মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকদের আন্তরিকতায় এ ক্যাটাগরিতে বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
মোঃ আবদুর রহমান গাজী ॥

অবকাঠামোগত ও পরিবেশগত দিক দিয়ে এবং দক্ষ পরিচালনায় এ ক্যাটাগরিতে বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টি চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী মূল সড়কের পাশেই অবস্থিত। ৩৬ শতাংশ জমির উপর চার পাশে দেয়াল ঘেরা ২টি ভবন নিয়ে নিরিবিলি পরিবেশে বিদ্যালয় অঙ্গন। বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় রয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলা রিসোর্স সেন্টার।

বিদ্যালয় মাঠের চারপাশে রয়েছে ফুলের বাগান। আর শিক্ষার্থীদের জন্যে রয়েছে বিনোদনের নানা উপকরণ। তার মধ্যে দোলনা, স্লিপার, ব্যালেন্স, হ্যাঙ্গি রিং, ফুটবল, টেনিস বল, দাবা, কেরাম বোর্ড, স্কিপিং রোপ, ক্রিকেট ব্যাট ও বিদ্যালয়ের নিজস্ব সাউন্ড সিস্টেম। বিদ্যালয়ের স্যানেটিশন ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত এবং পয়ঃনিষ্কাশন শতভাগ। শিশুদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যান্ডেল পায়ে টয়লেট ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ প্রতিবেদকের কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণে বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে সার্বিক বিবেচনায় শোভন শিক্ষাঙ্গন হিসেবে মনে হয়েছে।

বিষ্ণুদী গ্রামের দুজন নন্দিত ব্যক্তি। একজন ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত সাঁতারু আব্দুল মালেক মিজি। অপরজন গণপরিষদের সাবেক সদস্য ও চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল করিম পাটওয়ারী। এ দু কৃতী ব্যক্তির সাথে শোভা পেয়েছে দেশসেরা ব্যক্তিদের ছবি ও পরিচিতি। বিদ্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে শোভা পাচ্ছে জাতীয় ব্যক্তিত্বদের ছবি ও তাদের মূল্যবান বাণী। আরো রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার এবং শেখ রাসেল বুক কর্নার।

বিদ্যালয়ের ২টি ভবন। প্রথমটির নামকরণ করা হয়েছে ওই বিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাঁতারু আবদুল মালেকের নামে। এ ভবনটি করা হয়েছে ১৯৯৬ সালে। এ ভবনটির প্রতিটি কক্ষ করা হয়েছে ভাষা শহীদ শফিউর রহমান, ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ ও ভাষা শহীদ আবদুস সালাম নামে।

অপর ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ ভবন। যিনি ভাষা আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক ছিলেন। এটি করা হয়েছে ২০২১ সালে। ভবনটির উপরে উঠার সিঁড়ির দেয়ালে রয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীম উদ্দিন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মাদার তেরেসার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত। আর শ্রেণি কক্ষের প্রবেশ পথে রয়েছে দেশ সেরাদের নাম। তাঁরা হলেন : চাঁদপুরের কৃতী সন্তান ও হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য সেক্টর কমান্ডার মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, চাঁদপুর জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক, মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত আবু ওসমান চৌধুরী, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও বিষ্ণুদী গ্রামের কৃতী সন্তান আব্দুল করিম পাটওয়ারী, বিশিষ্ট নারী চিকিৎসক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। সেখানে তাঁদের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা জেলার বিশিষ্ট জন ও দেশসেরাদের জানার সুযোগ হয়েছে।

চাঁদপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডে অবস্থিত বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়টি ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৎকালীন এ বিদ্যালয়টি ছিল তরপুরচণ্ডী ইউনিয়নের অন্তর্গত। এই বিদ্যালয়টি হাঁটি হাঁটি পা পা করে আলো ছড়িয়ে চলছে বিষ্ণুদী গ্রামে। যেখানে তৎকালীন শিক্ষার হার ছিল ৫%, বর্তমানে শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫%। সেখানে শ্রমজীবী মানুষের বসতি বেশি। খুব কিঞ্চিৎ লোক পড়ালেখা করতো। এ গ্রামে সাধারণ সাদামাটা ও সহজ সরল মানুষের বসবাস। পড়ালেখার গুরুত্ব তারা ততোটা বুঝত না। বেশিরভাগ ছেলেরা সংসারের অভাব ঘুচাতে বাবার সাথেই কাজ করেন। যার দরুণ ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পড়ালেখায় একটু এগিয়ে। বর্তমানে এ বিদ্যালয়টি ঘিরে রয়েছে ৬৫০টি পরিবারের বসবাস। সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৬৯ জন। ছাত্র ১৬৬ ও ছাত্রী ২০৩ জন।

বিদ্যালয়ে ৮ জন শিক্ষক। তাঁরা হলেন : প্রধান শিক্ষক মোঃ জুলফুর রহমান। সহকারী শিক্ষক জাকিয়া আক্তার, সালমা সুলতানা, মামুনুর রশিদ, নিফুজা আক্তার, সেলিনা আক্তার, আকলিমা তাসনিম ও রাবেয়া সুলতানা। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ শুধু ক্লাসের পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তারা বিদ্যালয় অঙ্গনকে সাজাতে নিজেস্ব ফান্ড থেকে টাকা খরচ করেন। বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক জাকিয়া আক্তার তার স্বামীর কাছ থেকে অফিস রুমের জন্য প্রায় দুই লক্ষ টাকার ফার্নিচার এনে দিয়েছেন। শিক্ষক সেলিনা আক্তার একজন চিত্রশিল্পী। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি কক্ষে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক মামুনুর রশিদ ক্রীড়াঙ্গনে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। এছাড়া অন্যরাও বিদ্যালয়ের যে কোনো বিষয়ে নিবেদিত। শিক্ষকদের আন্তরিকতায় প্রতি বছরই সমাপনী পরীক্ষায় এ প্লাসসহ শতভাগ পাস করে আসছে। এ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনে জেলা শহরের হাসান আলী ও মাতৃপীঠ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছে।

প্রতিদিন দেখা যায় অ্যাসেম্বলিতে শিক্ষার্থীদের শতভাগ অংশগ্রহণ। ছাত্রদের শার্ট আকাশী রংয়ের আর পেন্ট নেভি ব্লু। আর মেয়েদের আকাশী রংয়ের শার্ট আর উপরে নেভিব্লু ফ্রক এবং সাদা সালোয়ার। পায়ে সাদা কেডস আর সাদা মোজা। ইউনিফর্মে বোঝা যায় না কে ধনী কে গরিব। সবাই যেন এক বাগানেরই ফুল। পিটি, শপথ ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনে উৎসব মুখর পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়েছে। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা ও বাচনভঙ্গিতে মাধুর্য দেখা গেছে। যদিও তারা সাধারণ পরিবারের সন্তান।

শিক্ষার্থীদের অভিভাবক কুলছুমা বেগম ও মনি বেগম। দুজনেই ভাড়া থাকেন এ বিদ্যালয় এলাকায়। এ দুজনেরই স্বামী চাকুরি করেন চাঁদপুরে। তাদের বাড়ি অন্য জেলায়। এ বিদ্যালয়ে তাদের সন্তান পড়াতে পেরে গর্ববোধ করেন। এখানে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে এবং পড়ালেখা ও খেলাধুলার পাশাপাশি শাস্তিমুক্ত পরিবেশে থাকে। শিশুরা আদর-যত্ন পাওয়ায় স্কুলে প্রতিদিন আসতে অনীহা করে না।

বিদ্যালয়ের আঙিনায় দিন-রাত পড়ে থাকেন এবং সবকিছুই যিনি দেখভাল করেন তিনি হলেন মোঃ মাসুদ হোসেন মৃধা। বিদ্যালয় অঙ্গন সুন্দর পরিপাটির পেছনে যার দায়িত্ব ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি হলেন ওই গ্রামেরই সন্তান। দপ্তরী কাম প্রহরীর দায়িত্ব পালনে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। আর তার বাড়িও বিদ্যালয় আঙ্গিনার পাশেই।

প্রধান শিক্ষক মোঃ জুলফুর রহমান সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি এ বিদ্যালয়ে ২০১৫ সালের ২১ মার্চ যোগদান করি। আমার আগের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল বাসার স্যার। তিনি এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২৭ বছর ছিলেন এবং নিরলসভাবে কাজ করেছেন। আমি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী পাঠদানে সহকর্মী শিক্ষকবৃন্দকে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে করছি। এখানে সরকারের বরাদ্দের পাশাপাশি আমাদের চাহিদা পূরণে ম্যানেজিং কমিটি ও আমাদের শিক্ষকদের আন্তরিকতায় কমতি নেই। এ বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধনে শিক্ষকরা নিজস্ব ফান্ড থেকে টাকা খরচ করেন। তার পাশাপাশি ম্যানেজিং কমিটিও শিক্ষার মানোন্নয়নে আন্তরিক এবং বিদ্যালয়ের যে কোনো বিষয়ে নিরলসভাবে কাজ করছে। তিনি আরো জানান, অবকাঠামোগত ও পরিবেশগত দিক দিয়ে এবং দক্ষ পরিচালনায় এ ক্যাটাগরিতে রয়েছে বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে এই এলাকায় শিক্ষার হার ২৫% । শিক্ষার হার আরো এগিয়ে নিতে আমাদের রয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পনা।

বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার এবং মেসার্স মিয়াজী কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী এমএ খালেক মিয়াজী জানান, আমিও এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। শৈশবটা আমার এ গ্রামেই কেটেছে। আজ আমি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো। আর সেই সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করছি। যার দরুণ বিদ্যালয়ের ভালো ফলাফল এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি সন্তোষজনক। তিনি আরো জানান, এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও আন্তরিক। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি প্রশংসিত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়