প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
বনে-বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, স্কুল-কলেজে, হাটে-বাজারে, সভা-সমাবেশে এবং গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই একটা বিশেষ শব্দ মানুষকে আন্দোলিত করে তোলে আর তা হলো ‘নেতা’। যত সহজ করে ‘নেতা’ শব্দটি পাইকারি হারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এর নির্যাস কিন্তু ততটা সহজ নয়। নেতা অনেক মানুষের সমষ্টি মাত্র। ধৈর্য-স্থৈর্য, উৎকৃষ্ট-প্রকৃষ্ট, চিরন্তনী এবং তাৎক্ষণিক আবেদনযুক্ত বচনগুলোর প্রবক্তারাই বস্তুত ‘নেতা’। নেতারা কিন্তু চাকুরিজীবী নয়, তারা একান্তই ব্রতী। যেমন সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটল এবং ডায়জিনিস প্রমুখ নৈতিকতাবাদী ‘নেতা’গণের মুখ নিঃসৃত বচনগুলো মানুষের মানবতা এবং নৈতিকতার উন্মিলন ঘটাতে সর্বযুগেই এক ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯ বৎসর পূর্বে প্রাচীন গ্রীসে জন-গণ-নন্দিত এক অভূতপূর্ব শাশ্বত মানব সভ্যতার বীজ উপ্ত হয়েছিল। যার নির্যাস ধরণী লয় হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জীবন্ত থাকবে। এই মহান নৈতিকতার নেতারা হলেন সক্রেটিস, যার বাণী ছিল ‘আগে নিজেকে জান’। তার উপযুক্ত শিষ্য ছিল প্লেটো, যাঁর প্রবচন ছিল “ Every evil comes out of ignorance ।” প্লেটোর শিষ্য এরিস্টোটল একদিন মুক্ত জায়গায় বসে নিদাঘে রৌদ্র-তাপ উপভোগ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর শিষ্য জেনোফোন পিছনে এসে দাঁড়ালে রৌদ্র তাপ উপভোগে বিঘ্ন ঘটায় তিনি পিছন ফিরে বলেছিলেন “Don't take from me what you cannot give” প্রমুখ মানবতাবাদী ব্যক্তিগণ-ই বাস্তব অর্থে প্রকৃষ্ট 'বিশ্বনেতা'। এদের মুখ নিঃসৃত মানবতাবাদী বাণীগুলো নভোলোকে জ্যোতিষ্কের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে এবং করতে থাকবেই।
মানব সমাজকে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে যেসব মহামনীষী বিশ্বনেতা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যীশু খ্রিস্ট, জন্ম আনুমানিক ৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে, মৃত্যু আনুমানিক ৩০-৩৩ খ্রিস্টাব্দে। খ্রিস্টধর্ম একেশ্বরবাদী হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিব্রু ভাষায় রচিত 'বাইবেল'। যীশু খ্রিস্টের আকর্ষণীয় মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের প্রায় ২৫০ কোটি জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা হলেন যীশু খ্রিস্ট।
গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে বিশ্বে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বের প্রায় ৭৫৫ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ৫৪ কোটি লোক তাঁকে নেতা মানে। তাঁর মূল মন্ত্র হলো “সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু” এবং জীব হত্যা মহাপাপ ইত্যাদি। এঁরাই মানবতাবাদী প্রকৃত শিক্ষক। বৌদ্ধদের মূল ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক পালি ভাষায় লিখিত। এর প্রবর্তক হলেন 'মহাবীর'। তিনি স্রষ্টা সম্পর্কে সরাসরি কোনো মন্তব্যই করেন নি।
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক স্বয়ং স্রষ্টা। এই ধর্মীরা-ই মুসলমান। নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বশেষ প্রেরিত একমাত্র দূত বা নেতা। যাঁর মাধ্যমে ধর্মীরা পেয়েছে মানুষের জন্যে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং বিদায় হজ্বের অমৃত বাণীগুলো, যা স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আত্মণ্ডসমর্পিত। নবীজির নেতৃত্বের অধীনে রয়েছে বিশ্বের ১৯০ কোটি মুসলমান, যার ২০% ভাগই এশিয়ায় বসবাস করে। মূল ধর্মগ্রন্থ আরবী ভাষায় লিখিত 'কোরআন', যা স্রষ্টার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রেরিত ‘ওহি’গুলোর সমষ্টি। তাই এরা স্রষ্টার একেশ্বরবাদী। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানব জাতির জন্যে উৎকৃষ্ট শিক্ষক এবং নেতা। তিনি বলেছেন, শিক্ষার জন্যে প্রয়োজনে দুর্গম স্থানে যাওয়াও শ্রেয়।
সনাতন ধর্মের আদ্যোপান্ত খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। কারণ মেসোপটমীয় পুরানোর গিলগামেশ ও ইহুদী। আর খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের নূহ নবীর বন্যার মত সনাতনী মতে, যখন এই বিশ্ব ব্রহ্মা- প্রোটোপ্লাজমীয় জেলী জাতীয় উত্তপ্ত তরল পদার্থের বন্যায় স্বয়ং নারায়ণ গভীর নিদ্রায় ভাসমান ছিলেন, তখন তাঁর নাভীপদ্ম থেকে বেরিয়ে আসলেন স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মা। তাঁর আদি সৃষ্টি হলো পুরুষ ও প্রকৃতি যথাক্রমে ‘মনু’ এবং ‘শতরূপা’। এরাই মানব জাতির পূর্ব পুরুষ। এরাই হিন্দু জাতি, এদের ধর্ম হলো সনাতন। বিশ্বে এর অনুসারী সংখ্যা ১২০ কোটিরও বেশি। ইহা বিশ্বের প্রাচীনতম জীবিত ধর্ম। এই ধর্ম বিশ্বাসের ক্রমণ্ডনেতৃত্বে ছিলেন শ্রীহরি, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ। এসব মানবতাবাদী শিক্ষকের দেওয়া অভিন্ন মৌলিক শিক্ষা হলো : জীবে প্রেম হলো স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রতীক, জন্ম, মৃত্যু, পুনর্জন্মের চক্রের প্রতি বিশ্বাস আর প্রত্যেকেরই প্রাবদ্ধ কর্ম ফলের প্রতি আস্থা রাখা এবং সংসার থেকে মুক্তি মোক্ষ প্রাপ্তি। আর ধার্মিক হও, ধার্মিক সেজো না ইত্যাদি। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ধর্মগ্রন্থ হলো ‘বেদ’।
যুগ-যুগান্তরে যুগের প্রয়োজনের তাগিদে মহান নেতা ধর্ম প্রবর্তকগণের আবির্ভাব ঘটে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই আবার লোকচক্ষুর অন্তরালে দৃশ্যাতীত হয়ে যান। তাঁদের অনুসারী ধর্মীগণ মৌলিকত্বে বিভাজন সৃষ্টি করে অনভিপ্রেত মতান্তর ঘটায়। যেমন : ক্যাথোলিক, প্রটোস্টাইন, শিয়া-সুন্নী এবং অত্যন্ত বিষাক্ত হলো মানুষের মধ্যে বর্ণ-বৈষম্য প্রথা। এগুলো মানুষকে পরস্পর বৈরী ভাবাপন্ন করে তোলে। যার ভবিষ্যৎ চরম হানাহানির মুখোমুখি। ধর্ম চর্চায় পশু মানুষ হয়ে যায়। বেশি চর্চার মানুষ অতি মানুষ হয়ে যায়। আরো বেশি চর্চায় অতি মানুষ প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ হয়ে যায়।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।