প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:২৩
বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা: বৈষম্য, আন্দোলন এবং সরকারের দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া কল্পনা করা যায় না। দেশের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৫ শতাংশই বেসরকারি, যেখানে লাখো শিক্ষক নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছেন। তবে তাঁদের কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে ন্যায্য অবসর সুবিধা পেতে যে দীর্ঘসূত্রতা ও বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়, তা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়;
|আরো খবর
বেসরকারি শিক্ষকদের ভূমিকা এবং অবহেলার শিকার: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি শিক্ষকরা। তাঁরা দেশের শিক্ষার্থীদের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা এবং বৈষম্যপূর্ণ আচরণ একটি উদ্বেগজনক চিত্র ফুটিয়ে তোলে। ২০২৩ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে ৬০ শতাংশ তাঁদের অবসরকালীন সুবিধা সময়মতো পান না। অবসর সুবিধার অর্থ প্রাপ্তির বিলম্ব কেবল তাঁদের আর্থিক সংকট বাড়াচ্ছে না; এটি শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা নষ্ট করছে। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার শিক্ষক মো. তাফাজ্জল হোসেনের কষ্টকর জীবন এরই একটি দৃষ্টান্ত। ৩০ বছরেরও বেশি সময় শিক্ষা দানে নিবেদিত থাকার পর তিনি ২০২১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু অবসর সুবিধার অর্থ পেতে বিলম্বের কারণে ক্যান্সারের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে তিনি ঋণে জর্জরিত হয়েছেন।
বৈষম্যের প্রকৃতি ও গভীরতা: সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যের মাত্রা গভীর। সরকারি শিক্ষকদের অবসর ভাতা সহজে ও দ্রুত প্রদান করা হলেও বেসরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অবসর সুবিধার অর্থ পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টে জমা থাকা ফাইলগুলোর প্রায় ১০ হাজার এখনো প্রক্রিয়াধীন। এতে অনেক শিক্ষক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করছেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে কিছু অর্থ প্রদান করা হলেও অবসর ভাতা আটকে থাকার কারণে অনেক শিক্ষক চরম আর্থিক দুর্দশায় রয়েছেন।
একটি দৃষ্টান্ত: কুমিল্লার এক শিক্ষক ২০১৯ সালে অবসর গ্রহণের পর টানা চার বছর তাঁর অবসর সুবিধার অর্থ পাননি। এর মধ্যে চিকিৎসার অভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবারের বক্তব্য, "আমাদের বাবার মতো আরও অনেক শিক্ষক মর্যাদাহীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন।"
আন্দোলনের ইতিহাস ও সীমিত ফলাফল: বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। ২০২৩ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েক হাজার শিক্ষকের আন্দোলন ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁরা অবসর সুবিধা দ্রুত প্রদানের দাবি তোলে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সমাধান হয়নি। আন্দোলনের পর কিছু বাজেট বরাদ্দ হলেও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে শিক্ষকরা তা যথাসময়ে পাননি। আন্দোলনকারীদের একজন বলেন, "আমরা শুধু আমাদের প্রাপ্য অর্থ চাই, যা দিয়ে অন্তত শেষ জীবনে শান্তিতে থাকতে পারি।"
আদালতের নির্দেশনা এবং সরকারের উদাসীনতা: বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর ভাতা দ্রুত প্রদানে ২০২৪ সালে হাইকোর্ট একটি নির্দেশ দেয়। এতে বলা হয়, অবসর সুবিধার অর্থ ছয় মাসের মধ্যে প্রদান করতে হবে। কিন্তু এই নির্দেশ উপেক্ষিত হচ্ছে। আদালতের রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনীহা দেশের আইন ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
একাধিক শিক্ষক এই বিষয়ে আদালতে মামলা করেছেন। এর মধ্যে এক শিক্ষক বলেন, "আমরা আদালতে গিয়েও ন্যায়বিচার পাচ্ছি না। এই অবস্থা কি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নয়?"
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সময়মতো প্রদান নিশ্চিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ায় অবসর ভাতা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি রয়েছে। ভারতে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর ভাতা প্রদানে একটি পৃথক নীতিমালা রয়েছে, যা বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলাফল: বেসরকারি শিক্ষকরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেসব আন্দোলন করেছেন, তা অনেক ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে বড় ধরনের পরিবর্তন এখনো অনুপস্থিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য ৩০১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এই বরাদ্দ যথেষ্ট কি? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেসরকারি শিক্ষকদের ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করতে এর তিনগুণ বরাদ্দ প্রয়োজন।
শিক্ষকরাই বেশি বঞ্চিত: বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধার ক্ষেত্রে যে অবহেলা রয়েছে, তা তাঁদের শেষ জীবনে আর্থিক ও মানসিক কষ্ট বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ তাঁদের পেনশনের টাকার জন্য ঋণ করতে বাধ্য হন।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং স্বচ্ছতার অভাব: অবসর সুবিধা প্রদানের প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ না হওয়া এবং দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ছে। ২০২৩ সালে একটি সমীক্ষায় উঠে আসে, বেশিরভাগ শিক্ষকই অবসর সুবিধার আবেদন জমা দেওয়ার পর অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে বাধ্য হন।
সমাধানের পথ: সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
১. প্রক্রিয়া সহজীকরণ: অবসর সুবিধার প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আনা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ।
২. আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি: বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে।
৩. আইনি জবাবদিহি: আদালতের রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সমতা প্রতিষ্ঠা: সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে নীতিমালা প্রণয়ন।উপসংহার: বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা নিয়ে যে বৈষম্য রয়েছে, তা শুধু তাঁদের নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মানকে ক্ষুণ্ন করছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিক্ষকদের সম্মানজনক অবস্থা নিশ্চিত করা। তাঁদের প্রতি অবহেলা জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করার সমান।
শিক্ষকদের অবসরকালীন জীবন যাতে মর্যাদাপূর্ণ হয়, সেই নিশ্চয়তা প্রদান এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রকে উচিত অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষকদের এই বৈষম্যের অবসান ঘটানো।
লেখক: শিক্ষক নেতা,তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।
ডিসিকে/এমজেডএইচ