হয়। কিছুদিন আগে ফরিদগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর উপস্থিতিতে ওই বিদ্রোহী ও বিজিত প্রার্থী তোফায়েল আহম্মেদ ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। তখন দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরা ওই বিদ্রোহী প্রার্থীর দিকে তেড়ে যান এবং তীব্র প্রতিবাদ জানান।
এরপর গত বছরের ১০ অক্টোবর হয়ে যাওয়া চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে দলের বিরোধ আরো বেশি প্রকট হয় এবং প্রকাশ্য রূপ নেয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডঃ মোঃ জিল্লুর রহমান জুয়েল। এই নির্বাচনে দলের মনোনয়ন যুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন তৎকালীন মেয়র জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ এবং জিল্লুর রহমান জুয়েল। শেষ পর্যন্ত জিল্লুর রহমান জুয়েল দলের মনোনয়ন পান। তিনি মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রথমদিকে নাছির উদ্দিন আহমেদ সহযোগী মনোভাব দেখালেও পরবর্তীতে অজানা কারণে পিছটান দেন। এ নির্বাচনে দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে মাঠে সক্রিয় দেখা গেলেও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নির্বাচনী কার্যক্রমে তেমন একটা দেখা যায় নি। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার ভাই এবং তাঁর ভাগিনা উচ্চ আদালতে পর পর দুটি মামলা করেছেন পৌর নির্বাচন স্থগিত চেয়ে। এর উপর অবশ্য পরে আর শুনানি হয় নি। এরই মধ্যে ১০ অক্টোবর যথারীতি নির্বাচন হয়ে যায়। নির্বাচনের দিনও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মাঠে তেমন কোনো ভূমিকায় দেখা যায় নি। এদিকে নির্বাচনের পর দলীয় প্রার্থীর বিজয়ে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো অভিনন্দন না জানানোয় রাজনীতির মাঠে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়। শুধু তাই নয়, বিজয়ী প্রার্থী জিল্লুর রহমান জুয়েলের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার বিষয় ছিল।
মূলত এই তিনটি নির্বাচন নিয়েই জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এক গ্রুপ হয়ে যায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর নেতৃত্বে। আর অপর গ্রুপ হয় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র ইউছুফ গাজী, সহ-সভাপতি ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপুসহ সাংগঠনিক সম্পাদকদের নেতৃত্বে। দেখা গেছে যে, উল্লেখিত দুই নির্বাচনে যারা দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তারা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপে ভিড়েন। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্যে এমন দ্বিধা-বিভক্তিতে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরা খুবই বিপাকে পড়েন। তারা দলের কোনো অনুষ্ঠান হলে কোন্ পক্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তা নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েন। তারা যত দ্রুত এর অবসান চান। তবে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের সময় জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের এমন ভূমিকা এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়া নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেন নি।