প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার রেকর্ড : আবারও দেশসেরা করদাতার ১ নাম্বারে
চাঁদপুরের কৃতী সন্তান হাজী মোঃ কাউছ মিয়া আবারও দেশসেরা করদাতা নির্বাচিত হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছেন। তিনি হাকিমপুরী জর্দার স্বত্বাধিকারী। ২০২০-২১ করবর্ষে ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে সমগ্র বাংলাদেশে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে ১ নাম্বার হয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাকে সিআইপি মর্যাদার ট্যাক্স কার্ডসহ সম্মাননা দেবে।
|আরো খবর
বুধবার জাতীয় ট্যাক্সকার্ড নীতিমালা, ২০১০ (সংশোধিত) অনুযায়ী ২০২০-২০২১ করবর্ষের জন্য সেরা করদাতা হিসেবে ১৪১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকার প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে এনবিআর। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, কাউছ মিয়া ১৯৫৮ সাল থেকে কর দেন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ২০২১ সালে মুজিববর্ষের সেরা চমক ছিলেন কাউছ মিয়া।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কর প্রদানে সততা, আন্তরিকতা ও স্বপ্রণোদনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে জাতীয় রাজস্ব খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় দেশসেরা করদাতার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। সারাদেশে এ সম্মাননা শুধু তিনি একাই পান।
গুলশান-বনানী কিংবা মতিঝিলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার নেই মোঃ কাউছ মিয়ার। পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডে হাকিমপুরী জর্দার কারখানার একটি কক্ষই তাঁর ‘চেম্বার’। মৌলভীবাজার থেকে সরু এই গলিপথ ধরে কিছুটা পথ হাঁটলেই তাঁর কারখানা। সেখানেই বসেন তিনি। গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটে ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরান ঢাকার প্রবীণ এই ব্যবসায়ীই প্রতিবছর সর্বোচ্চ করদাতা হন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি দেশের সর্বোচ্চ করদাতার একজন। এই নিয়ে তিনি টানা ১৯ বার দেশ সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়ে অনন্য রেকর্ড গড়েন। যা বাংলাদেশের আর কোনো ব্যবসায়ী কাউছ মিয়ার পর্যায় ধারাবাহিক এতোবার সেরা করদাতার রেকর্ড গড়তে পারেনি। প্রতিবারই শীর্ষ করদাতাদের তালিকায় তাঁর নাম ছিলো সবার উপরে। অবশ্য অন্য শ্রেণির সর্বোচ্চ করদাতারা প্রতিবছর কর হিসেবে যত টাকা দেন, তারা কাউছ মিয়ার ধারে কাছে নেই বলে জানিয়েছেন এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা।
হাজী মোঃ কাউছ মিয়া ৬৩ বছর ধরে কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি। কেন কর দেয়া শুরু করলেন এর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। ২০১৯ সালে এনবিআরের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আগে টাকা পয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি থাকত। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ‘ফ্রি’ হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকাপয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাবনিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।
১৯৩১ সালের ২৬ আগস্ট কাউছ মিয়া রাজরাজেশ্বরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী আব্বাস আলী মিয়া ও মাতা মরহুমা হাজী মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন (জমিদার কন্যা)। তখনকার সময় ভারতবর্ষের ত্রিপুরা ডিস্ট্রিক্ট ছিল পূর্বে আগরতলা ও পশ্চিমে কলকাতা পর্যন্ত।
তিনি যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন আমলের সামুগাদী চরবাহাদুর গ্রামে কাউছ মিয়ার বাবার শুধু বাড়িটিই ছিলো ৮৩৭ শতাংশ জমি নিয়ে। আর তাদের শত শত বিঘা কৃষি জমিতো ছিলই। তাদের বাড়ি হাজী বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল।
৮ নানা ছিলেন জমিদার। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হবার পর ১৯৫৬ সালে সরকার প্রত্যেক জমিদারকে ১শ’ একর করে জমি বুঝিয়ে দেন। কাউছ মিয়ার বড় বাবা (নানার পিতা) আজগর দেওয়ান ছিলেন ১৭০০ সালের প্রতাপশালী জমিদার। তার ছিল ৭ ছেলে ১ মেয়ে। ৯২ বছরে পা রাখা কাউছ মিয়ার বয়স একানব্বই পার হলেও তিনি এখনো প্রাণবন্ত।
কাউছ মিয়া মনে করেন, মানুষ যদি শরীর ও মনের দিক থেকে সুস্থ থাকে, সেটি আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ সুস্থ থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, আল্লাহ আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা ৭১ বছর এককভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এখনো প্রতিদিন তিনি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করেন।
কাউছ মিয়ার বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। আর ব্যবসায় মন পড়ে থাকা কাউছ মিয়া ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় আর পড়াশোনা এগোয়নি। পুরাণবাজার মধু বাবুর স্কুলে লেখাপড়া করেন তিনি। ওই স্কুলের পাশেই তাঁর নানা জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম সাহেবের বাড়ি।
বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাউছ মিয়া মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরাণবাজারে স্টেশনারী দোকান দেন। এরপর ধীরে ধীরে সেখানে তিনি ৫/৬টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট ছিলেন। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর মূল ব্যবসা তামাক বেচাকেনা।
জর্দা ব্যবসা ছাড়াও আগে থেকেই কাউছ মিয়ার বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। যার কিছু ব্যবসা বয়সের কারণে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, আবার কিছু ব্যবসা রেখেও দিয়েছেন। তাঁর ঢাকাতে অনেক বাড়িঘর, জায়গা-জমি রয়েছে। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদপুরে তাঁর নিজের কেনা ও ছেলেদের কেনা জমিতে কৃষিপণ্য চাষাবাদ করে ফলন করছেন। এর সাথে ৩টি বড় গরুর খামার রয়েছে। সেখানে তাঁর খরিদকৃত হাজার হাজার বিঘা জমি রয়েছে। হাজী মোঃ কাউছ মিয়া ৮ জমিদারের নাতি। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি নানাদের জমিদারি সম্পত্তির অংশ পাবার নিয়ম থাকলেও সেই সম্পত্তি নেন নি এবং তাঁর পূর্ব পুরুষরাও শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি এবং তাঁর ছেলেরাও নেয়নি।
একের পর এক ব্যবসায়িক স্বীকৃতির সাফল্যে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় দানবীর কাউছ মিয়ার নাম। অনেকে বলেন, সত্যিই ব্যবসা জগতে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী।
মানব সেবার উজ্জ্বল নক্ষত্র : দেশবাসী হাজী কাউছ মিয়াকে একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই চিনেন। তিনি তাঁর মরহুম পিতার নামে উত্তর তারাবুনিয়া আব্বাস আলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে (কবি নজরুল সড়কে) মায়ের নামে ফাতেমা খাতুন মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি চাঁদপুর গুয়াখোলা আবাসিক এলাকায় মদিনা জামে মসজিদ এবং স্ট্র্যান্ড রোডে (বর্তমান কবি নজরুল সড়কে) আল-আমিন স্কুলের পাশে বোগদাদীয়া জামে মসজিদ গড়ে দিয়েছেন। এ দুটি মসজিদের মোতওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৫৪ সাল থেকে এ যাবৎ ২২ বার দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। দেশের যে প্রান্তেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, পাহাড়ধস হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যখন বৈশ্বিক করোনা মহামারি দেখা দেয় তখনসহ প্রতিটি দুর্যোগে তিনি বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ-সাহায্য দিয়েছেন।
১৯৮৮-এর ভয়াবহ বন্যার সময় টানা একমাস, ১৯৯৮’র বন্যার সময় প্রায় দুই মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দী মানুষের দোরগোড়ায় রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়ে কাউছ মিয়া দেশ-বিদেশে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ২০২০ সালে মানুষ যখন মরণব্যাধি করোনাভাইরাসে দিশেহারা, এ সময়েও প্রায় ৭/৮ কোটি টাকার ত্রাণ সহায়তা দিয়ে মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
করোনার এই দুঃসময়ের মধ্যেও দেশে পাঁচবার বন্যা হয়েছে। সেই বন্যাকবলিত এলাকায় তিনি তাঁর বিশ^স্ত লোক দিয়ে ত্রাণ সহয়তা পৌঁছে দিয়েছেন। এভাবেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে ৬৭ বছর যাবৎ মানবসেবা করে যাচ্ছেন হাজী মোঃ কাউছ মিয়া।