শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২২, ০০:০০

দানবীর আর. পি. সাহা
অনলাইন ডেস্ক

যুগের প্রয়োজনে, সময়ের তাগিদে এবং স্রষ্টার সৃষ্টির মঙ্গলে অবশ্যই যুগে যুগে অবণীতে মহামানব প্রেরিত হয়। যাঁদের ঔদার্য, পরমতসহিষ্ণুতা এবং জীবের প্রতি বিগলিত মণ-প্রাণ, এমন কিছু অতি ভালো লোক স্রষ্টার ইশারায় প্রেরিত হয়। তাঁরাই মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। এসব সর্বজনহিতকর ব্যক্তিত্ব তুচ্ছ স্বার্থের কথা না ভেবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির জীবন মান উন্নয়নের বিষয় বেশি প্রাধান্য দেন।

এমন একজন যশস্বী, জনদরদী এবং উৎকৃষ্ট মানবতাবাদী মানুষ এই বাংলায় জন্মেছিলেন এটা ভেবে যেমন গর্ব বোধ করি, অনুরূপভাবে চরম ঘৃণা পোষণ করি এই ভেবে যে, এমন একজন দেশবরেণ্য ব্যক্তি কীভাবে ধর্মান্ধতার নিষ্ঠুর শিকার হয়ে যান! সেই দেশবরেণ্য অসাধারণ ব্যক্তিটি হলেন বাংলার একনিষ্ঠ মানবতাবাদী দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা।

১৫-১১-১৮৯৬ খ্রিঃ সাভারের ‘কাছুর’ গ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেবেন্দ্র চন্দ্র সাহা এবং মাতার নাম কুমুদিনি সাহা। দরিদ্রতার কষাঘাতে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা স্তরও অতিক্রম করতে পারেন নি।

এতদ্সত্ত্বেও তাঁর ভিতরকার তীব্র সুপ্ত প্রতিভার আভাস পাওয়া যায়। কর্মজীবনের প্রতি পরতে পরতে তাঁর সুপ্ত প্রতিভার যে আণবিক বিস্ফোরণসদৃশ বিকাশ ঘটেছে তা প্রমাণিত সত্য।

‘রনদা’ শব্দটি আরবী ভাষা থেকে আগত। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সুগন্ধি জাতীয় বৃক্ষ। নামকরণের সার্থকতা বিস্ময়কর এবং আশ্চর্যজনক। মির্জাপুরে রোপিত ‘রনদা’ নামক সুগন্ধ জাতীয় বৃক্ষটি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছিলো। এই বৃক্ষের মূলমন্ত্র ত্যাগই উৎকৃষ্টতম আনন্দ আর বিপন্ন মানবতার সেবাই হলো জীবনের প্রকৃষ্টতম ব্রত। শয়নে-স্বপনে এই ছিল আর. পি. সাহার তপ-যপ-ধ্যান। স্থানীয় লোকজন শ্রদ্ধাভরে আর. পি. সাহেব নামেই তাঁকে সম্বোধন করতেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। তখন রনদা প্রসাদ সাহা মামা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে অযোদ্ধা কোরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে তিনি যুদ্ধাহত সৈনিকদেরকে অসামান্য সেবা-যত্নে-শুশ্রূষা করে যে অনুপম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তাতেই তিনি সামান্য থেকে অসামান্যতে পরিণত হয়ে যান এবং স্বীকৃতি স্বরূপ উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। তখন পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন চলমান ছিলো।

যুদ্ধশেষে আর. পি. সাহেব দেশে ফিরে স্বীয় তীক্ষ্ন প্রজ্ঞা, সাহস, নিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রমের সমন্বয়ে যৌবনেই প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। নারায়ণগঞ্জের একটি শিপিং কোম্পানির মালিক হয়ে প্রাচ্যের ডান্ডিতে পাট ব্যবসা শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনটি বড় বড় শহরে পাওয়ার হাউস ক্রয় করে পাওয়ারের ব্যবসাও শুরু করেন এবং অচিরেই প্রভূত সম্পদের মালিক বনে যান।

অর্থাভাবে তাঁর মায়ের অকাল মৃত্যুর মর্মবেদনার অন্তর্দহনে তিনি পলে পলে দগ্ধ হয়েছিলেন। চলে গেলেন মির্জাপুরে। পিতামহী ‘শোভা সুন্দরী’র নামে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। বিন্দু থেকেই সিন্ধুর উৎপত্তি হয়। আজ শোভা সুন্দরী দাতব্য চিকিৎসালয়টি যে মহীরুহে রূপান্তরিত হয়েছে তার প্রমাণ হলো-কুমুদিনি হাসপাতাল, কুমুদিনি মেডিকেল কলেজ, কুমুদিনি নার্সিং ইনস্টিটিউট সেন্টার ইত্যাদি চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় উন্নত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। এই চিকিৎসা কমপ্লেক্স সংলগ্ন একটি কবরস্থান স্থানান্তরের ব্যাপারে আর. পি. সাহেবের সাথে একটি মহলের মতানৈক্য দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছিলো। যে কবরস্থানটি আর. পি. সাহেবের দান করা সম্পদ। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আর. পি. সাহেবের উন্নয়নমূলক কোনো কাজের সাথেই কখনো তিনি কোনো ধরনের আপোষ মানতেন না। এক সময় পাক-ভারত উপমহাদেশ ছাড়াও দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা চিকিৎসকের চিকিৎসা সেবা এই কুমুদিনি হাসপাতালে দেয়া হতো এবং বিদেশ থেকে এসেও চিকিৎসা সেবা নেয়া হতো।

১৯৪২-১৯৪৪ খ্রিঃ-এর দিকে বাংলায় যে এক মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল তাতে সৃষ্টি হয় মানবতার করুণ বিপন্নতা। আর. পি. সাহেব তখন পঞ্চাশোর্ধ্ব লঙ্গরখানা পরিচালনা করেছিলেন। তখন মানবতার সেবায় নিয়োজিত রেডক্রস সোসাইটিকে বড় লাটের অনুরোধে তিন লাখ টাকার মত একটা পরিমাণ নগদ সাহায্য হিসেবে দিয়েছিলেন। সেই সময় একশ’ টাকায় তিন ভরি স্বর্ণ পাওয়া যেত। (সূত্র : ইন্টারনেট এবং ২০ মে ২০২২খ্রিঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন)

শিক্ষা ক্ষেত্রে আর. পি. সাহেবের প্রথম সূচনা হলো ভারতেশ্বরী বিদ্যামন্দির দিয়ে। তারপর বর্ধিত কলেবরে ভারতেশ্বরী হোমস্ নামে একটি অনন্য শিক্ষালয় শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন, যা সম্পূর্ণ অবৈতনিক। বাংলাদেশে বিদেশী অতিথিদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে হলেই আর. পি. সাহেবের প্রতিষ্ঠিত ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রীদের শারীরিক কসরত দেখানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ভারতেশ্বরী হোমস এমন একটি আদর্শিক শিক্ষালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা সমগ্র দেশের জন্য অনুকরণীয়। তারপর দেবেন্দ্র কলেজ, কুমুদিনি কলেজ, বিন্দু বাসিনী স্কুল এন্ড কলেজসহ আরো অনেক স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করে আর. পি. সাহেব নিজে যে একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষানুরাগী তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করে গেছেন।

আর. পি. সাহেবের মতো এমন একজন শিক্ষানুরাগী, উৎকৃষ্ট মানবতাবাদী, শিল্পানুরাগী, নিখুঁত বাংলা প্রেমিক, দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তাকারী এবং একজন উন্নত মানের সংস্কৃতিপ্রেমীকে যারা খুন করতে পারে তারা অবশ্যই শ্রেণীতে নীচতাসহ নীচ এবং দেশদ্রোহী। তারা রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে থাকটাই উত্তম। কারণ কয়লার মলিনত্ব কখনো দূরীভূত হয় না। আজ যারা স্বাধীনতার মধুপান করে তৃপ্ত হচ্ছি তাদের ভাবতে হবে, আর. পি. সাহেব শুধুই বাংলাকে প্রাণাধিক ভালবেসে বাংলা ছেড়ে কোথাও যাননি, যদিও যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। যে জাতি বা গোষ্ঠী এমন মহান লোকের যথাযথ মূল্যায়ন করে না, তথায় সৃষ্টির নিয়মে মহৎ লোক জন্মায় না।

এই দানবীর আর. পি. সাহার সাথে একমাত্র উপমিত হতে পারেন ওপার বাংলার দানবীর এবং মানবতাবাদী হাজী মুহাম্মদ মহসিন। তাঁরা উভয়েই তাঁদের দানীয় কীর্তি সমূহের নিরাপত্তা বিধানে ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট তৈরি করে দিয়েছেন।

জন্মিলে মরিতেই হবে সৃষ্টির সতত বিধান,

রনদা, তোমার কীর্তিতেই নরহৃদে থাকবে চির অম্লান ॥

লেখক পরিচিতি : বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়