প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৪
রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণই ইসলাম

পূর্ব প্রকাশিতের পর \ ২য় পর্ব \
বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই তঁার সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা করে ঘোষণা করেছেন, ‘আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।থ (সূরা আল কলম : ৪)। অন্যত্র তিনি আরো ঘোষণা করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালের সাফল্য প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।থ (সূরা আল আহযাব : ২১)। যিনি অন্ধকারে নিমজ্জিত বর্বর একটি জাতিকে সারা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জাতিতে পরিণত করেছিলেন। তঁার পরশ পেয়ে খঁাটি হয়েছিল আরবের মানুষগুলো। শত-সহস্র বাধা-বিপত্তিকে ডিঙিয়ে তিনি তঁার মিশনকে সফল করতে পেরেছিলেন। কোন লোভ, লালসা, ভয়ভীতি তঁাকে ইসলাম প্রচারের পথ থেকে এতটুকু সরাতে পারেনি। মানবজাতিকে সঠিক পথের দিকে আহবান করেছেন জীবনভর। মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যান এবং সফলকাম হয়েছিলেন। চরিত্র গঠন ও সফলতা লাভের জন্য সকলের উচিত একমাত্র রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরন করা। বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শে জীবন গঠনেই শান্তি এবং মুক্তি।
মানুষের জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের প্রাসঙ্গিক ও ব্যবহারিক সুন্নত বা কর্মনীতিগুলো মুসলমান তথা গোটা মানবজাতির জন্য সুন্দর, সুশৃংখল ও রুচিশীল জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় পাথেয়।নবীর সুন্নত তথা তঁার আদর্শ যথাযথ অনুসরণ ও অনুকরণ না করে আধুনিকতার নামে মানবতাবিধ্বংসী বিচ্ছিন্ন অপসংস্কৃতি যে আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য রাসূল (সা.)-এর জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। থবর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এ পৃথিবীতে রাসূল (সা.)-এর আদর্শের বড়ই প্রয়োজন। মানুষে মানুষে চলমান হিংসা-বিদ্বেষ, সংঘাত দূর করতে রাসূল (সা.)-এর আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।
নৈতিক চরিত্র গঠনে রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ করতে পারলে জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর, সুশৃংখল। যে জীবন ইহ ও পরকালে মুক্তি আনবে। বর্তমান সময়ে এই নৈতিক চরিত্র গঠনই এক কঠিন কাজ। বিশেষ করে তরুণ ও যুবসমাজ বিপথে পা বাড়িয়ে নিজেদের ধ্বংসের পথে নিয়েই চলেছে ক্রম:শ, যা অভিভাবক ও সবার কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে দঁাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে তারা সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। যুবকদের চরিত্র গঠনে প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শই একমাত্র অনুসরণযোগ্য। যে আদর্শ একজন যুবককে গড়ে তুলবে সৎ ও চরিত্রবান মানুষ হিসেবে। এ ব্যাপারে অভিভাবক ও সচেতন সব মানুষের এগিয়ে আসা উচিত। একমাত্র রাসূল (সা.)-এর আদর্শই পারে একজন মানুষকে সব ধরনের খারাপ ও অনৈতিক কাজ থেকে ফিরিয়ে এনে খঁাটি ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে। বর্তমান বিশ্বে নানা স্থানে ঘটে চলেছে যুদ্ধবিগ্রহ ও সংঘাত। সংঘাতময় এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাসূল (সা.)-এর আদর্শের দিকে ফিরে যেতে হবে। দেশ-বিদেশের সঙ্কটপূর্ণ স্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবী (সা.)-এর দিকনির্দেশনা কাজে লাগাতে পারলে সুফল বয়ে আনবে। সৌহাদর্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা স্থায়ী হবে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.)-এর আদর্শই আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তাতেই বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ নিহিত।
মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পূর্ণাঙ্গ শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাসূল (সা.) কেই অনুসরণ করতে হবে। কারণ রাসূল (সা.)-এর আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো আদর্শ মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম নয়। জীবনের প্রতিটি দিকের কার্যকর সমাধান রয়েছে শুধু প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবনেই। তিনি একমাত্র পূর্ণাঙ্গ মহামানব। রাসূল (সা.)-এমন একজন মহামানব, যঁার কোনো গোপন আদর্শ বা চরিত্র বলতে কিছু নেই। তঁার জীবন চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত। যেন মানুষকে তার জীবনের কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য কোনো আদর্শের দিকে ঝুঁকতে না হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষের এমন উন্মুক্ত চরিত্র নেই।যে কারণে তিনিই একমাত্র ব্যতিক্রমী মহামানব। ফলে একমাত্র তঁার সুন্নত বা আদর্শই সবার জন্য অনুকরণযোগ্য। তঁাকে অনুসরণ করতে পারলেই মিলবে স্থায়ী শান্তি ও মুক্তি। দুনিয়ার জীবন যেমন সুন্দর হবে, তেমনি পরকালীন জীবনও হবে শান্তিময়। রাসূল (সা.) কে অনুসরণ না করে শুধু লোক দেখানো ভালোবাসায় কোনো সার্থকতা ও সফলতা নেই। নিজের পুরো জীবনকে রাসূল (সা.)-এর আদর্শে না রাঙিয়ে বিশেষ বিশেষ সময়ে তঁাকে স্মরণ করার মাঝে কোনোই সফলতা নেই। বিশেষকরে আমাদের যুব সমাজ গড়ে উঠুক বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শে। তঁাকে যেমন ভালোবাসতে হবে, তেমনি জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ অপরিহার্য। তাই পরিবার ও সমাজকে সুন্দর, সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ করতে প্রিয় নবী, বিশ্বনবী (সা.) কে আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে হবে। তঁাকে অনুসরণ করতে হবে জীবন চলার প্রতি পদক্ষেপে। এর কোনো বিকল্প নেই।
কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ
কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করা, যা রাসূল (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের ভিত্তি। রাসূল (সা.)-এর দেখানো পথ ও কাজের অনুসরণ করা, যা তঁার জীবনাদর্শের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহানবী (সা.) হলেন গোটা মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এক মহত্তম আদর্শ। জাতি, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই তার আদর্শ উন্মুক্ত ও অবারিত; যে কেউ তাকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুসরণ করে স্বীয় সামগ্রিক পরিমণ্ডলকে বরকতমণ্ডিত করতে পারে। মহানবী (সা.)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই, জাত-ধর্মের কোনো প্রভেদ নেই, সমাজ বা দেশের কোনো বিশেষ গণ্ডিতেও তার জীবনাদর্শ সীমাবদ্ধ নেই; বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্যই তিনি প্রেরিত ও তার মহত্তম আদর্শও পুরো মানবজাতির জন্যই প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ তাই তার প্রিয় হাবিবকে বলেছেন: হে নবী! আপনি বলে দিন, ওহে পৃথিবীর মানবসকল! মহান আল্লাহ আমাকে তোমাদের সকলের জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহপাকের এই সর্বজনীন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) কে যদি আমরা মূল্যায়ন করি তবে সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা তিরোহিত হয়ে যায় এবং তদস্থলে মানবজাতির বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথও প্রশস্ত হয়।
মহানবী (সা.) যেমন বিশ্বের সব মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন ঠিক তেমনি মানবজাতিরও উচিত সেই মহামানবের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান ও ভালোবাসা পোষণ করা। মহানবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই তার প্রতি মানবজাতির হক আদায়ের বিষয়টি পূর্ণতা লাভ করতে পারে। আল্লাহপাক বলেছেন: তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনের ভেতরেই রয়েছে অনুকরণীয় মহত্তম আদর্শ। তাই মানবজীবনের পার্থিব ও অপার্থিব সাফল্য লাভের প্রধান নিয়ামক হলো মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা। আর তার আদর্শকে অনুসরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় আমাদের মানসপটে জাগরূক রাখতে হবে; সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সুন্নাতে রাসুল, আযমাতে রাসুল, হুব্বে রাসুল ও ইত্তেবায়ে রাসুল (সা.)।
খাতামুন নাবিয়্যিনথ মুহাম্মদ (সা.)
মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাত ছিল সর্বজনীন, সকলের জন্যে পরিব্যাপ্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরে আর কোনো নবী আসবে না। মহান আল্লাহ বলেন, “আপনি বলুন, ‘হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তঁার প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তঁার বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়েত লাভ করবে।চ্ “এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা রচনা করতে পারবে; বরং এটি যা তার সামনে রয়েছে, তার সত্যায়ন এবং কিতাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, যা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে।চ্ (সূরা ইউনুস, ৩৭)“আর আমি আপনার ওপর কিতাব নাযিল করেছি, শুধু এজন্যে যে, যে বিষয়ে তারা বিতর্ক করছে, তা তাদের জন্যে আপনি স্পষ্ট করে দিবেন এবং (এটি) হিদায়েত ও রহমত সেই কওমের জন্যে যারা ঈমান আনে।চ্ (সূরা নাহল, ৬৪) আল্লাহ বলেন,“মুহাম্মদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ।চ্ (সূরা আহযাব, ৪০) আল্লামা যামখুশরী তঁার তাফসীর গ্রন্থ ‘আল-কাশশাফথ-এ বলেন, ‘খাতামুন নাবিয়্যিনথ এর অর্থ সকল নবী (আ)-এর মধ্যে সর্বশেষ নবী। ইবনে হায়য়ান তঁার ‘আল-বাহার আল মুহীতথ গ্রন্থে লিখেন, “এর অর্থ এই যে তঁার পর আর কোনো নবী আসবেন না।চ্ মুহিয়াস-সুন্নাহ হুসাইন ইবনে মাসউদ তঁার তাফসির গ্রন্থ ‘মাথআলিম আল তানযীলথ-এ লিখেন, ‘খাতামথ অর্থ তাদের মধ্যে অর্থাৎ নবীদের মধ্যে শেষ।
এভাবে আল্লাহ তাথয়ালা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সাথে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। হাফিয মইনুদ্দিন ইবনে কাছীর বলেন, “এই আয়াত এই সত্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ (‘নামথ) যে মুহাম্মদ (সা.)-এর পর আর কোনো নবী আসবেন না।চ্ এ সম্পর্কে এক বিপুলসংখ্যক সাহাবি (রা) ও তাবেয়ীনদের মাধ্যমে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আল্লামা শাহাবুদ্দিন সাইয়াদ মাহমুদ তঁার ‘রুহুল-মাথআনীথ গ্রন্থে লিখেছেন, “যারা মুহাম্মদ (সা.)-এর শেষ নবী হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে তারা কাফের এবং ইসলামী রাষ্ট্রে তাদেরকে অবশ্যই হত্যা করা বাঞ্ছনীয় হবে।চ্ মহানবী (সা.) হচ্ছেন নবীদের সীলমোহর। কারণ তঁার মৃত্যুর সাথে সাথে অহী বা আল্লাহ তাথআলার আদেশ নির্দেশ নাযিল হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া তঁার অনুসারীগণই নবী (আ) গণের সকল মহান দায়িত্ব চিরকাল পালন করে যেতে থাকবেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:-“তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। (সূরা, ৩:১১৩) আল্লাহ বলেন-“আর আমি তো তোমাদের সৃষ্টিকূলের জন্যে রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।চ্ (২১:১০৭)“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্যে হিদায়েতস্বরূপ এবং হিদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।চ্ (সূরা বাকারা, ১৮৫)
হযরত ইরবাদ ইবন সারিয়াহ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (স.) বলেন, আল্লাহ কর্তৃক আমি যখন শেষ নবী হিসেবে লিপিবদ্ধকৃত তখন আদম (আ) ছিল মাটিতে মিশ্রিত। আমি তোমাদেরকে আমার প্রথম বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করছি: ইবরাহীম (আ)-এর আহবান, ঈসার (আ)-এর সুসংবাদ এবং আমাকে গর্ভে ধারণকালে আমার মায়ের দেখা সু-স্বপ্ন এবং তঁার গর্ভ থেকে বহিঃগর্ভ আলো যা সিরিয়ার রাজপ্রসাদসমূহ আলোকিত করেছিল।
অতএব এটা যখন স্পষ্ট যে, মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন সকল নবী ও রাসূলের মধ্যে শেষ নবী এবং তারপর আর কোনো নবী ও রাসূল পৃথিবীতে আসবেন না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিশ্বাস সম্পর্কে এখানে একটি বিষয়ের স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে ঈসা (আ)-এর পৃথিবীতে অবতরণ। তিনি ও মহানবী (সা.)-এর অনুসারী হিসেবেই পৃথিবীতে অবতরণ করবেন।
মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতির জন্য মডেল
মানব জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে মুহাম্মদ (সা.) অন্যতম মডেল। আল্লাহ বলেন- “আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে ছিল একটি উত্তম আদর্শচ্। (সুরা আহযাব-২১)-এুলতঃ যারা আহ্যাব যুদ্ধে সুবিধাবাদী ও পিঠ বঁাচানের নীতি অবলম্বন করেছিল তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই নবী করীম (সা)-এখানে আদর্শ হিবেবে পেশ করা হয়েছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে, তোমরা ছিলে ঈমান, ইসলাম ও রাসূলের আনুগত্যের দাবীদার। তোমাদের দেখা উচিত ছিল, তোমরা যে, রাসূলের অনুসারীদের অন্তরভুক্ত হয়েছো তিনি এ অবস্থায় কোন ধরনের নীতি অবলম্বন করেছিলেন৷ যদি কোন দলের নেতা নিজেদের নিরাপদ থাকার নীতি অবলম্বন করেন, নিজেই আরামপ্রিয় হন, নিজেই ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেন, বিপদের সময় নিজেই পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি করতে থাকেন, তাহলে তার অনুসারীদের পক্ষ থেকে এ দুর্বলতাগুলোর প্রকাশ যুক্তিসংগত হতে পারে৷ কিন্তু রাসূলল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা এই ছিল যে, অন্যদের কাছে তিনি যে কষ্ট স্বীকার করার জন্য দাবী জানান তার প্রত্যেকটি কষ্ট স্বীকার করার ব্যাপারে তিনি সবার সাথে শরীক ছিলেন, সবার চেয়ে বেশী করে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ এমন কোন কষ্ট ছিল না যা অন্যরা বরদাস্ত করেছিল কিন্তু তিনি করেননি৷ খন্দক খননকারীরে দলে তিনি নিজে শামিল ছিলেন৷ ক্ষুধা ও অন্যান্য কষ্ট সহ্য করার ক্ষেত্রে একজন সাধারণ মুসলমানের সাথে তিনি সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ অবরোধকালে তিনি সর্বক্ষণ যুদ্ধের ময়দানে হাজির ছিলেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও শত্রুদের সামনে থেকে সরে যাননি৷ বনী কুরাইযার বিশ্বাসঘাতকতার পরে সমস্ত মুসলমানদের সন্তান ও পরিবারবর্গ যে বিপদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তার সন্তান ও পরিবারবর্গও সেই একই বিপদের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ৷ তিনি নিজের সন্তান ও পরিবারবর্গের হেফাজতের জন্যও এমন কোন বিশেষ ব্যবস্থা করেননি যা অন্য মুসলমানের জন্য করেননি৷ যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি মুসলমানদের কাছ থেকে ত্যাগ ও কোরবানীর দাবী করেছিলেন সে উদ্দেশ্যে সবার আগে এবং সবার চেয়ে বেশি করে তিনি নিজে নিজের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন৷ তাই যে কেউ তঁার অনুসরনের দাবীদার ছিল তাকে এ আর্দশ দেখে তারই অনুসরণ করা উচিত ছিল৷ এ দৃষ্টিতেই তঁার রসূলের জীবন মুসলমানদের জন্য আর্দশ বরং শর্তহীন ও অবিমিশ্রভাবে তাকে আর্দশ গন্য করেছেন৷ কাজেই এ আয়াতের দাবী হচ্ছে, মুসলমানরা সকল বিষয়েই জীবনকে নিজেদের জন্য আর্দশ জীবন মনে করবে এবং সেই নিজেদের চরিত্র ও জীবন গড়ে তুলবে।
বিশ্ব মানবতার মুক্তি দুত
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তঁার বিদায় হজ্জের ভাষণে গোটা মুসলিম উম্মাহ এবং তামাম মানব জাতির উদ্দেশে দুটো মৌলিক আমানত রেখে গেছেন। এর একটি হচ্ছে পবিত্র আল কোরআন এবং অপরটি হচ্ছে সিরাতে রাসূল (সা.)। আল্লাহ তাথআলা খাতামুন নবীঈন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সা.) পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হেদায়েত সহকারে মানব জাতির কাছে সিরাজাম মুনিরা করে পাঠিয়েছেন। প্রতিটি ঈমানদীপ্ত মুসলমানকে পবিত্র আল কুরআন এবং রাসূলের (সা.) পথ ও পাথেয় নিবিড়ভাবে অনুসরণ করার মধ্যেই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তিএবং আল্লাহর রেজামন্দি নিহিত। তঁার মহোত্তম চরিত্র মাধুর্যেক অনুসরণ করে জীবনকে আলোকিত না করলে আল্লাহর রহমত পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তাথআলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন: ি“হে রাসূল, আমি আপনাকে বিশ্বজগতের অনুগ্রহ ব্যতীত প্রেরণ করিনি। অন্যত্র বলা হয়েছে, অবশ্যই আপনি উত্তম ও মহৎ চরিত্রের অধিকারীচ্।
কিতাবুল্লাহর অনুসরণ
হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে ঐশী দিকদর্শন পরিপূর্ণ নির্যাস মন্থিত হয়ে আল কুরআনে। মহানবী (সা.) তঁার কর্মময় ও সংঘাতসংকুল সংগ্রামী জীবনের ২৩ বছরে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপায়ন করে দেখিয়েছেন যে, ইসলাম নিছক কিতাববন্দী কিংবা আধ্যাত্নবাদও নয়। সেই আলোকধারায় পথ চলাই মুসলমানদের জন্য একমাত্র করণীয়। এজন্যই একজন মুসলমান যিনি পবিত্র কালেমা উচ্চারণ করে তৌহিদ ও রিসালাতের সাথে জীবনকে গ্রন্থিত করেন, তার সার্বক্ষণিক এরাদাই থাকে, আল্লাহ ও তঁার রাসূলের (সা.) আদর্শকে অনুসরণ করা। ইসলাম হচ্ছে প্রত্যেক মানুষ এবং সকল সৃষ্টিজীব, এমনকি প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যও বাস্তবায়নযোগ্য জীবন ব্যবনস্থা। আকিমুদ্দিন এর প্রতিষ্ঠা ছাড়া এর বাস্তব কল্যাণ ও সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসূলের (সা.) জীবন সম্পর্কিত এক ভাষ্যে বলেছেনঃ তোমরা কি কোরআন পড়নি, আল-কোরআনই হচ্ছে তঁার জীবনচরিত। পবিত্র কোরআনে রাসূলের (সা.) জীবনকে সিরাজাম মুনীরা, বা উজ্জ্বল দীপ্তিময় আলোকপ্রভা এবং বিশ্ব মানবের মুক্তির দিশারী, সৃষ্টিকূলের জন্য রাহমাতুললিল আলামীন হিসাবে ঘোষণা করেছেন। পবিত্র ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কালাম আত্নস্ত করার আগেই কুরাইশ তঁার অনুপম চরিত্র মাধুর্য, বিশ্বস্ততা, মানবতা, ও আমানতদারীর জন্য ‘আল আমিনথ অভিধায় ভূষিত হয়েছিলেন। নবুয়তী জিন্দেগীর আগেই যুবক মুহাম্মদ (সা.) পূণ্যবতী ধন্যাঢ্য নারী খাদিজাতুল কোবরার (রা.) ব্যবসা কাফেলার সুযোগ্য ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। নবুয়াত প্রাপ্তির পর মক্কার কুরাইশ কাফেররা নবীজিকে (সা.) হত্যার পরিকল্পনা করলেও তঁার আল আমিন উপাধি বাতিল করতে পারেনি।
মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কোরআন আজও দেদীপ্যামান, উজ্জ্বল দীপ্তিতে ভাস্বর। হযরত জিবরাইল (আ.) যেভাবে ভাষায় ও বর্ণনারীতিতে আল কোরআনকে রাসূলের (সা.) কাছে বহন করে এনেছিলেন সেই ভাবেই পবিত্র কোরআন গ্রন্থিত হয়ে অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান। লাখো কোটি মুসলমানের ঘরে ঘরে এবং হাফেজ এ কোরআনের ক্বলবের সুরক্ষিত দুর্গে বিরাজমান। আল্লাহর রাসূল (সা.) যে মুসলিম উম্মাহ তৈরি করে রেখে গেছেন এবং যাদের প্রতি আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে রাসূলের (সা.) আদর্শ অনুসরণ করার নির্দেশ রেখে গেছেন, মুসলমানরা সে নির্দেশ কতটুকু পালন করতে পারছে? এ প্রশ্ন আজ উঠছে। মুসলমানরা বহু আগেই বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থান থেকে সরে গেছে। কারণ তারা কুরআন ছেড়ে দিয়েছে। এখন মুসলমান পরিচয়টাই যেন মুসলমানদের জন্য দেশ বিদেশে বিপদ ও বিপর্যেয়র কারণ। আল্লাহ বলেন-চ্আমি এ কুরআন তোমার প্রতি এজন্য নাযিল করেনি যে, তুমি বিপদে পড়বে। (২০:২)
আজ একদিকে পশ্চিমের অমুসলিম বিশ্বে নও মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে মুসলিম দেশসমূহের শাসকবৃন্দ ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে মুশরেক নাসারাদের আদর্শ গ্রহণ করে আপোসের পথ ধরেছে। অ-শিক্ষা,অ-নৈক্য মুসলিম উম্মাহর বড় সমস্যা। এ অবস্থায় সত্যিকার ঈমানদার মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও মুসলমানদের বর্তমানের আজাব গজব থেকে বঁাচতে হলে রিসালাতী আদর্শের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। এটাই সিরাতুন্নবী (সা.)-এর শিক্ষা । আজকের দুনিয়ায় ইসলাম-ই হচ্ছে সবচেয়ে গতিশীল, মানবিক ও প্রাকৃতিক জীবন বিধান। ইসলাম সত্য ও মানবতার পক্ষে, বিশ্ব প্রকৃতির শৃঙ্খলার পক্ষে। ইসলাম একমাত্র শোষিত শ্রমিক, শৃঙ্খলিত দাস, ধর্মীয় অনাচার, শোষণে জর্জরিত মানবতা, অধিকারহারা নারী এবং সকল জাতির মজলুম মানুষের মুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। ইসলামকে বন্দুকের টার্গেট বানিয়ে দুনিয়া বঁাচবে না, শান্তিও আসবে না। দুনিয়াবাসীকে এ সত্য বোঝানোর দায়িত্ব উম্মতে মুসলিমাকে নিতে হবে। কুরআনুল কারীম যে কেউ যদি একে কোন মানব রচিত কিতাব নয়। বিরুদ্ধবাদীদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে যে, কেউ যদি একে কোন মানব রচিত কিতাব হয় বলে মনে করে, তবে কুরআনুল কারীমের সূরার অনুরূপ একটি সূরা অথবা একটি আয়াত রচনা করে আনুক। এ চ্যালেঞ্জ আজও বিদ্যমান। কিন্তু কারো পক্ষে তা গ্রহণ সম্ভবপর হয়নি হবেওনা। এ কিতাব তুলনাহীন, অফুরন্ত রহস্যের অধিকারী ও চিরন্তন। এ পবিত্র কিতাবের যত অধিক সংখ্যক তাফসীর গ্রন্থ লেখা হয়েছে অন্য কোন কিতাবের এতো তাফসীর লেখা হয়নি এবং হওয়ারও কথা নয়। এ কিতাব যত তিলাওয়াত করা হয় পৃথিবীতে, অন্য কোন কিতাব ততো তিলাওয়াত করা হয় না। এ পবিত্র কিতাবে মতো অন্য ধর্মগ্রন্থের হাফিজ নেই। পৃথিবীর লাখ লাখ মসজিদের মিনার থেকে যখন আযান-ধ্বনি উচ্চারিত হয় তখন আল্লাহর একত্ববাদের শাহাদাতের পর বিশ্বনবী (সা.)-এর রিসালাতেরও সাক্ষ্য প্রচার করা হয়। তঁার নাম বহুল প্রচারিত ও বহুল প্রশংসিত। আল্লাহর আরশেও তঁার পবিত্র নাম অংকিত রয়েছে। তিনি-ই সকল মানবগোষ্ঠীর নেতা। (চলবে)
মাও. মো. মোশাররফ হোসাইন : মুহাদ্দিস, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা; খতিব, কালেক্টরেট জামে মসজিদ, চঁাদপুর, পিএইচডি গবেষক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।