প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৫, ০৯:০৮
নারী ফুটবল দল : আমাদের বিশ্বকাপের স্বপ্নবাহন

যে দেশে নারীর জন্যে এক সময় ‘ঘর হতে আঙিনা বিদেশ’ ছিলো, সে দেশের নারীরা দাপটে খেলার মাঠে অচেনা শত শত দর্শকের সামনে ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শন করবে, এ ছিলো কল্পনাতীত। বরং এরচেয়ে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাও সহজ ছিলো আশি-নব্বইয়ের দশকে। অফিস-আদালতে নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে এ ছিলো বাংলাদেশের নারীদের জন্যে স্বপ্নের মতো। কারও কারও ভাষায়, হিরে যেমন মূল্যবান বলে তাকে অতি নিরাপত্তায় সাজিয়ে রাখতে হয়, তেমনি নারীও অন্দরমহলে অতি নিরাপত্তায় দিনাতিপাত করবে, এ ছিলো অনেকের দর্শন ও অভিলাষ। সেই প্রতিকূল পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে সাবেক দুই নারী প্রধানমন্ত্রীর আমলে নারীরা ক্ষমতায়নের আলোয় আলোকিত হয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণের অধিকার লাভ করে রাষ্ট্রকে আপন কর্মের আলোয় উদ্ভাসিত করার সুযোগ পেয়েছে। সেই সুযোগের বদৌলতে নারীরা আজ পায়ে পায়ে ফুটবলের শিল্পিত জাদু প্রদর্শন করে বিশ্ব গণমাধ্যমে নিজ দেশের জাতীয় পতাকাকে গৌরবান্বিত করেছে।
নব্বই দশকের মধ্যকাল থেকে ফুটবলকে ভাগাড়ে ফেলে ক্রিকেট নিয়ে অতিরিক্ত উন্মাদনায় মেতে ওঠা বাংলাদেশ কখনও ফুটবলে ঘুরে দাঁড়াবে, তাও আবার প্রমীলা ফুটবল নিয়ে, এ যেন রূপকথাকেও হার মানায়। পুরুষ ফুটবল দলের সোনালি অতীত পেরিয়ে ক্রিকেট এসে বর্গীর মতো হানা দিয়ে গেলো বাঙালির আবেগের টলটলে সমুদ্রে। কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ আর যশের ছড়াছড়ি ক্রিকেটকে মহীরুহের পরিণতি না দিয়ে রাজনীতির ঘুনে দুর্বল করে দিয়ে গেছে। ক্রিকেটের চাঁদকে যখন অমাবশ্যার অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়ে গেছে, তখনই দুহাজার পনের সালে বাংলাদেশের কিশোরী ফুটবলাররা জয় করে এসেছে নেপাল। অজপাড়াগাঁ কলসিন্দুর হতে একঝাঁক অনূর্ধ্ব চৌদ্দ বছরের কিশোরী ফুটবলাররা হিমালয়কন্যা নেপালকে জাদুতে মুগ্ধ করে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ানের বরমাল্য নিয়ে এসেছে। এই মেয়েদের সাধনায় দেশের প্রতি আত্মনিবেদন ছিলো অতুলনীয়। তারপর ধীরে ধীরে দুদুবার সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন, একুশে পদক প্রাপ্তি--এসবই প্রমাণ করে, এদেশের নারীরা অন্দরমহলে বন্দি থাকার মতো শক্তি নয়। তাদের মেধা বিশ্বজয়ী, তাদের তপস্যা শীর্ষে উঠার। এশিয়ান কাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আমাদের নারী ফুটবলাররা দেখিয়ে দিয়েছে, সুযোগ আর পরিচর্যা পেলে আমরাও পারি মাঠকে জয় করতে, গ্যালারি মাতিয়ে তুলতে। মারিয়া মান্দারা চৌদ্দ বছর বয়সে যা শুরু করেছে, সাবিনা-কৃষ্ণারা তা কুড়ি বছরে গিয়ে উচ্চতর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজকের ঋতুপর্ণা-মনিকা-রূপনা-সাগরিকারা এএফসি কাপের মূলপর্বে নিজেদের নিয়ে গিয়ে সেই মর্যাদা হতে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছে। নিজেরা গ্রুপ-সি তে সেরা হয়ে অর্জন করেছে এশিয়ান কাপ ফুটবলে মূল পর্বে খেলার সুযোগ। ফিফা র্যাংকিংয়ে অনেকদূর এগিয়ে থাকা বাহরাইন আর মিয়ানমারকে কুপোকাত করে, তুর্কমেনিস্তানকে গোলের বন্যায় ভাসিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা অস্ট্রেলিয়ায় খেলার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে। দুহাজার ছাব্বিশের মার্চে অনুষ্ঠিতব্য এই এশিয়ান কাপের মূলপর্বে বাংলাদেশ যদি কোনোক্রমে শীর্ষ ছয়টি দলে জায়গা পায় তবে দুহাজার সাতাশে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নারী বিশ্বকাপে লাল-সবুজের পতাকা উড়বে সতের কোটি হৃদয়কে জয় করে। এশিয়ান কাপের পরপরই শুরু হয়ে গেছে আবারও সাফ ফুটবল টুর্নামেন্ট। প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে বড়ো ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে পরের ম্যাচে নেপালের সাথে বাংলাদেশকে বেশ ভালোই যুঝতে হয়েছে। তৃষ্ণার শেষ গোলে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ আবারও স্বপ্ন দেখছে তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ান ট্রফি দেশে আনবার।
ক্রিকেটে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও অর্থের ছড়াছড়ি, তার সিকিভাগও নেই ফুটবলে। যারা ফুটবল খেলছেন, তাদের অনেকেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই বলার মতো। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য এমনও নয় যে পুষ্টিকর খাবার দিয়ে শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখা যাবে। এর পাশাপাশি আছে উগ্রবাদীদের চোখ রাঙানি। নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য মেপে এরা নারীকে ভীতিতে রাখে প্রতিনিয়ত। ফলে সাধারণ গ্রামীণ নারীরা অবলীলায় এগিয়ে আসতে পারে না খেলার মাঠে। যতদূর দেখা গেছে, ফুটবল মাঠে পিছিয়ে থাকা পরিবারের কন্যা শিশুরাই তারা হয়ে জ্বলে উঠছে। তারা জানে, তাদের দারিদ্র্য মুক্তির সর্বোত্তম পথ হলো দুটো পায়ের শিল্পকে খেলার মাঠে নৈপুণ্যে অনূদিত করা। পাহাড়ি রূপনা-মনিকা ঋতুপর্ণা কিংবা আদিবাসী মারিয়া মান্দারা জীবনে টিকে থাকার জন্যে ফুটবলের মাঝে খুঁজে পেয়েছে আশ্রয়। এদের কাছে ফুটবল বিনোদন নয়, ফুটবল হলো স্বপ্নকে আকাশ হতে পেড়ে আনার আকশি। খেয়ে না খেয়ে, বুটহীন কিংবা বলহীন তারা মাঠে দৌড়ায় জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলবে বলে। তাদের হাতে জাতির সম্মান যেমন অটুট থাকে তেমনি পতাকার গৌরবও উড়তে থাকে পৎ পৎ করে। সাবিনা-কৃষ্ণা-ঋতুপর্ণারা আজ ভুটানের শৈল শহরে মাঠ দাপিয়ে আন্তর্জাতিক লীগ খেলে জানান দেয়, তারা বাংলার বাঘিনী। তাদের গর্জনে ফুটবল খুঁজে নেয় প্রতিপক্ষের জাল। সাগরিকার গোল-দক্ষতা, ঋতুপর্ণার ক্ষিপ্রতা আর কৃষ্ণা-সাবিনার ড্রিবলিং দেখলে মনে হয়, তারা সার্ক অঞ্চলের খেলোয়াড় নয়, তারা ইউরোপের মহামাঠের মহান খেলোয়াড়। ইতোমধ্যেই ঋতুপর্ণাকে কেউ কেউ নারী মেসি হিসেবে ভালোবেসে ডাকছে। আফঈদার মাঝমাঠ কিংবা রূপনার গোলবার সামলানোর দক্ষতায় মনে হয়, এই মেয়েদের যদি পশ্চিমের কোনো উন্নত রাষ্ট্র পেটে ধরতো তবে তারা হতো গ্যালাক্সির নক্ষত্র মণ্ডলী। গরীব মায়ের ঘরে জন্মেছে বলেই আজ নারী মেসির তকমায় আমাদের আত্মশ্লাঘা লাভ করতে হচ্ছে। এই মেয়েদের কপাল এমনই খারাপ, সাফে চ্যাম্পিয়ন হলো তারা, আর গলায় মালা পরে নিলো কর্মকর্তারা। এমনকি কোচ রাব্বানিও কোনো পাত্তা পেলো না। ছাদখোলা বাসের আব্দার করে কতো হ্যাপা মেয়েদের পোহাতে হয়েছে। উগ্রবাদীদের ভয়ে নেপালজয়ী মেয়ে ফুটবল দলকে বরণ করতে হলো গভীর রাতে। ভারতের মেয়েরা যেখানে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে সুযোগ পাওয়ায় লাখ টাকা পুরস্কার পাচ্ছে, সেখানে আমাদের ফুটবল ফেডারেশন কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় আজও অচেতন। হবেই না বা কেন? এই ফুটবল ফেডারেশনইতো এই নারী ফুটবল দলকে মাত্র কুড়ি লাখ টাকা বিমান ভাড়া দেওয়ার ভয়ে মায়ানমারে টুর্নামেন্ট খেলতে পাঠায়নি। বিষয়টা এমনই, বসতে পেয়েছো তাতে মন ভরেনি, আবার শোয়ার জায়গা চাও!
বাঙালির গায়ে যেমন খ্যাতির গরম সহ্য হয় না, তেমনি আমাদের নারী ফুটবলারদেরও এই খ্যাতির গরমে গা ঘামাতে শুরু করেছে। তারা কী কারণে ফুটবল কোচ পিটার বাটলারের সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো তা আজও পরিষ্কার নয়। তবে তদন্ত কমিটি বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের কথায় কর্ণপাত করেনি। পিটার বাটলারও প্রয়োজন বুঝে সাত-আটজন বিদ্রোহী খেলোয়াড়কে দলে রেখেছেন। তবে সাবিনা-কৃষ্ণারা বাদ পড়ে শাস্তি ঠিকই ভোগ করছে। এদের অনতিবিলম্বে দলে নিয়ে দলটাকে একেবারে দুহাজার সাতাশের জন্যে তৈরি করে ফেলা দরকার।
সাবিনা, সাগরিকা, কৃষ্ণা, তৃষ্ণা, মনিকা, ঋতুপর্ণা, রূপনা,আফঈদাদের শক্ত শৃঙ্খলায় এনে অনুশীলনে রেখে এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আমাদের মেয়েদের বিশ্বকাপ খেলতে দেখার গৌরব হতে আমরা বঞ্চিত হতে চাই না। মান-অভিমান-ইগো জটিলতা পরিহার করে মাঠে ও টেবিলে কেবল ফুটবলকেই জিতিয়ে আনতে হবে। কোনো পল্লি পলিটিক্স কিংবা রাজনীতির কূটনীতি নয়, ফুটবলের স্বার্থে সবচেয়ে কল্যাণকর দূরদর্শিতা আমাদের দেখাতে হবে। কেননা, আমাদের এই নারী ফুটবল দলই বাংলাদেশের বিশ্বকাপের স্বপ্নবাহন। এই বাহনকে পরিচর্যায় রেখে আমাদের সফল হতেই হবে।