প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৭
চাঁদপুরে সাহিত্যের জয়যাত্রা

সাহিত্য সমাজ বিনির্মাণের আলোবর্তিকা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা একটি সভ্য সমাজকে জাগ্রত রাখে। সভ্যতার লালনে আমাদের মাটি, মানুষ, মায়া ও সংস্কৃতিকে জাগিয়ে রাখতে একদল জ্ঞানতাপস প্রতিষ্ঠা করেন সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর।
|আরো খবর
সাহিত্য সুহৃদে ভরপুর চাঁদপুরের ‘সাহিত্য’ ভিত্তি মজবুত। সাহিত্যের বন্ধুর পথচলায় রয়েছে শান্তির বার্তা, বিশ্বময় ভালোবাসা, ভালো লাগা, পরমতসহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের কলমের জুটি। অন্যায়, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে কলমের হাতিয়ার। সমাধানের পথ দেখায় কলমের নিঃসৃত কালিতে।
১৯৮৬ সালে একঝাঁক সাহিত্যানুরাগী মানুষের প্রেরণায় যাত্রা শুরু। তাঁদের লক্ষ্য ছিল একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকরা মিলেমিশে সাহিত্যচর্চা করবেন, শিখবেন, শেখাবেন এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবেন। সেই স্বপ্নের বীজ আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। যার শাখা-প্রশাখায় নানা রঙের কাব্য, গল্প, প্রবন্ধ ও গবেষকদের কলমের ঝর্ণাধারায় অজস্র অক্ষরমালা।
এই দীর্ঘ সময়ে সাহিত্যসভা, পাঠচক্র, কবিতাপাঠ ও বই প্রকাশনায় ছিল একাডেমির সক্রিয়তা। প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবিক চেতনার জয়গান। চাঁদপুরের প্রতিশ্রুতিশীল লেখকরা জাতীয় পর্যায়ে হয়েছেন সমাদৃত। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সাহিত্য বৃক্ষমেলায় মুকুলে মুকুলে শোভা পাচ্ছে চাঁদপুরের রুপালি বর্ণমালা। এই সাধনায় রয়েছে নিরলস পরিশ্রম ও এক অনন্য ভালোবাসা। এটি কেবল সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র নয়, একটি পরিবার, যেখানে প্রত্যেক সদস্য নিজের অনুভব, চিন্তা, চেতনা, সৃষ্টি, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেন একে অপরের সঙ্গে।
সাহিত্য কোনো বিলাসিতা নয়। এটি অন্তর্গত বোধ, চিন্তা ও স্বপ্নের প্রতিফলন। ঊনচল্লিশ বছর আগে বোনা সাহিত্যের বীজ আজ ফসল হয়ে উঠেছে পুরো সাহিত্য সমাজে। এই অর্জন আমাদের গর্বিত করে, সাহস জোগায়, অনুপ্রাণিত করে।
প্রবাহমান সময়ে অনেক কিছু বদলায়। গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে না গিয়ে সাহিত্য একাডেমি হয়ে ওঠে ইতিহাস-ঐতিহ্য। একেকটি বছর ধরে গড়ে উঠেছে স্বপ্ন, সাহিত্যচর্চা, সাফল্যের সংগ্রাম ও অগ্রযাত্রার জয়গাথা।
সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত আনন্দধারার ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী শুধু আনন্দই দেয় না, এটি আমাদের আরও দায়িত্বশীল করে তোলে। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আরও গভীরভাবে ধারণ করে, নতুন প্রজন্মকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলাই এই উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানমালায় তিন দিনব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্প, বৃক্ষরোপণ, বইপাঠ, চিত্রাঙ্কন-রচনা প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা, কবিতাপাঠ ও শোভাযাত্রা দৃষ্টিনন্দন মুগ্ধতায় পালিত হয়। জেলার অন্যান্য সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন আয়োজন বিরল। একজন সাহিত্যমনস্ক মানুষের আকাক্সক্ষা মাটি, পানি, সুস্বাস্থ্য আর ছায়াবৃক্ষে ঘেরা সবুজের গালিচায় বসে রচিত হবে কবিতা-গল্পের মিতালি। সেই ভাবনার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনে জেলা প্রশাসক মহোদয় যথার্থভাবেই বলেছেন, ঘুণে ধরা সমাজের অবক্ষয় রোধে লেখক-কবি-সাহিত্যিকরা সবসময় সোচ্চার। তাঁরা কলমের কালিতে চোখের মণিতে ধরিয়ে দেন সংগতি ও অসংগতি। সাহিত্যিকদের আচরণে ফুটে ওঠে সৌহার্দ্য ও শিষ্টাচার।
পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আব্দুর রকিব পিপিএম জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সাহিত্যের এমন নির্বাচনের আয়োজন শুনে বিস্মিত হন। সত্যিই এটি একটি অনুকরণীয় নির্বাচন। স্বচ্ছতার সঙ্গে সব সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হলে সামাজিক সংযোগ আরও মধুর হবে। জেলা প্রশাসনের দৃঢ়তায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন এক উজ্জ্বল বার্তায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সাহিত্য শান্তি ও শৃঙ্খলার বোধ জাগায়। সাহিত্যিকরা তুলনামূলকভাবে অপরাধে কম জড়ায়, অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার থাকেÑবাস্তবতায় তার প্রমাণ মেলে পুলিশের নথিতে।
চাঁদপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রুহুল আমিন (অব.) স্যার একজন আদর্শ শিক্ষক, রাষ্ট্রচিন্তক। সমাজ সংস্কারে ব্যক্তির পরিশুদ্ধতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্যই বদলে দিতে পারে জীবনের গল্প। রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধারণ ও লালনে সাহিত্যচর্চা অগ্রণী ভূমিকা রাখে। এই সুচিন্তিত ভাবধারায় সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে চলেছেন তিনি। জীবনের পড়ন্ত সোনালি আভায় তিনি সাহিত্যসারথিদের সময় দেন, সাহিত্য একাডেমির নির্বাচন ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যুক্ত থাকেন দায়িত্বশীল ভূমিকায়। স্যারের সাহিত্য সম্পৃক্ততায় নতুন প্রজন্ম উৎসাহিত হয়, অনুপ্রাণিত ও আনন্দিত হয়। ছাত্র-শিক্ষক সাহিত্য শিষ্টাচারে তিনি অনুকরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন।
ঊনচল্লিশ বছর আগে গড়ে ওঠা সাহিত্য একাডেমির সবচেয়ে প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ, যুগোপযোগী স্থাপত্যশৈলীর ভবন। স্যার যুক্তিযুক্তভাবে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে নতুন ভবন নির্মাণের জোরালো আবেদন করেন।
চাঁদপুরের সাহিত্য-আবাসন ও ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ পৃষ্ঠার এপিঠ-ওপিঠ। ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’-এর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ¦ অ্যাড. ইকবাল-বিন-বাশারের সঙ্গে সাহিত্য একাডেমির সম্পর্ক কাদা-মাটি গায়ে মাখা সম্পর্ক। হৃদয়ের নিখাদ সম্পর্ক এবং আগামী প্রজন্মের সাহিত্য লালনের দায়বদ্ধতায় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নিকট নতুন ভবনের মিনতি জানান তিনি।
বর্ণাঢ্য জীবনের এই ব্যক্তিত্ব আবেগময় কণ্ঠে বলেন, নতুন ভবন নির্মাণে তাঁর কোনো চেয়ার লাগবে না, প্রয়োজনে মাটিতে বসেই কাজ করবেন। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা, একাডেমির শুষ্ক মাটির ঘ্রাণ তাঁর কাছে কত প্রিয়! সাহিত্যের খোলা জমিন ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ যাঁর প্রেরণা, সাহিত্য একাডেমির অন্যতম প্রবীণ এই সদস্য জেলা প্রশাসক মহোদয়কে আশ্বস্ত করে বলেন চাঁদপুরবাসী সব ভালো কাজে আপনার পাশে থাকবে। আমাদের যেভাবে সম্ভব কাজে লাগান, আমরা সদা প্রস্তুত।
সাহিত্য হোক প্রাণের ভাষা। সংগঠন হোক ঐক্যের প্রতীক। আর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হোক নতুন স্বপ্ন দেখার প্রেরণা।
জেলা প্রশাসক মহোদয় বর্তমানে সাহিত্য একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সবাই উচ্ছ্বসিত। সাধারণ সদস্যদের সঙ্গে সভাপতি মহোদয় একমত পোষণ করেন এটাই চিরাচরিত রীতি। সময়ের মধুর ক্ষণে সাহিত্য একাডেমির নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদ জেলা প্রশাসক ও সভাপতি মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন-এর হাতের ছোঁয়ায় নতুন ভবন নির্মাণের ফলক উন্মোচনের মাহেন্দ্রক্ষণে অপেক্ষায়।