প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২২, ০০:০০
বৈষম্যের পরিধি এখন দুর্নীতির মতোই সর্বব্যাপী হয়ে উঠার কারণে এ নিয়ে আলোচনাও এখন ব্যাপকতা লাভ করেছে। উচ্চমাত্রার বুদ্ধিজীবী থেকে খেটেখাওয়া প্রান্তিক সাধারণ মানুষ, সবার মুখেই এ নিয়ে উদ্বেগজনক আলোচনা। আর এই বৈষম্যের প্রকটতা নিয়ে মানুষ শুধু উদ্বিগ্নই নয়, এর ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় ব্যাপকভাবে হতাশও বটে। উদ্বেগ ও হতাশার কথা তুলে ধরে ড. আকবর আলী খান ২০ ডিসেম্বর সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের আলোচনায় বিস্তারিত তুলে ধরে বলেছেন, ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য বাড়ছে’ (প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১)। অপরদিকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান গত ২৪ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘সম্পদ বণ্টনে এখানে বড় ধরনের অন্যায্যতা আছে’ (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১)। আরও উল্লেখ্য, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার বলেছেন, ‘স্বাধীন দেশে উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মানতেই হচ্ছে, যতো উন্নতি হয়েছে ততোই আয়-বৈষম্য বেড়েছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে। কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি। শোষণ ও শাসন বেড়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে আশা ১৯৭১ সালে ছিলো, সেটা ক্রমাগত কমেছে। আমাদের আশা ছিলো দেশ সমাজতান্ত্রিক পথে এগোবে কিন্তু সে পথে না গিয়ে উল্টো পথ ধরলো’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ মার্চ ২০২১)।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রায় ২৪ বছর সংগ্রাম এবং দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের জীবন ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বাস্তবে রূপ পাওয়ার পর বর্তমানে উন্নয়নশীল তথা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে, সেই রাষ্ট্রটি কেনো বৈষম্যকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে? তাছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতাদানের বিষয়টি শুধু যে নৈতিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য তা নয়, সাংবিধানিকভাবেও অবৈধ। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে যে বা যারাই এ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন, তারা বস্তুত সংবিধান লংঘন করছেন। সংবিধানের ১৯(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, ‘মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এ অবস্থায় উচ্চতর প্রবৃদ্ধির নামে সাধারণ মানুষকে প্রান্তে ঠেলে দিয়ে রাষ্ট্রের সিংহভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর হাতে তুলে দিয়ে তাদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি কৌশল বাংলাদেশের সংবিধান কিছু মাত্রও অনুমোদন করে না। সামরিক শাসন যেমন অবৈধ কিংবা সংবিধানের ৫ম সংশোধনী (বর্তমানে বিলুপ্ত) যেমন বৈধ নয়, তেমনি বিশেষ শ্রেণীগোষ্ঠীকে সম্পদ-সুবিধাদানের উদ্দেশ্যে প্রণীত নীতি কাঠামো এবং এসবের আওতাধীন প্রশাসনিক কার্যক্রম-সিদ্ধান্তও একইভাবে অবৈধ। ফলে শুধু বৈষম্য হ্রাসের জন্যই নয়, সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নেও এসব নীতি-সিদ্ধান্ত বাতিল বা সংশোধন হওয়া উচিত।
স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে অর্জন-অনর্জন নিয়ে নানামাত্রিক যেসব গবেষণা, সমীক্ষা, মূল্যায়ন, বিচার-বিশ্লেষণ ও লেখালেখি হচ্ছে তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়, এই সময়ের মধ্যে ২০২১ সালে বাজেটের আকার হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। জিডিপির আকার ২৮ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি করোনাকালেও ৬.১ অর্জিত হয়েছে। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার। খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ২০২১ সালে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়াও চলমান রয়েছে বৃহৎ মেগাপ্রকল্পগুলো, নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে পদ্মা সেতু। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ, তৃতীয় সমুদ্রবন্দরের (পায়রাবন্দর) কাজ চলমান, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলেছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। অন্যদিকে অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা, স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টন, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, সামাজিক-মূল্যবোধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে দেশ এগোতে তো পারেইনি, বরং বহুক্ষেত্রে পিছিয়ে গিয়েছে। তবে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি করেছে এ তথ্য যে, দেশে সম্পদবৈষম্য রীতিমতো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এবং এর বড় অংশই ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’-এর গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সময়কালে বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই)’ এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। (বণিক বার্তা, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ ও ১১ জানুয়ারি ২০২২)।
দেশে বৈষম্যের মাত্রা যে হারে বাড়ছে তাতে মনে হতে পারে এ থেকে মুক্তি পাওয়ার হয়তো কোনো উপায় নেই। ক্ষমতা কাঠামোর বর্তমান বিন্যাসের দিকে তাকালে তেমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছে আর রাজনীতিবিদরা ব্যবসা করছে। কারণ সম্পদ বণ্টনসংক্রান্ত নীতিগঠন ও সিদ্ধান্তগুলো যারা নিচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সুবিধাভোগী বিত্তবানদেরই প্রতিনিধি, অর্থাৎ নিজেদের সম্পদ অর্জনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তারা নিজেরাই নিচ্ছেন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রক্রিয়ায় গৃহীত বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত তাদেরসহ অন্য বিত্তবানের পক্ষে যাচ্ছে। এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “‘বাজার অর্থনীতি’ ‘বাজার রাজনীতির’ জন্ম দিয়েছে। রাজনীতিতে বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়ন প্রবল হয়ে উঠেছে। মুষ্টিমেয় মানুষ অকল্পনীয় সম্পদের মালিক হয়েছে। সমাজে বৈষম্য ও দারিদ্র কুৎসিত রূপ লাভ করেছে। দেশে চোখ ধাঁধানো, লোক দেখানো যে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে তার প্রায় সবটাই ১% বিত্তবানদের ধন-সম্পদকে স্ফীত করছে। আর তার চুইয়ে-পড়া ছিটে-ফোঁটা এসে পৌঁছাতে পারছে বাকি ৯৯% মানুষের কাছে। ফলে শোষণের পাশাপাশি আয়-বৈষম্য, সম্পদণ্ডবৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।” (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ মার্চ ২০২১)।
এক একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের সবাইকে বা তাদের অংশবিশেষকে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি ও আর্থিক প্রণোদনাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই সেগুলো আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। আর ঠিকই সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য-আয়ের বিকশিত রূপও হচ্ছে বাংলাদেশ।
শেষতক আশাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয়, রাজনৈতিক নেতারা যদি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও সংবিধানের অঙ্গীকার ও বাধ্যবাধকতার দিকে তাকিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের পক্ষে তাকানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাদানের অগ্রাধিকারগুলো সে অনুযায়ী বদল করতে সম্মত হন, তাহলে সহজেই বৈষম্যনীতির বাস্তবায়ন বন্ধ হবে। আর তা না হলে শুধু আলোচনায় কী হবে? প্রয়োজন তো রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন, যা কার্ল মার্ক্সের বহুল আলোচিত উক্তি।
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার : সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।