প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
চলতি অর্থ বছর সকল সরকারি কাজে ৬০ শতাংশ ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও চাঁদপুরে এর ব্যবহারের হার শূন্য। সরকারের সকল উন্নয়ন ও সংস্কার কাজে পরিবেশ দূষণকারী মাটির ইটের বদলে কংক্রিট ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সকল সরকারি প্রকল্পে ৬০ শতাংশ ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনাও রয়েছে। ২০১৯ সালে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এই নির্দেশের ব্যত্যয় হলে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। এই বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। এতো কিছুর পরও চাঁদপুর জেলার কোনো সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পেই ব্লক ব্যবহৃত হচ্ছে না। এমনকি নিকটবর্তী কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনিসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও সরকারি কাজে ব্লক ব্যবহার দৃশ্যমান হচ্ছে না। এ জন্যে সরকার উৎসাহিত করলেও পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপন নিরুৎসাহিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ জেলায় শতাধিক ইটভাটা বৈধ-অবৈধভাবে চালু থেকে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করে চলেছে। যদিও জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদফতর অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে সক্রিয় রয়েছে।
কেন সরকারের উন্নয়ন কাজে বাধ্যতামূলক কংক্রিট ব্লক ব্যবহার কার্যকর হচ্ছে না জানতে চাইলে সরকারের অনেক দফতরের সংশ্লিষ্টদের কাছে এখনও বিষয়টি অজানা। তারা স্বীকার করেন, এই বিষয়ে তেমন প্রচারণা না থাকায় গণসচেতনতার অভাব রয়েছে। এছাড়া প্রধান প্রকৌশলী বা মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না। এ জন্যে সরকারের প্রতিটি প্রকল্পের দরপত্র সিডিউলের শতের্ বাধ্যতামূলক ব্লক ব্যহারের নির্দিষ্ট হার উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
জানা গেছে, মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার আলোকে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্লক ব্যবহার বৃদ্ধির জন্যে সংশ্লিষ্ট দরপত্র সিডিউলে বাধ্যতামূলক ব্লক ব্যবহার সংক্রান্ত শর্ত এবং ব্লক ব্যবহারের হার সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে রুজুকৃত ৯১৬/২০১৯নং রীট মামলার ২৬/১১/২০১৯ তারিখের আদেশ অনুযায়ী গঠিত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটির একটি সভা ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীর ২নং সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘সদস্যগণ সরকারি নির্মাণ কাজে ব্লক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যে সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে সংশ্লিষ্ট দরপত্র সিডিউলে বাধ্যতামূলক ব্লক ব্যবহার সংক্রান্ত শর্ত এবং ব্লক ব্যবহারের হার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার বিষয়ে সর্বসম্মত মত প্রকাশ করেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত চাঁদপুরসহ দেশের কোনো সরকারি উন্নয়ন কাজে প্রতিফলিত হয়নি।
উল্লেখ্য, পুরো চাঁদপুর জেলায় ইটভাটার সংখ্যাধিক্য রয়েছে। বহু ইট ভাটা প্রশাসনের তৎপরতায় বন্ধ হয়ে গেলেও এখনও শতাধিক ইট ভাটা বৈধ ও অবৈধভাবে চলছে। এর ফলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে। সরকারি কাজে ব্লক ব্যবহার শুরু না হওয়ায় এবং অবাধে ইটভাটার কার্যক্রম চালু থাকায় পরিবেশ বান্ধব ব্লক উৎপাদন কারখানা গড়ে উঠছে না। অথচ ২০২৫ সালের পর সরকারের কোনো উন্নয়ন এবং সংস্কার কাজে মাটির ইট ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। সরকারের প্রকল্পগুলোতে ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা কার্যকর করা হলে এ জেলায় নতুন নতুন ব্লক উৎপাদন কারখানা তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মত প্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী এলাকায় প্রিমিয়াম ইকো ব্লকস লিমিটেড নামে একটি স্বয়ংক্রিয় ব্লক উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারখানায় কংক্রিট হলো ব্লক, সলিড ব্লক, ইউনি পাভেরসহ ৯ ধরনের ব্লক উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু উদ্যোক্তরা হতাশা প্রকাশ করে জানান, সরকারের কাজে ব্লক ব্যবহার না হওয়ায় জনগণ বাড়ি নির্মাণে ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে না। উৎপাদিত ব্লক বিক্রি হচ্ছে না। অথচ ইটের চেয়ে ব্লক অনেক বেশি শক্তিশালী এবং টেকসই। ব্লক নির্মিত বাড়ি ভূমিকম্প প্রতিরোধক। পাশাপাশি তাপ ও শব্দ নিরোধক বলে জানা গেছে। একটি হলো (ভেতরে ফাঁপা) ব্লক প্রচলিত ৫টি ইটের সমান বলে জানা গেছে। এ জন্যে ব্লক নির্মিত ভবন নির্মাণে খরচ কম পক্ষে ৩০ শতাংশ কম হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নতুন পণ্য হিসেবে ব্লক ব্যবহার নিয়ে অনেকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন বলে জানা গেছে। অথচ পাশর্^বর্তী ভারতসহ উন্নত দেশগুলোর সকল ভবনই ব্লক নির্মিত।
চাঁদপুরে মানসম্মত ব্লক উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও কেন সরকারি উন্নয়ন কাজে ব্লক ব্যবহার হচ্ছে না জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা প্রকাশ্যে কথা বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তারা স্বীকার করেন পরিবেশ বান্ধব ব্লক ব্যবহার শুরু না হলে দেশে ক্ষতিকর মাটির ইটের ব্যবহার কমবে না। এ জন্যে মন্ত্রণালয় থেকে সঠিক নির্দেশনার পাশাপাশি ব্লক-এর রেট সিডিউল নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। টেন্ডারে বা দরপত্রে শর্ত হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে কংক্রিট ব্লক ব্যবহারের নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করা না হলে ২০২৫ সালে শতভাগ ইট ব্যবহার বন্ধ করার সরকারের পরিকল্পনা সফলতা পাবে না বলেও তারা মনে করেন।
সরেজমিন চাঁদপুর সদরের শাহতলী এলাকায় স্থাপিত জেলার প্রথম সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্লক উৎপাদন কারখানা ঘুরে দেখে এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে, ইটের চেয়ে কংক্রিট ব্লক অনেক বেশি মানসম্মত এবং ব্যয় সাশ্রয়ী। প্রিমিয়াম ইকো ব্লক কারখানায় বিদেশী স্বয়ংক্রিয় মেশিনে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার পিচ সলিড ব্রিক উৎপাদন হচ্ছে। ইটের মতই দেখতে, তবে দেখতে খুবই সুন্দর ও মসৃণ। সহজেই দেয়ালে ব্যবহার করা যায়। প্লাস্টার করার প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া উৎপাদন হচ্ছে দুটি এবং ৩টি ছিদ্র বিশিষ্ট কংক্রিট হলো ব্লক। বিভিন্ন সাইজের হলো ব্লক উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় উন্নত সিমেন্ট, নুড়িপাথর, পাথরগুঁড়ো, মোটাবালু, নদীর চিকন বালু ইত্যাদি। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে উচ্চ হাইড্রোলিক প্রেসারে তৈরি প্রতিটি ব্লক নিখুঁতভাবে উৎপাদন হচ্ছে। মেশিনে একেকটি প্লেট-এ এক সাথে ১২টি করে ব্লক উৎপাদন করা হচ্ছে।
প্রকল্পের ম্যানেজার আশরাফুজ্জামান জানান, উৎপাদিত ব্লক নির্ধারিত পিএসআই শক্তি সম্পন্ন বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং বাংলাদেশ হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট সনদ দিয়েছে। কিন্তু সরকারের কোনো প্রকল্পেই এখন পর্যন্ত ব্লক ব্যবহার শুরু না হওয়ায় উৎপাদিত ব্লক বাজারজাতকরণে সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
জানা গেছে, প্রায় ৬৩ বছরের পারিবারিক ইট ভাটা বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব ব্লক কারখানা প্রিমিয়াম ইকো ব্লকস লিমিটেড স্থাপিত হয়েছে। এখনও ১২০ ফুট লম্বা ইট ভাটার চিমনি বিদ্যমান। পাশেই পরিত্যক্ত ইট-ভাটার জমিতে বিশাল শেডের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে স্বয়ংক্রিয় ব্লক উৎপাদন মেশিন। প্রকল্পের উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, শুধু চাঁদপুর জেলাই নয়, আশপাশের জেলাগুলোতেও প্রিমিয়াম ইকো ব্লকস নামের স্বয়ংক্রিয় কারখানা এটিই প্রথম। তিনি ব্যর্থ হলে এ জেলায় আর কোনো ব্লক উৎপাদন কারখানা গড়ে উঠবে না বলেও হেলাল উদ্দিন আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এসব ব্লক প্রচলিত নয়। সরকারি কাজে ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা কার্যকর না হলে তাকে লোকসান গুণতে হবে। হেলাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইট ভাটার মালিকরা সচেতন নয়। প্রশাসনের দুর্বলতায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সম্বলিত এ এলাকায় বেশ ক’টি ইটভাটা অবৈধভাবে চলছে বলে তিনি দাবি করেন।
চাঁদপুর শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফাহিম ইকবাল বলেন, বর্তমানে আমাদের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তা ২০১৮ সালের আগে সিডিউল করা। যে কারণে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেলে এসব ব্যবহার করা হবে। অবশ্য চলতি বছর থেকেই শতভাগ কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা পেয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। চলতি অর্থ বছরের সকল কাজেই কংক্রিটের ব্লক সিডিউলে ধরা হয়েছে বলে জানান চাঁদপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রকিবুর রহমান।
চাঁদপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চাঁদপুর জেলায় ইটভাটা রয়েছে শতাধিক। যার দুই-তৃতীয়াংশ অনুমোদনহীন। অন্যদিকে কংক্রিটের ব্লক উৎপাদনে জেলায় বেশ ক’টি ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠলেও চাহিদা না থাকায় বন্ধ হয়ে আছে অধিকাংশ কারখানা। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারিভাবে ব্লকের ব্যবহার শুরু করলে সাধারণ মানুষও এসব ব্লক ব্যবহারে আগ্রহী হবে।
প্রিমিয়াম ইকো ব্লক প্রকল্পের ম্যানেজার আশরাফ মজুমদার বলেন, সরকারিভাবে এসব ব্লক ব্যবহার শুরু করলে অবশ্যই সাধারণ মানুষও তা ব্যবহার শুরু করতো। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা না মানায় অনেকেই ব্লক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ব্লক ইট দামে কম, ওজনে হালকা, ব্যয় সাশ্রয়ী এবং অনেক বেশি শক্তিশাল্ ীও টেকসই। খরচ ৩০ শতাংশ কম হওয়ায় অচিরেই জনগণের মধ্যে ব্লক ব্যবহার শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। তবে সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন এবং সংস্কার কাজে, সরকারি ভবন নির্মাণে ইটের বিকল্প এই কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার কার্যকর করা হলে সাধারণ মানুষ ব্লক ব্যবহারে আগ্রহী হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।