প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
কমে যাচ্ছে চাঁদপুরকেন্দ্রিক নৌপথের যাত্রী
প্রায়শই পরিবর্তন হচ্ছে লঞ্চের সময়সূচি
শত বছরের অধিক সময় ধরে চাঁদপুর অঞ্চলের মানুষের নদীপথে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম চাঁদপুর লঞ্চঘাট ও নদীবন্দর। দেশের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক এলাকা পুরাণবাজার গড়ে উঠেছে এই নদীবন্দরকে কেন্দ্র করেই। যাত্রী সাধারণের আসা-যাওয়া, মালামাল লোডিং-আনলোডিং, ঘাটে যানবাহনের জটলা, যাত্রী, চালক, ব্যবসায়ী, হকার, দোকানপাট, নদীবন্দরের কর্মচারী, নৌকা ও ট্রলার মাঝি, লঞ্চের যাত্রীতে নিজ নিজ ব্যস্ততায় মুখরিত থাকতো ঐতিহ্যবাহী চাঁদপুর নদীবন্দর ও লঞ্চঘাট।
|আরো খবর
নানা কারণে সেটির জৌলুস হারিয়ে গেছে অনেকখানি। মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর ভাঙ্গন, বর্ষা মৌসুমে শহর রক্ষা বাঁধের বড় স্টেশন সংলগ্ন তিন নদীর মিলনস্থলে প্রবল ঘূর্ণিস্রোত, নৌদুর্ঘটনা রোধে পুরানো স্থান (ডাকাতিয়া তীর) থেকে লঞ্চঘাট স্থানান্তর, ইচলী লঞ্চঘাট ও চাঁদপুর রকেট ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ক্রমশ কমে যাচ্ছে এখানকার নদীপথের যাত্রী।
করোনার সময় থেকে লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধি এবং পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পরই গত এক বছরে নদীবন্দর তথা লঞ্চঘাটের সেই পুরানো ব্যস্ততা এখন আর চোখে পড়ে না। নৌ যাত্রীদের কোলাহল কমে গেছে অনেকটাই। অনেকে বলছেন, সড়ক পথে দ্রুত যাওয়া যায় বলে নদীপথে লঞ্চের যাত্রী কমে যাচ্ছে।
চাঁদপুর-ঢাকা নৌরুটের এমভি প্রিন্স অব রাসেলের চাঁদপুর ঘাট সুপারভাইজার রুহুল আমিন হাওলাদার জানান, ঘোষেরহাট, পয়সারহাট, রাঙ্গাবালি, তুষখালি, হুলারহাটে তার ৫টি লঞ্চ ছিলো। এগুলো চাঁদপুর ঘাট ধরতো। পদ্মা সেতু হবার পর এসব রুটের লঞ্চ আসা বন্ধ হয়ে গেছে। চাঁদপুর-ঢাকা রুটে তার যে রাসেল লঞ্চটি রয়েছে, যাত্রী সংকটে সেটি এখন সপ্তাহে ১ দিন চলছে। একটা ট্রিপ দিলে লঞ্চ মালিকের ৮০ হাজার টাকা লস হচ্ছে। এডভেঞ্চার লঞ্চটি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ছিলো, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
সোনারতরী লঞ্চ কোম্পানির চাঁদপুর ঘাটের মালিক প্রতিনিধি প্রবীণ ঘাট সুপারভাইজার শওকত বেপারী জানান,
ঈদের ১০-১২ দিন তার কোম্পানির সব লঞ্চই চলেছে। এখন ঈদ-যাত্রীর চাপ নেই। যাত্রী সংকটের কারণে তাদের ৪টি লঞ্চের মধ্যে তিনটি চলছে।
ঈগল ও ময়ূর লঞ্চের চাঁদপুর ঘাট সুপারভাইজার আলী আজগর সরকার জানান, আগের তুলনায় লঞ্চে এখন যাত্রী কমে গেছে। মালিকের লস হচ্ছে জেনেও যাত্রী সেবা করে যাচ্ছে। তাদের ঈগল-৩ লঞ্চটির এক ট্রিপে খরচ লক্ষাধিক টাকার উপরে। চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে প্রতিদিন সকাল ৯টায় অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ যাত্রী নিয়ে সেটি ছেড়ে যেতো। এখন ২-৩শ’ যাত্রী হয় না।
আলী আজগর আরো জানান, তাদের ময়ূর-৭ লঞ্চটি অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনায় ডকে রয়েছে। কাজ শেষে সেটি লাইনে আসতে ৫-৬ মাস সময় লাগতে পারে। আপাতত রাত সোয়া ১২টার সময়সূচিতে ময়ূর-১০ লঞ্চটি নিয়মিত চলাচল করছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, লঞ্চে যাত্রী তেমন নেই। ঘাটে এমভি সোনারতরী-২ ঢাকার যাত্রী উঠাচ্ছে। বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটের সময়সূচির এ লঞ্চটি যাত্রী আর যাই হোক নিয়মিত চলাচল করছে। ঘাটের লোকজন ও যাত্রীর স্বজনদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চে যাত্রী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। দ্রুত যাওয়ার জন্যে মানুষ নদীপথ পরিহার করে চাঁদপুর-বাবুরহাট-মতলব পেন্নাই সড়ক পথটাকেই বেছে নিয়েছে। কিছুটা আরাম ও নির্ঝঞ্ঝাটে যাওয়া যায় বলে এখন শুধু রোগী ও পরিবার-পরিজন নিয়ে একত্রে যাওয়ার জন্যেই লঞ্চে উঠছেন যাত্রীরা।
বাবুরহাট বাজারের বাসিন্দা সবুজ মাল (৩৫) বলেন, ঢাকায় কাজ করার সুবাদে আগে লঞ্চেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন। লঞ্চে ভাড়া বেশি, ঢাকা পৌঁছতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। আর সড়ক পথে বাসে দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই যাওয়া যায়। তাই এখন লঞ্চে যাওয়া হচ্ছে না, বাবুরহাট থেকে জৈনপুরী বাসে ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
ফরিদগঞ্জের ভাটিয়ালপুর গ্রামের বাসিন্দা লাকি বেগম বলেন, বাসে উঠলে অসুস্থ হয়ে যাই। তাই লঞ্চে যাচ্ছি। বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর লঞ্চঘাটের টিআই শাহআলম জানান, স্বাভাবিকভাবেই সড়কপথের ‘উন্নয়নের আঘাত’ লেগেছে। তাই লঞ্চে যাত্রী কম হচ্ছে। সিডিউল অনুযায়ী চাঁদপুর-ঢাকা রুটে ২৭টি, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে ১৪টি ও দক্ষিণাঞ্চল রুটে ৯টি লঞ্চ চলাচল করার কথা। তার স্থলে চাঁদপুর-ঢাকা রুটে ২০-২২টি, নারায়ণগঞ্জ রুটে ১০-১১টা এবং দক্ষিণাঞ্চলের রূটে ৫টি লঞ্চ চলছে। এছাড়া এমভি আবে-জমজম ও ময়ূর-১০ নামের এ দুটি চারতলা লঞ্চ চলাচল করছে। তিনি আরো জানান, বুধবার ২২টা ও বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ১৫টা লঞ্চ যাত্রী নিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে।
এদিকে চাঁদপুর লঞ্চঘাট সূত্রে জানা যায়, ইচলী ঘাটটি নারায়ণগঞ্জগামী দুটি দেড়তলা লঞ্চ দিয়ে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু যাত্রী না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ডাকাতিয়া নদীর ওপর নির্মিত চাঁদপুর শহরের নতুনবাজার-পুরাণবাজার ব্রিজের জন্য ইচলী যাওয়ার পরিবেশ নেই। এ কারণে ইচলী-চাঁদপুর-ঢাকা নৌরুটটি চালু করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
অপর দিকে যাত্রীর অভাবে সিডিউল অনুযায়ী অনেক লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে মালিকপক্ষ। বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর ঘাটের সহকারী পরিচালক শাহাদাত হোসেন জানান, বিদেশী অর্থায়নে চাঁদপুরে আধুনিক টার্মিনাল ভবন নির্মিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক কাজও শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান চাঁদপুর লঞ্চঘাটেই হবে নতুন লঞ্চঘাট ও টার্মিনাল ভবন। তখন অন্যরকম পরিবেশ এখানে তৈরি হবে এবং যাত্রীরা নৌপথে যাতায়াতে আরো বেশি আকৃষ্ট হবে। তিনি বলেন, এখন লঞ্চে যে পরিমাণ যাত্রী হচ্ছে, তখন নৌপথের যাত্রী আরো বাড়বে বলে আশা করছি।