রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৫ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

একুশ আমাদের অনির্বাণ দীপশিখা

অনলাইন ডেস্ক
একুশ আমাদের অনির্বাণ দীপশিখা

মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা আবিষ্কার হলো ভাষা। ভাষা না হলে আজ মানুষ নিজের অনুভূতি অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারতো না। কখনো সাংকেতিক ভাষায় আর কখনো ইশারা ভাষায় কথা বললেও মানুষ পূর্ণাঙ্গভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতো না। মুখের বুলি আবিষ্কার করার পর থেকেই মানুষ নিজের অনুভূতিকে অন্যের মাঝে পরিষ্কার করে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। ভাষা কখন আবিষ্কৃত হলো কিংবা কীভাবে আবিষ্কৃত হলো তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হলেও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি। এটা তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মুখের ভাষার আবিষ্কার কমপক্ষে পাঁচ লাখ বছর আগে হয়েছে এবং হোমো স্যাপিয়েন্সই মুখের বুলি ব্যবহারকারী প্রথম মানুষ। বিভিন্ন লক্ষণ পর্যালোচনা করে বলা যায়, আদিম মানুষ শিকার করে লব্ধ আহারকে দলবেঁধে ভোজন করার সময়ই ভাষার উৎপত্তি।

প্রতিটা জাতির নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। এই ভাষায় মানবশিশু তার মায়ের মুখ হতে বুলি শেখে। বিশ্বে বাঙালি জাতির উদ্ভব হাজার বছর আগে থেকে। কিংবা তারও বেশি। বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষার আদি নিদর্শন হাজার বছরের পুরানো চর্যাপদ। এর মধ্যেই লুক্কায়িত আছে বাংলা ভাষা সন্ধ্যা ভাষার রূপ নিয়ে। এই চর্যাতেই লেখা আছে বাংলা ভাষার প্রথম কবি কাহ্ন পা’র কবিতা। লেখা আছে ভুসুকু পা’র দৃপ্ত উচ্চারণ, ভুসুকু আজিকে বাঙালি ভইলি। এ ভাষাকে বিশ্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন একদিকে উনিশশো তের সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি আর অন্যদিকে উনিশশো বাহান্ন সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে রক্তঝরা আন্দোলন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভারতবর্ষে পূর্ব বঙ্গকে গাঁটছড়া বাঁধতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে, যা ছিলো বারো হাজার মাইল দূরে। ধর্মের একমাত্র মিল ব্যতীত আর কোনো দিকেই মিল ছিল না এই দুই অংশের। উনিশশো আটচল্লিশ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ছাপ্পান্ন শতাংশের মুখের বুলি ছিলো বাংলা। অথচ তাকে উপেক্ষা করে জিন্নাহর ঘোষণা ছিলো উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। ছাত্ররা সেদিন তীব্রস্বরে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো রেসকোর্স ময়দানে একুশে মার্চ এবং কার্জন হলে চব্বিশে মার্চ। এর আগে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ঊনিশশো আটচল্লিশ সালের তেইশে ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি জানিয়েছিলেন, উর্দু এবং ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও যেন সংসদের কার্যপ্রণালী পরিচালিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানিদের ব্যাপক বিরোধিতায় সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সে দাবি টেকেনি। উনিশশো আটচল্লিশ সালের এগার মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ‘রাষ্ট্র ভাষা দাবি দিবস’ পালিত হয়। এদিন মিছিলকালীন পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে আটক হয় শেখ মুজিবুর রহমান ও এমএ ওয়াদুদ। কিন্তু জিন্নাহর ঢাকা সফরের উছিলায় ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম ঢেউ স্তিমিত হয়ে যায়। সেই স্তিমিত ঢেউয়ে পুনরায় তরঙ্গ তৈরি হয় বায়ান্নের একুশ ফেব্রুয়ারি। পুলিশের একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে সেদিন নির্বিচারে গুলি চলে। শহিদ হন রফিক, জব্বার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকত, সালাম, শফিউর ও কিশোর অহিউল্লাহ প্রমুখ। ঠিক কতজন শহিদ হয়েছিলো ভাষা আন্দোলনে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। একুশের প্রথম কবি মাহবুবউল আলম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন চল্লিশজন, তখনকার পত্রিকার ভাষ্যে শহিদ হন বারোজন। কেউ কেউ নয়জন বলেও উল্লেখ করেছেন। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাঙালি সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল, একুশ মানে মাথা নত না করা।

মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে ঊনিশশো বাষট্টি সালে আসামের বরাক উপত্যকা উঠেছিলো আগুনরূপে জ্বলে এবং শহিদ হয়েছিলেন প্রথম নারী ভাষা সংগ্রামী ষোড়শী কমলা ভট্টাচার্য। তারপর আবারও মনিপুরী সম্প্রদায় তাদের বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা নিয়ে দুহাজার ষোলো সালে সরব হয় উঠে। ঊনিশশো চুয়ান্ন সালে বাংলাকে অন্যতম মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় যা ঊনিশশো ছাপ্পান্ন সালে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা একক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঊনিশশো বায়ান্ন সালের পহেলা অক্টোবরে নয়াচীনের শান্তি সম্মেলনে এবং ঊনিশশো চুয়াত্তর সালের পঁচিশে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পরিকল্পিতভাবে বাংলায় ভাষণ দেন। ঊনিশশো নিরানব্বইয়ের সতের নভেম্বর রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালামের তৎপরতায় ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স এসোসিয়েশনের উদ্যোগে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতায় একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সংগ্রামী বাঙালির এ এক বিরাট অর্জন। উনিশশো সাতাশি সালে বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের আদেশ জারি করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে আমাদের দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর দক্ষতায় বাংলা হয়ে ওঠে আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের প্রথম রাষ্ট্র ভাষা। এ যে কতো আনন্দের তা বলে বোঝানো যায় না। সেই আনন্দ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় যখন দুহাজার সতের সালের ত্রিশে অক্টোবর ইউনেস্কো বাংলায় প্রদত্ত ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ রেজিস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে অন্তর্ভুক্ত করে।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের বাহাত্তর বছর পেরিয়ে এসে আজ আমাদের শুনতে হয় প্রয়াত কবি ভবানী প্রসাদ মজুমদারের কালজয়ী আক্ষেপ, ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না...।’ বাংলার প্রতি তথাকথিত আধুনিক মানুষের এ অবজ্ঞা সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না। বাংলা বানানের ওপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চাপিয়েও ভাষাকে সাধারণ মানুষের মুখ থেকে অনেক অনেক দূরে নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা আজকের একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বলতে চাই, একুশ আমাদের একাত্তরের বীজ, একুশ আমাদের শেণিতের স্রোতোধারা। আমরা একুশকে হারিয়ে যেতে দিবো না। একুশ আমাদের জন্যে অনন্ত অহংকার, একুশ আমাদের অনির্বাণ দীপশিখা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়