প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
ঢাকা ডিভিশনসহ আঞ্চলিক ক্রিকেটে আলো ছড়াচ্ছেন ফরিদগঞ্জের দুই ক্রিকেটার
ফরিদগঞ্জের শামীম পাটওয়ারী ও মাহমুদুল হাসান জয় যখন বিশ্ব ক্রিকেটে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তখন ক্রিকেটে সেই একই উপজেলারই সম্ভাবনাময় আরো দুজন স্বপ্ন বুনছেন দেশের হয়ে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করার। বলছিলাম সাম্প্রতিক সময়ে আঞ্চলিক ক্রিকেটে আলো ছড়ানো ফরিদগঞ্জের সম্ভাবনাময় দুজন ক্রিকেটারের কথা। তাদের একজন সাদ্দাম হোসেন অপরজন তারেকুর রহমান।
|আরো খবর
সাদ্দাম হোসেনের ক্রিকেটের পথচলাটা ২০০৭ সালে চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে কোচ শামীম ফারুকীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ রেখে এক বছর পরেই জেলা দলের হয়ে ২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রিকেটে খেলেন সাদ্দাম হেসেন। এভাবে আঞ্চলিক ক্রিকেটে সাফল্য কুড়ানোর মধ্য দিয়ে ঠিক তার দু’বছর পর ২০১১ সালটা ছিলো সাদ্দামের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির বছর। সে বছরই বয়সভিত্তিক দলে প্রথম বারের মতো লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একই বছর ভারতের বিপক্ষে দুই টেস্ট ও তিন ওডিআই ম্যাচ সবমিলিয়ে পাঁচ ম্যাচে নিজের প্রথম ম্যাচে ব্যাটস্ম্যান হিসেবে খেলেন ৭০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। এরপর খুব একটা পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সাদ্দামকে। ২০১১ সালে বয়সভিত্তিক জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে সুযোগ পান নেপালের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে ক্রিকেটে। সে সিরিজটাতে ৩-০ তে জিতে বাংলাদেশ এবং ২৫০ রানের অপরাজিত স্বপ্নময় এক ইনিংস খেলেন প্রতিভাবান এ ব্যাটসম্যান। সময়ের পালাক্রমে সুযোগ হয় দেশের প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে। নেপালের বিপক্ষে ৩-০ তে সিরিজ জেতার বছরই ঢাকা লীগে সিটি ক্লাবের হয়ে নাম লেখান প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। এক বছর সিটি ক্লাবের হয়ে খেলার পরের বছরই তাকে দলে নেয় অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট একাদশ। এ ক্লাবটিতে টানা খেলেন চার বছর। ২০১৬ সালে যোগ দেন ঢাকা লীগের হট ফেভারিট দল রূপগঞ্জ টাইগার্সে। এই দলের হয়ে খেলেন দুই মৌসুম। সবশেষ এক মৌসুম খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। এমন অগ্রযাত্রার মধ্যেও নিজ জেলা চাঁদপুর জেলা দলের বয়সভিত্তিক সবক’টি টুর্নামেন্টেই নিয়মিতভাবে ক্যাপ্টেন্সি করেছেন। এখানেই শেষ নয়, নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন্সির মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।
২০১৭-১৮ এবং ২০১৯-২০ সালে সুযোগ হয় দেশের বাইরে রেড ব্লু টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার। সাত দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি ওয়ার্ল্ডকাপে এই টুর্নামেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাদ্দাম। এই দুই আসরে দল প্রত্যাশিত সাফল্য না ফেলেও তিনি চার ম্যাচেই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন। দুটি টুর্নামেন্টেই হন ম্যান অফ দ্যা টুর্নামেন্ট। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে সাদ্দামের আরেক সাফল্যগাথার গল্প আছে ক্লেমন ইনডোর ক্রিকেটে। এই টুর্নামেন্টে খেলেছেন দুটি আসর, যাতে আছে অপরাজিত ৪০ রানের ২টা ইনিংস। ভিন্ন সময়ে দলের সম্মিলিত সাফল্য না আসলেও বরাবরের মতো তার অংশগ্রহণ করা সব ক’টি টুর্নামেন্টে নিজের জাত চিনিয়েছেন। সব শেষ অনুষ্ঠিত ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে ৫৫ রানের এক ইনিংসসহ ব্যাটস্ম্যান হিসেবে ধারাবাহিক ছিলেন পুরো টুর্নামেন্টে, যার স্বীকৃতি হিসেবে এ আসরে ১৪তম সেরা ব্যাটস্ম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে নিয়মিতভাবে চাঁদপুর ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে অনুশীলন করছেন। শুধু ব্যাটিং নয়, ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি এখন বোলিংয়ে খুঁজছেন সাফল্যধারা। সাদ্দাম স্বপ্ন দেখেন নিজের ক্রিকেট প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে ধারাবাহিক সাফল্যধারা অব্যাহত রেখে একদিন লাল-সবুজের জার্সিটা গায়ে জড়িয়ে বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ফরিদগঞ্জের প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের এ স্বপ্ন পূরণ হোক-সেটা সবাই চায়।
ফরিদগঞ্জের আরেক ক্রিকেট তারকার নাম তারেকুর রহমান। তার ক্রিকেটে আসার গল্পটা একটু অন্যরকম। এসএসসি শেষ করার পর নিজ এলাকার গৃদকালিালিন্দীয়া হাজেরা হাসমত ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলেও ক্লাস নিয়মিত করেন নি। ক্রিকেটের প্রতি তার অধিক ভালোবাসায় ছুটে গেছেন ঢাকায়, ভর্তি হয়েছেন ডিপ্লোমা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। পাশাপাশি নিজের স্বপ্ন পূরণে নিয়মিত অনুশীলন করেছেন রাইজিং ক্রিকেট একাডেমিতে। পরিবারের পক্ষ থেকে একমাত্র বড় ভাই মোস্তফা কামালের সহযোগিতায় তার ক্রিকেট জগতে পথচলা। ২০১৮ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি যখন প্র্যাক্টিস করতেন রাইজিং ক্রিকেট একাডেমিতে, তখন নিজ জেলার আরেক ক্রিকেটার বড় ভাই তৌহিদুল ইসলামের মাধ্যমে অভিষেক হয় ২০১৮-১৯ সালের চাঁদপুর প্রিমিয়ার লীগে। সেই টুর্নামেন্টে সেমি-ফাইনালে সুযোগ পেয়ে ৪৯ বল খেলে করেছেন অর্ধশত রান। এরপর ২০১৮ সালে দিনাজপুর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে সেটিতেও খেলেছেন ৪৫ রানের ইনিংস। এক বছর পর ২০২০ সালে রাজবাড়ী ক্রিকেট লীগে ব্যাট হাতে দলের হয়ে ছিলেন বেশ আগ্রাসী। সেই টুর্নামেন্টের এক ম্যাচে ২২ বলে করেন ৪৪ রান। এরপর খেলেছেন বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি গোল্ডকাপ। খেলেছেন মিরপুর ভয়েজ ক্রিকেট একাদশের হয়ে ঢাকা লীগে। দলের ওপেনিং ব্যাটস্ম্যান হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এলএমএস ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও।
এরপর শুরু হয় তারেকের আঞ্চলিক ক্রিকেটে সাফল্যগাথা। কতশত গল্প। ২০২০-২১ সালে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে অনূর্ধ্ব-১৮ তে চাঁদপুর জেলা দলের হয়ে ব্যাটিংয়ে নিজের জাত চিনিয়েছেন ষোলআনা। সে টুর্নামেন্টে পুরো ডিভিশনে সর্বোচ্চ রান টেকার হন এই তারেক। তিন ম্যাচের একটাতে খেলেছেন শত রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি করে সে ম্যাচে ব্যাট হাতে করেন ১২৮ রান। শেখ রাসেল অনূর্ধ্ব-১৮ ক্রিকেট লীগের ২০২১-২২ সিজনে ৩ দিনের টেস্ট ম্যাচে চট্টগ্রাম ডিভিশনের ক্যাপ্টেন হিসেবে খেলেছেন ৪টি ম্যাচ। চলতি বছরে বিসিবি একাডেমি কাপে ছিলেন বেশ ধারাবাহিক। ক্লেমন চাঁদপুর ক্রিকেট একাডেমির হয়ে চার ম্যাচের প্রথম ম্যাচে নোয়াখালী জেলা দলের বিপক্ষে করেন ১৪৯ বলে ১১৫ রান। নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে কক্সবাজার জেলা টিমের বিপক্ষে ২০ বলে করেন ৩২ রান। পরবর্তী ম্যাচে সেমি-ফাইনালে কুমিল্লা জেলা দলের বিপক্ষে অপরাজিত ৫২ রানের ওপর ভর করেই মূলত ফাইনালের টিকিট পায় ক্লেমন চাঁদপুর ক্রিকেট একাডেমির দলটি।
শুধু বিভাগীয় ক্রিকেটেই নয়, দেশের বাইরে বিদেশের মাটিতেও তারেক সাফল্য কুঁড়িয়েছেন সমানভাবে। ২০১৯ সালের মার্চে ভারতে অনুষ্ঠিত ক্লাব ক্রিকেটে রাইজিং ক্রিকেট একাডেমির হয়ে তিন ম্যাচের দুটিতে হাঁকিয়েছেন অর্ধশত, মোট তিন ম্যাচে করেছেন ১৩০ রান। একই বছরের আগস্টে অনুষ্ঠিত ভারতের আরেক ক্লাব কাপ ক্রিকেটে রাইজিং ক্রিকেট একাডেমির হয়ে চার ম্যাচে করেছেন মোট ১৭০ রান, যার মধ্যে ছিলো অর্ধশত রানের ২টি ইনিংস। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাস্কো ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর নিজের প্রশিক্ষণ নেয়া সাবেক ক্রিকেট একাডেমি রাইজিং ক্রিকেট একাডেমি ছেড়ে পাড়ি জমান নারায়ণগঞ্জের সেই একাডেমিতে। করোনাকালে ক্রীড়াঙ্গন স্থবির হয়ে পড়ার কারণে ক্রিকেটের সকল সরঞ্জাম নিজ গ্রামের বাড়ি ফরিদগঞ্জে নিয়ে আসেন। এখানে কখনো বাড়ির ছোট ভাইদের সহযোগিতায় নিজ বাড়িতে, আবার কখনো ফরিদগঞ্জ সদরের এআর মডেল পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন ক্রিকেট প্র্যাকটিস উপযোগী নেটে অনুশীলন চালিয়ে যান। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর আবার ফিরেছেন মাস্কো ক্রিকেট একাডেমিতে, যেখানে দেশসেরা কোচদের তত্ত্বাবধানে নিজেকে আরো বেশি পরিণত করতে প্রয়াস চালাচ্ছেন।
মূলত আউটসুইং বলের জন্যে ব্যতিক্রম ছিলেন তারেকুর রহমান। একাডেমি ক্রিকেটে বোলার হিসেবে অভিষেক হলেও সময়ের পরিবর্তনে বনে গেছেন দলের একজন আস্থাভাজন ওপেনিং ব্যাটস্ম্যান। ভারতে ক্লাব ক্রিকেট টুর্নামেন্টে রাইজিং ক্রিকেট একাডেমির হয়ে খেলতে যাওয়ার পর সে সময় দলের ওপেনারের ইঞ্জুরির কারণে ওপেনিংয়ে ব্যাট হাতে তুলে নেন তারেকুর রহমান। সে ম্যাচে দলের দুঃসময়ে খেলেন ৪৪ রানের ইনিংস। তারপর থেকে ওপেনিংয়ে ছিলেন বেশ ধারাবাহিক। এক পর্যায়ে রাইজিং ক্রিকেট একাডেমির কোচের পরামর্শে শুধুমাত্র ব্যাটিং নয়, বিশেষ ফোকাস দেন বোলিংয়ে। বর্তমানে মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে আউটসুইংয়ের সাথে ওপেনিং করে করে যাচ্ছেন তিনি। যেন সময়ের পরিবর্তনে প্রতিনিয়ত আগে থেকে অনেক বেশি পরিণত করে তুলছেন তারেকুর রহমান নিজেকে। একক ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্রিকেটে আসা তারেকুর রহমান নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে চান ছোট্ট ছোট্ট সাফল্য দিয়ে। ডিভিশন ক্রিকেটে অনূর্ধ্ব-১৮ তে খেলার পর ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে আলো ছড়িয়ে সুযোগ পেতে চান অনূর্ধ্ব-১৯ দলে, খেলতে চান অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে এবং পরবর্তীতে স্বপ্ন দেখেন জাতীয় দলে খেলার।
আঞ্চলিক ক্রিকেটে আলো ছড়ানো ফরিদগঞ্জের সোনামাখা এই মুখগুলো একদিন দেশের ক্রিকেটের প্রতিনিধিত্ব করবে, মান রাখবে বাংলার ক্রিকেটের-এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।