প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:২৭
দাম্পত্যে আলাদা বিছানা-একটি নতুন সম্ভাবনা
মানুষ একা একা টিকতে পারবে না এই শিক্ষা প্রকৃতির কাছ থেকে পেয়েছে। টিকে থাকার সংগ্রামে গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। গোষ্ঠীর সদস্যরা একে অপরের মুখোমুখি থাকতো। বিপদ আপদ, সুখ-দুঃখে একে অন্যকে সহযোগিতা করতো। গোষ্ঠীগত লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্যে গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেখা গেল। গড়ে উঠলো পরিবার, উত্তরাধিকার, নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব, মালিকানা।
এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক করতে আদর্শ, ভাবনা, বিশ্বাস, ইত্যাদি তৈরি করে মাধ্যমিক গোষ্ঠীর জন্ম দেয়া হলো। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা একে অপরের সম্মুখে না থাকলেও আদর্শগত, ভাবগত ভাবে একে-অপরের নৈকট্য কিংবা সান্নিধ্য পায়। মাধ্যমিক গোষ্ঠী সারা দুনিয়ায় শান্তি এবং অশান্তির বাণিজ্য চলমান রেখেছে। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় লাখ লাখ মানুষ জন্মভিটা ত্যাগ করে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
একদিন সমাজের বিশেষ প্রয়োজনে যৌথ পরিবার প্রথা গড়ে উঠেছিল। আবার সমাজের প্রয়োজনে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কল কারখানা, সেবা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ পরিবার ছেড়ে আসে। এতে করে দাম্পত্য জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দাম্পত্য মানে স্বামী-স্ত্রী একসাথে সংসার ধর্ম পালন, সন্তান জন্ম দেয়া, সন্তানকে সমাজের জন্যে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা, পরিবারে বসবাসরত বাবা-মা, ভাই-বোন, শ্বশুর- শাশুড়ি, আত্মীয় স্বজনকে দেখভাল এবং সেবা-যত্ন করা।
কৃষি ভিত্তিক সমাজ পূর্ণমাত্রায় থাকায় দাম্পত্য বজায় ছিলো। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে মানুষ সরে যেতে থাকলে দাম্পত্য হুমকির মুখে পড়ে। শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর আলাদা জীবন। দুর্ভিক্ষ, অভাব অনটন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বিগ্রহ, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব, জীবনের অনিশ্চয়তায় মানুষ পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর দূরান্তে চলে যায়।
আমাদের দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছে। বেশির ভাগ প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ লেখা পড়া, গবেষণা, উচ্চতর ডিগ্রি , ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যে বিদেশে অবস্থান করছে। কিছু সংখ্যক মানুষ প্রবাসে দাম্পত্য জীবনযাপন করার সুযোগ পান। গার্মেন্টস্, কলকারখানা, ব্যাংক বীমা, ব্যবসা বাণিজ্য, দোকানপাট, ফার্নিচার, নির্মাণ, সেবা প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ করেন, যাদের পরিবার পরিজন গ্রামের বাড়িতে কিংবা কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে থাকেন।তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে পারেন না। সন্তান সন্তুতিরা বেশির ভাগ সময়ই মায়ের তত্ত্বাবধানে বড়ো হচ্ছে। খুবই অল্প সংখ্যক সন্তান সন্তুতি বাবার তত্ত্বাবধানে বড়ো হচ্ছে। বাবা-মা দুজনের স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা, শাসন ও তত্ত্বাবধানে বড়ো হবার সুযোগ-সুবিধা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সন্তান যখন একজন পালন করেন, তখন শিশুকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় কিংবা শাসনে রাখার মানসিকতা তৈরি হয়। ক্ষেত্র বিশেষ আয়া বুয়া, সেবা কর্মীর তত্ত্বাবধানে অনেক শিশুকে বড়ো হতে হচ্ছে। কারণ, বাবা-মা দুজনেই কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকেন। যেসব শিশুর দাদা-দাদী, নানা-নানী রয়েছে, তারা খানিকটা স্বস্তি পায় এবং চিন্তামুক্ত থাকতে পারে।
এখন আমাদের পরিবারগুলোতে ভাই-বোন, দেবর-ননদরা থেকে পড়াশোনা, স্কুল কলেজে যায় না। ফলে শিশুর চাচা, ফুফু, মামা, খালার সান্নিধ্যে থাকার এবং স্নেহ-মমতা পাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।
আমাদের দেশের দম্পতিরা অনেকেই বাধ্য হয়ে আলাদা বিছানায় থাকেন। আবার বিশাল সংখ্যক দম্পতি ঘৃণা, তিরস্কার, সন্দেহ, পরকীয়া, ভালো না লাগা, অযৌক্তিক তুলনা, সঙ্গীকে গুরুত্ব না দেয়া, শক্তি প্রয়োগ, যৌন অক্ষমতা, যৌন অনীহা, ভুল সঙ্গী নির্বাচন, জেদ, আপসহীন মনোভাব, দুর্বল ব্যক্তিত্ব, সমকামিতা, সমস্যায় নিরব থাকা, স্বার্থপরতা, কর্তৃত্বপরায়ণতা, ভবঘুরে, মাদকাসক্তি, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ইত্যাদি কারণে সঙ্গীর সাথে একই বিছানায় শুতে চান না। আগে বিছানা আলাদা থাকার কথা গোপন রাখা হতো। এখন প্রকাশ্যে আলাদা বিছানায় শোয়।
বিছানা শুধু যৌন কর্মের জন্যে নয়, শারীরিক স্পর্শ, জড়িয়ে থাকা, পারস্পরিক নির্ভরতা, ভালো লাগা, স্নেহ-মমতা, দায়িত্ব কর্তব্যের বহিঃপ্রকাশেও হয়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, 'ও মন জানো না তোমার ঘরে বাস করে কয়জনা।' দিন দিন মানুষ একা হয়ে পড়ছে। প্রত্যেকে নিজের জীবন নিয়ে বেশি করে ভাবছে।
এখন গড় আয়ু ৭৩ বছর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যায় সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গড় আয়ু আরো বাড়বে। একই সাথে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ সুবিধা না পাবার অনিশ্চয়তা চোখের সামনে ভাসছে।
পৃথিবীর নানা রকমের আর্থ সামাজিক পরিবর্তন চলছে। প্রতিনিয়ত মানুষ নতুন নতুন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। শত শত বছর ধরে দাম্পত্যের ধারণা, মূল্যবোধ, বিচার বিবেচনার পরিবর্তন চলছে। মানুষ এখন সকল রকমের বন্ধন, দায়িত্ব কর্তব্য, শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি নিতে অনেক বেশি আগ্রহী।
কেউ কেউ সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে কিংবা লালন পালন করতে আগ্রহী নন। দাম্পত্য মানবিক বোধের জায়গা থেকে কিছুটা সরে এসে প্রাতিষ্ঠানিকতায় আটকে আছে বলে আমার ধারণা। যেসব সামাজিক প্রয়োজনে একদিন দাম্পত্য জীবন গড়ে উঠেছিল সেসব প্রয়োজন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় দাম্পত্যের সংকটগুলো তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে। দাম্পত্যের সংকটগুলো যতো বেশি জনসমক্ষে আসবে ততবেশি মেকি দাম্পত্য নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ পাবে। সংসার ধর্ম পালনের ঝক্কি ঝামেলায় যেতে অনাগ্রহী যুবক যুবতীর সংখ্যাও বাড়ছে।
জাপানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে 'সেপারেশন ম্যারেজ' জনপ্রিয় হতে চলছে। দাম্পত্য সংকটের কারণে জন্মহার নিম্নগামী হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সন্তাননির্ভর সমাজের পরিবর্তে সমাজনির্ভর প্রবীণ জীবনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকবে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে বেরিয়ে সমাজ জীবনে বসবাস করার
আকুলতা বাড়বে। মানুষ এখন মোবাইল ফোনে যতোখানি সময় দেন, প্রিয়জনের জন্যে এতোখানি সময় দিতে ইচ্ছুক নন। মানুষের মনমানসিকতা পারিবারিক জীবনের বাইরে সমাজ জীবনের দিকে ধেয়ে চলছে। সমাজ জীবনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকলে সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি কার্যকর হবে। মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অর্পণ করতে আগ্রহী হবে। সম্পদ আহরণের নেশার পরিবর্তে সমষ্টির কল্যাণের প্রতি মনোযোগী হবে।সমাজের কিছু মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে এই চিন্তা তেমন একটা কাজে আসে না। উত্তরাধিকারের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করতে গিয়ে ব্যক্তির জীবনকে নানা রকম ঝুঁকিতে কেউ ফেলতে চাইবে না। সমাজ জীবন মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই সমাজে ব্যক্তিস্বার্থ দুর্বল হবে, সামাজিক স্বার্থ গুরুত্ব পাবে।
প্রবীণরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনের বাইরে সমাজ জীবনে শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। প্রাণ ও প্রয়োজনহীন দাম্পত্যের অবসান ঘটে যেতে পারে বলে আমার ধারণা।
হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ক লেখক ও গ্রন্থ প্রণেতা।