প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২১, ০০:০০
বর্ষায় নদ-নদী, খালে-পুকুরে পানি বাড়ার সাথে সাথে মাছের আনাগোণাও বেড়ে যায়। আর এই মাছ ধরতে নানা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এসব উপকরণ হাট-বাজারে বিক্রি হয়ে থাকে। গ্রামের প্রতিটি হাট-বাজারে বর্ষায় এসব উপকরণ বিক্রি বেড়ে যায়। তেমনি ফরিদগঞ্জের প্রতিটি হাট-বাজারেও মাছ ধরার উপকরণ বিক্রি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ঘুরে মাছ ধরার উপকরণ যেমন চাঁই, টেঁটার পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে বিক্রেতাদের দেখা গেছে।
ফরিদগঞ্জ অঞ্চলের একমাত্র নদী ডাকাতিয়া। একসময় জোয়ার-ভাটার প্রবল গতিপ্রবাহ থাকলেও এখন ডাকাতিয়া নদী মরা গাঙ। তার সেই ভরা যৌবন এখন অতীত। তবুও নদীমাতৃক দেশের নদীবেষ্টিত জেলার অন্যান্য নদীর পানির চাপ বাড়ছে ফরিদগঞ্জের ডাকাতিয়া নদীতেও। প্রতি বছর নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে নদীতে এবং বিভিন্ন খালে-বিলে, ডোবা-নালায়, জলা-জংলায় ও চরাঞ্চলের জলাশয়গুলোতে বর্ষার নতুন পানি প্রবেশ করে। নতুন পানির সঙ্গে আনাগোনা বেড়ে যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও। তাই পানি বৃদ্ধির এ মৌসুমে পাল্লা দিয়ে মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বিক্রিও বেড়ে যায়। নদী-খাল-বিলসহ বর্ষার পানি প্রবেশ করে এমন সব এলাকার লোকজন বর্ষার এই সময়টায় ব্যস্ত থাকে মাছ ধরা নিয়ে।
বর্ষায় মিঠা পানির মাছ ধরার জন্যে গ্রামের মানুষ ব্যবহার করে বাঁশের তৈরি বিশেষ এক ধরনের ফাঁদ। বাঁশের শলা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার এ ফাঁদের নাম চাঁই। গ্রামাঞ্চলে মাছ ধরার আদি উপকরণ হচ্ছে এই বাঁশের চাঁই। আরো রয়েছে টেঁটা। বাঁশ, বেত দিয়ে তৈরি করা মাছ ধরার এসব সরঞ্জামাদি নিয়ে বিক্রেতারা গ্রামের হাট-বাজারে বসে পড়ে। ফরিদগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাটে বাজারেও এমন চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বর্ষা মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গেই উপজেলা সদরে অবস্থিত বাজার, কালিরবাজার, নয়াহাট, গোয়ালভাওর, ধানুয়া, পূর্ব চান্দ্রা, গাজীপুরহাটসহ ফরিদগঞ্জের প্রায় সব সাপ্তাহিক হাট-বাজারে নানা সাইজের চাঁইসহ মাছ ধরার অন্যান্য উপকরণের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। পেশাদার মাছ শিকারি থেকে শুরু করে সৌখিন শিকারিরাও পর্যন্ত কিনে নিচ্ছেন মাছ ধরার এসব সরঞ্জাম। তাছাড়া টেঁটার চাহিদাও তুমুল। আদিকাল থেকেই মাছ শিকারিদের কাছে টেঁটা খুবই পছন্দের উপকরণ। এই উপজেলার মানুষের মাছ শিকারের জন্যে সবচে বেশি পছন্দের সরঞ্জাম হচ্ছে টেঁটা। বর্ষা মৌসুমে টেঁটা বানানোর হিড়িক পড়ে। টেঁটা বানানোর মিস্ত্রিরাও এ সুযোগে বাড়তি একটা ইনকামের পথ তৈরি করে নেন। উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে টেঁটা বিক্রয়ের অনেক অস্থায়ী দোকানে প্রচুর ক্রেতার ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অন্য বছরগুলোর তুলনায় এ বছর টেঁটা ক্রয়ের চাহিদা বেশ বেড়েছে বলে জানালেন বিক্রেতারা। টেঁটা তৈরি করতে বাঁশের চিকন কঞ্চি (কুড়া) ও নাইলন সুতার প্রয়োজন হয়।
উপজেলার বিভিন্ন হাট ঘুরে জানা গেছে, সারাবছর ধরে চাঁই বুনতে থাকেন গ্রামের নারী ও পুরুষরা। তবে বর্ষার আগে এসব সরঞ্জাম বানানোর ধুম পড়ে যায়। আর বর্ষার শুরু থেকে সেসব সরঞ্জাম স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রির জন্যে উঠানো হয়। চাঁই এবং টেঁটার পাশাপাশি মাছ ধরার ঝাঁকিজাল/খেয়াজাল, ঠেলাজাল (ওঁছা), কারেন্ট জাল ও খলুইয়ের চাহিদাও রয়েছে ক্রেতাদের।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৯নং গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের খোরশেদ মিয়া জানান, মাছ ধরার সামগ্রী তৈরির কাজ তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে করছেন। বর্ষায় এসব সামগ্রীর কদর বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাঁশ, সুতা ও প্লাস্টিকের রশি দিয়ে চাঁই, খলুই, ডালাসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করেন তিনি। তিনি জানান, এসব তৈরিতে প্রকারভেদে খরচ পড়ে ৪০ থেকে ৩০০ টাকা। আর তা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ৫০০ টাকায়। বাঁশের দাম বাড়ায় মাছ ধরার সরঞ্জামের দামও বেড়েছে। ফলে আগের মতো আর তেমন একটা লাভ হয় না।
বিক্রেতারা জানান, মাছ ধরার এসব সরঞ্জাম আকার ও গুণগত মানভেদে বিক্রি হয় বিভিন্ন দামে। আষাঢ় মাসের শুরুতেই কিংবা জ্যৈষ্ঠ মাছের মাঝামাঝি সময় থেকেই মাছ শিকারের এসব সামগ্রী বিক্রি হয় সবচে বেশি।
টেঁটা ক্রয় করতে আসা ইসমাইল পাঠান নামে এক ব্যক্তি জানান, ‘মাছ শিকার করা আমার নেশা। আর এই মাছ আমি টেঁটা দিয়ে শিকার করি। তবে এ বছর টেঁটার দাম তুলনামূলকভাবে একটু বেশি।’
নয়াহাট বাজারে কথা হয় টেঁটা বানানোর এক মিস্ত্রির সঙ্গে। তিনি জানান, সারাবছরই বন্ধ থাকে তাদের আয়-রোজগার। তখন কৃষিকাজ করে সময় কাটান। কারণ, বৃষ্টির সিজন শুরু হলেই টেঁটার চাহিদা বাড়ে তাদের। প্রতি হাটে তারা কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০টি টেঁটার কাজ করতে পারেন। কোনো কোনো দিন এর চাহিদা আরও বেড়ে যায়।