প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের যোগসাজশে দলিল লেখক আরিফ হোসেনের অভিনব কৌশলী প্রতারণার শেষ কোথায়? ইতিপূর্বেও তার অভিনব প্রতারণার কয়েকটি সালিস হয়েছে।
নতুন করে আরিফ হোসেনের প্রতারণার শিকার ফরিদগঞ্জ উপজেলার ভোটাল গ্রামের ভুক্তভোগী মামুন হোসেন। তিনি জানান, আমি ফরিদগঞ্জ পৌরসভার কেরোয়া মৌজায় ১.৫ (দেড় শতাংশ) নাল জমি ক্রয় করি। ক্রয়কৃত জায়গা আস্টা গ্রামের দলিল লেখক মরহুম মোখলেছ ভেন্ডারের ছেলে আরিফ হোসেন (সনদ নং ১০৫)-এর মাধ্যমে গত ৫/৯/২০১৬ খ্রিঃ তারিখে ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সাবকবলা দলিলমূলে রেজিস্ট্রি করি এবং দলিল করতে দলিল লেখক আরিফের সাথে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের দলিল করার জন্য কথা ফাইনাল করি। আমি তাকে নগদ ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করি। সে নিজ দায়িত্বে আমার দলিলটি ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সাবকবালা দলিলমূলে করিয়ে দিবেন বলে কথা হয়। কিন্তু দলিল করার পরে ১৮/৯/২০১৬খ্রিঃ তারিখে আমি ফরিদগঞ্জের সাব রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত দলিলের অবিকল নকল কপি উত্তোলন করি। যার দলিল নং ৫৯২৭/১৬। এই কপিতে দেখতে পাই আমার ক্রয়কৃত জায়গার মূল্য ৯ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। তাৎক্ষণিক আমি আরিফ ভেন্ডারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, দলিল লিখতে গিয়ে এটা তার মিস্টেক হয়েছে এবং সমস্যা নেই বলে ‘সরি’ বলেন তিনি।
মামুন হোসেন আরো বলেন, ইতিপূর্বে আমার সাথে একই মৌজার আরেক প্রতিবেশী ববিতা বেগম ২২ লাখ টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করেন। আমি এবং ববিতা বেগম একই দিনে আরিফ ভেন্ডারকে দিয়ে দলিলের কাজ সম্পন্ন করি।
ববিতা বেগম ৪ বছর পর মূল দলিল হাতে পেয়ে দেখেন, তার মূল দলিলে ক্রয়কৃত সম্পত্তির দাম মাত্র ২ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। তখনই আমি বিষয়টি জানতে পেরে আরিফ ভেন্ডারের কাছে আমার মূল দলিল চাইলে সে দলিল না দিয়ে বিভিন্ন টালবাহানা করতে থাকে। পরে আমি নিজে ২০২১ সালে ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রার অফিস থেকে আমার মূল দলিলের নকল কপি সংগ্রহ করি। সেখানে দেখি আমার সম্পত্তির মূল্য ১০ লাখ ৫০ হাজারের জায়গায় মাত্র ১ লাখ টাকা লেখা রয়েছে। (উল্লেখ্য দলিল লেখক আরিফ কর্তৃক নকলে লেখা ৯ লাখ, আর আমার উঠানো নকলে মাত্র ১লাখ লেখা)। পরবর্তীতে গত ২৪/১/২০২১ খ্রিঃ তারিখে আমি এবং ববিতা আরিফ ভেন্ডারের প্রতারণা নিয়ে ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করি। সাব রেজিস্ট্রার আশ্রাফুল ইসলাম বিষয়টি আমলে নিয়ে ফরিদগঞ্জ দলিল লেখক সমিতির সভাপতি হাছান রাজা পাটোয়ারীকে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন। সভাপতি হাছান রাজা পাটোয়ারী ও সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী আবুল বাসার দলিল লেখক আরিফকে নিয়ে ফরিদগঞ্জ দলিল লেখক সমিতির অফিস কক্ষে সালিস বৈঠকের আয়োজন করেন এবং ওই বৈঠকে আরিফের প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সালিসি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ভুক্তভোগী থেকে দলিলের জন্য যে টাকা নেয়া হয়েছে সে টাকা থেকে দলিলে উল্লেকৃত টাকার সরকারি খরচ রেখে বাকি টাকা ভুক্তভোগীদেরকে ফেরত দেয়ার জন্য। উক্ত সালিসি বৈঠকের সিদ্ধান্ত দলিল লেখক আরিফও মেনে নেন এবং সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ববিতা বেগমকে ২০২১ সালে তার বাকি টাকা ফেরত দিলেও মামুনের টাকা আজ-কাল করে অদ্যাবধি ফেরত দেয়নি। উল্টো সে মামুনকে বিভিন্ন ধরনের বাজে কথা বলে। দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফের নানাশ্বশুর। তার সাহসে দলিল লেখক আরিফ বর্তমানে খুব দাপটের সাথে চলাফেরা করছেন এবং মামুন কীভাবে টাকা নেয় সেটা দেখবেন বলে বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি প্রদান করছেন।
এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ দলিল লেখক সমিতির সভাপতি হাছান রাজা পাটোয়ারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ববিতা বেগম ও মামুন হোসেন আমাদের সমিতির দলিল লেখক আরিফ হোসেন (সনদ নং-১০৫)-এর বিরুদ্ধে ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। পরে সাব রেজিস্ট্রার আশ্রাফুল ইসলাম আমাকে দায়িত্ব দেন। অভিযুক্ত দলিল লেখক আরিফ হোসেন আমাদের দলিল লেখক সমিতির সেক্রেটারী আবুল হোসেন গাজীর নাতজামাই। পরবর্তীতে আমরা উভয় পক্ষকে নিয়ে সমিতির অফিস কক্ষে বৈঠকের আয়োজন করি। উভয় পক্ষের কথা শোনার পর আরিফের প্রতারণার প্রমাণ পাই এবং দলিলে উল্লেখিত সম্পদের মূল্য অনুযায়ী সরকারি খরচ রেখে বাকি টাকা ববিতা বেগম ও মামুনকে ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আরিফও উক্ত সিদ্ধান্তে একমত হয়ে তাদের টাকা ফেরত দিবেন বলে স্বীকার করেন এবং উক্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি সাব রেজিস্ট্রার আশ্রাফুল ইসলামকে অবগত করি। কিন্তু এখন জানতে পারি ববিতা বেগমের টাকা ফেরত দিলেও মামুন হোসেনের টাকা দেয়নি। আরিফ ভেন্ডার যে কাজটি করছে তা আমাদের দলিল লেখকদের জন্য সত্যি লজ্জাজনক।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান, তার এমন প্রতারণার জন্য শাস্তি হিসেবে দলিল লেখক সনদ নবায়ন না করতে ফরিদগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রার মহাদয়কে অনুরোধ করি। আরিফ ভেন্ডারকে দীর্ঘ দিন সমিতির অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলেও তিনি জানান।
ফরিদগঞ্জের সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী আবুল বাসারের কাছে একই দলিলের নাম্বারের অবিকল নকল ও মূল দলিল ২টি দুই রকম ও গরমিল হওয়ার কারণ কী এমন প্রশ্ন করলে তিনি জানান, নকলবিশদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এমনটা হতে পারে।
ফরিদগঞ্জের সাব রেজিস্ট্রার আশ্রাফুল ইসলামের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, দলিল লেখক আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি থেকে জানতে পারেন। আমি রোববার শেষ অফিস করে বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থল সাভার সাবরেজিস্ট্রার অফিসে যোগদান করবো। তার কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘আপনার স্বাক্ষরিত দলিলের অবিকল নকল কপি ও পরবর্তীতে গ্রাহকের পাওয়া মূল দলিল নাম্বার এক হলেও কপির মধ্যে সম্পদের মূল্যের অমিল হওয়ার সুযোগ আছে কিনা’। তিনি প্রথম না বললেও ভুক্তভোগী ববিতা ও মামুনের দলিলের গরমিল বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তখন ‘আমি দায়িত্বে ছিলাম না’ বলে কথা এড়িয়ে যান।
এই বিষয়ে অভিযুক্ত দলিল লেখক আরিফ হোসেনের বক্তব্যের জন্য তার মোবাইল ফোনে এবং তার অফিস ও কর্মস্থলে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদগঞ্জ দলিল লেখক সমিতির একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা হলে তারা বলেন, আরিফের প্রতারণার কারণে আমাদের ইজ্জত যায়। আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই।
ভুক্তভোগী ববিতা ও মামুন হোসেন বলেন, সাব রেজিস্ট্রার অফিসের যোগসাজশে দলিল লেখক ও অফিসের কিছু অসাধু ব্যক্তির জন্য দলিল গ্রহীতারা এমন হয়রানির শিকার হন। তাদের অনুরোধ, এ চক্রটি যেন আর কোনো দলিল গ্রহীতার সাথে এমন প্রতারণা না করে। উল্লেখিত বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণ করতে প্রশাসনের প্রতি তারা আহ্বান জানান।