প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৬
প্রবীণদের সময় কিনতে হবে
প্রবীণ বয়সে উপনীত হয়ে আমরা কম-বেশি সবাই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করি। বেশিরভাগ সময় ব্যক্তির জ্ঞান গরিমা, বিদ্যাবুদ্ধি, সুনাম স্বীকৃতি, সফলতা অর্জনের কথা বলে আশপাশের মানুষকে মুগ্ধ করে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে জ্ঞানপিপাসু কিছু মানুষ হয়তো মুগ্ধ হয়, তবে অধিকাংশ মানুষ এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।
|আরো খবর
আমাদের মহামানবদের বাণী আজও মানুষের কাছে অমৃত বাণী হিসেবে চালু রয়েছে। উঠতে বসতে, চলতে ফিরতে উপদেশমূলক বাণী আম জনতার বিরক্তি সৃষ্টি করে কিনা তা বিবেচনা করা উচিত। মানুষ একটা পরামর্শ কিংবা মতামত দিয়ে যতোটা আরাম অনুভব করে, আর কিছুতে এতোটা আরাম পায় কিনা জানি না। মানুষ পরামর্শ শোনার চাইতে আর্থিক সুবিধা কিংবা নগদ নারায়ণের প্রতি অধিক আগ্রহী। মানুষ টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত অনেকে ভালোভাবে পড়েন না। অনেক জ্ঞানী লোক তরুণ প্রজন্মের লেখকদের বইপত্র, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করেন না।আমাদের প্রবীণদের উচিত হবে পরামর্শ দেবার এবং নেবার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা।
মানুষের বয়স বাড়তে থাকলে একা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। সমবয়সী, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের মৃত্যু, অসুস্থতার সংবাদে চিন্তিত হয়ে পড়েন।মানুষের সাহচর্য পেতে বিশেষ করে আপনজনকে কাছে পাওয়ার আকুতি তৈরি হয়। নির্জনে বসবাস সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। চাইলেই সঙ্গ পাওয়া যায় না। স্বার্থ না থাকলে কেউই সঙ্গ দিতে চায় না। সে জন্যে প্রবীণ বয়সে কারো সঙ্গ পেতে টাকা-খরচ করতে হবে। সঞ্চয়ের নেশায় জীবনের স্বাদ আহ্লাদ মাটি করে দিবেন না প্লিজ! প্রবীণ বয়সে শিশুদের সাথে সময় কাটানো সবচেয়ে বেশি আনন্দের।তাদেরকে অল্প কিছুতে সন্তুষ্ট করতে পারা যায়। জন্মদিন, উৎসব, ঈদ, পূজা, বড়োদিন, নববর্ষ সহ বিভিন্ন উৎসবে চকলেট, খেলনা, জামা কাপড় উপহার দিলে শিশুদের মন জয় করা যাবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার আয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিশুদের সাথে থাকা, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের যতোখানি সম্ভব সহায়তা করা, শিশুদের কাছ থেকে কবিতা আবৃত্তি, গান শুনে এবং অভিনয় দেখে পুরস্কৃত করা, শিশুর জন্যে বৃত্তি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া, কোথাও বেড়াতে গেলে যতোটুকু সম্ভব শিশুদের জন্যে কোনো কিছু উপহার হিসেবে নেয়া। প্রবীণ কম খরচে, স্বল্প মূল্যে শিশুদের সময় কিনতে পারবেন। শিশুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সময় খাঁটি এবং নির্ভেজাল। শিশুর সরলতা একজন প্রবীণকে নানান ধরনের কূটকৌশল গ্রহণে বিরত থাকতে অনুপ্রেরণা দেয়। শিশুর যেমন নির্ভরশীলতা আছে, তেমনি প্রবীণদেরও নির্ভরশীলতা থাকে। শিশুর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু প্রবীণের নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রবীণের নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্যে সহায়তাকারীর প্রয়োজন হবে এবং সহায়তাকারীর সময়ের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। সহায়তাকারী যেই হোক তার প্রদত্ত সেবা সময়ের মূল্য বাজার ধরে পরিশোধ না করলে সেবা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব যারা দেখা করতে আসবেন, তাদেরকে যথাযথ সম্মান-মর্যাদার সাথে গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তারা তাদের সময় ব্যয় করে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। সম্ভব হলে তাদের উপহার সামগ্রী প্রদান কিংবা যাতায়াত খরচ দেয়া।
প্রবীণরা কোথাও বেড়াতে গেলে সেই পরিবারের জন্যে সাধ্যমতো উপহার সামগ্রী নেয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, আপনার জন্যে তাদের কিছুটা সময় ব্যয় করা হচ্ছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেড়াতে গেলে, আড্ডা দিলে, রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে খরচের অংশ অবশ্যই শেয়ার করা উচিত। বন্ধুদের মধ্যে সামর্থ্যবানরা অনেক ক্ষেত্রে বিলের পুরোটুকু পরিশোধ করে দেয়। কেউ কেউ বিল দেবার সময় গা ছাড়া একটা ভাব দেখায়, এটা ঠিক নয়। কারো করুণা, দয়া, কৃপা গ্রহণ করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। দুর্বল, অসহায় মানুষই কৃপা করুণার পাত্র হতে পারে। আবার সামর্থ্যবান আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মোসাহেবি করা মর্যাদাহানির শামিল। তরুণদের ক্লাব, সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহায়তা, উপহার সামগ্রী দিলে তাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। তরুণদের সাথে মিলেমিশে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করার সময় আর্থিক সহায়তা কিংবা তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবীণদের জন্যে চিকিৎসা, সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি, বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল এবং কার্যকর করে রাখতে আর্থিক তহবিল গঠন করতে হবে। পেশাদার সেবাকর্মী তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণরত তরুণ- তরুণীদের দীর্ঘ মেয়াদী বৃত্তির ব্যবস্থা করলে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন সেবাকর্মী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রবীণ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন।তাদের পক্ষে টাকা পয়সা খরচ করা কঠিন। এ কথা সত্যি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের প্রবীণরা শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলে শারীরিক শ্রম, সেবা দিয়ে দাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রবীণ স্বামীরা তাদের প্রবীণ স্ত্রীর সেবা-যত্ন পেয়ে থাকেন। প্রবীণ স্বামীর উচিত হবে এই সেবা মূল্য যে কোনোভাবেই হোক স্ত্রীকে পরিশোধ করা। আমাদের স্ত্রীদের হাতে নগদ টাকা দেবার ক্ষেত্রে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। গৃহকর্মী, সেবাকর্মীদের বেতনের বাইরে সময়ে অসময়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দিতে হবে। নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে, পছন্দের খাবার খেতে, বেড়াতে যেতে হবে। পছন্দের জামা-জুতা কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় করার ইচ্ছা থাকতে হবে। পার্লার, কফি শপ, ক্লাবে যাবার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রবীণ বয়সটিকে আনন্দময়, স্বস্তি ও শান্তিপূর্ণ করতে টাকা-পয়সা খরচ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সঞ্চয়ের মনোভাব এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য বিপদ আপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বর্তমানকে অবহেলা করা কতোখানি সংগত তা বিবেচনার দাবি রাখে। মনে রাখতে হবে, টাকায় কথা বলে।
হাসান আলী : প্রবীণ বিশেষজ্ঞ; প্রবীণ বিষয়ে লেখক ও গ্রন্থ প্রণেতা।