প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
এমন পিতৃত্বে ঘৃণা এবং চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ

এ পৃথিবীর সকল দম্পতিকে মহান সৃষ্টিকর্তা সন্তান দান করেন না। অনেক দম্পতিই সন্তানহীন থাকেন, যারা কোনো শিশুকে দত্তক না আনলে মা/বাবা ডাক শুনতে পান না। আমৃত্যু কষ্ট নিয়েই বেঁচে থাকেন। যে দম্পতি সন্তান দ্বারা স্রষ্টার কৃপা বা আশীর্বাদপুষ্ট হন, তারা আবার সবাই সুখী হন না, যদি না সন্তানটি পুরোপুরি সুস্থ, সুশিক্ষিত সুসন্তান কিংবা পিতামাতার অনুগত না হয়। অনেক দম্পতি বোবা, অন্ধ সহ নানা প্রতিবন্ধিত্বের শিকার সন্তানকেও পরম মমতায় আদর-যত্ন করে লালনপালন করেন 'মা'/'বাবা' ডাক শোনার জন্যে কিংবা পিতৃত্ব-মাতৃত্ব অনুভব করার জন্যে। এই পিতৃত্ব-মাতৃত্বের প্রশ্নে অনেক পিতা বা মাতা লাগাতার অসুস্থ সন্তানের জন্যে অপরিমেয় কষ্ট শিকার করেন কিংবা অকর্মণ্য, অথর্ব কুসন্তানের নানা রূপের অত্যাচারও সহ্য করেন। এর বিপরীতে নানা কারণে অনেক পিতা বা মাতা সন্তানের প্রতি যথার্থ পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব প্রদর্শন করতে পারেন না। এসব কারণের কোনোটা থাকে যৌক্তিক, আবার কোনোটা থাকে অযৌক্তিক। কিন্তু হাজীগঞ্জ উপজেলার আবদুল কাদের নামে এক পিতা তার ঔরসজাত সন্তান কামালের মৃত্যুর পর লাশ দাফনে বাধা দিয়ে কেমন পিতৃত্ব প্রদর্শন করলেন সেটা ন্যূনতম উপলব্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষেরই মাথায় ঢোকে না। সেজন্যে আঃ কাদেরের এমন পিতৃত্বে প্রতিটি মানুষই ঘৃণা জানিয়েছেন ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এমন পাষ- পিতার কাণ্ড নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠে পরপর দুদিন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বুধবারের সংবাদ শিরোনামটি হয়েছে এমন--‘হাজীগঞ্জে শেষ পর্যন্ত গভীর রাতে সেই সন্তানের দাফন’। এ সংবাদটিতে কামরুজ্জামান টুটুল লিখেছেন, হাজীগঞ্জে সালিসগণের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত বাবার অনুমতি সাপেক্ষে আর স্ত্রী-সন্তানদের হিস্যা বুঝিয়ে দেবার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কামাল পাটোয়ারীর লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার গভীর রাতে এই দাফন সম্পন্ন হয় বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন। এর আগে গত সোমবার বিকেলে মারা যাওয়ার পর থেকে হাজীগঞ্জের মাতৈন গ্রামে ঔরসজাত সন্তান কামাল পাটওয়ারীকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করতে বাধা দেয় বাবা আবদুল কাদের। একই ঘটনায় নিজেদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে লাশ দাফনে বাধা দেয় মৃত কামালের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বিউটি ও তার সন্তানরা।
ঘটনার দিন মৃতের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বিউটি জানান, প্রায় ২৩ বছর পূর্বে তার সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় হাজীগঞ্জ উপজেলার ৫নং সদর ইউনিয়নের মাতৈন পাটওয়ারী বাড়ির আবদুল কাদের পাটওয়ারীর ছেলে কামাল পাটওয়ারীর। তিনি কালো হওয়ায় তার শ্বশুর-শাশুড়ি কামালের স্ত্রী হিসেবে তাকে মেনে নেয়নি। তার ওপর বিভিন্ন সময় নির্যাতন করতো। বিশেষ করে তার শাশুড়ি ও ননদদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন বলে দাবি করেন বিউটি। তিনি আরো জানান, ২০০০ সালের দিকে আমার বাবার পরিবার টাকা খরচ করে কামালকে বিদেশ পাঠায়। কামাল বিদেশ যাওয়ার পর সব টাকা তার বাবার নামে পাঠাতো। তারপরেও সে তার বাবা-মা ও বোনদের মন জয় করতে পারেনি। এক পর্যায়ে কামাল অসুস্থ হয়ে পড়লে বিদেশ থেকে দেশে চলে আসে। সেই সময় কামালকে তার পরিবারের কেউ কোনো চিকিৎসা করাতে এগিয়ে আসেনি। এমতাবস্থায় তাকে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এমপির সহযোগিতায় ঢাকায় চিকিৎসা করান। তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় কামাল মৃত্যুবরণ করলে লাশ দাফন করার জন্য বাড়িতে আনি। কিন্তু আমার শ্বশুর কামালকে তার সন্তান নয় বলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনে বাধা দেয়। এখন আমিও আমার সন্তানের ন্যায্য দাবি শ্বশুর থেকে বুঝে না নেয়া পর্যন্ত লাশ দাফন করতে দেবো না। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন জানান, কামালের স্ত্রী ও সন্তানের দাবির প্রেক্ষিতে তাদেরকে থাকার জন্য কামালের ক্রয়কৃত সোয়া ৯ শতাংশ জমি স্ত্রী ও তার ছেলেদের নামে দেয়া হবে বলে রাতেই একটি স্ট্যাম্প করা হয়। সর্বশেষ সোমবার রাত বারোটার পর সব বিষয়ে সমাধান করে কামাল পাটোয়ারীর লাশ দাফন করা হয়।
হাজীগঞ্জের কামাল অকালে মরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীর সংবেদনশীল মানসিকতায় এবং ইউপি চেয়ারম্যানের আন্তরিক ভূমিকায় নিজেদের কবরস্থানে নিজের কবর তথা চিরশয়ানটাকে নিশ্চিত করতে পেরেছেন। সাধারণত সন্তানরা তাদের ন্যায্য পাওনা না পেলে পিতার লাশ দাফন কিংবা শেষ কৃত্যে বাধা প্রদান করে, আর হাজীগঞ্জে পিতা করেছেন উল্টোটা। এই উল্টো কাজটায় আঃ কাদের নামের এই ঘৃণিত পিতা যদি সফল হয়ে যেতেন, তাহলে তিনি স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যম শুধু নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্থান পেয়ে চরমভাবে নিন্দিত হতেন। কিন্তু তার ইউনিয়নের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (চেয়ারম্যান) আবু ইউসুফ প্রধানীয়া সুমন বিনিদ্র রজনী যাপন করে সেটি হতে দেন নি। এজন্যে তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। তিনি শেষ পর্যন্ত কামালের বিধবা স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের প্রতি অনুরাগভাজন থাকবেন সেটাও প্রত্যাশা করছি। আর কামাল কোন্ অপরাধে তার পিতার মালিকানাধীন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলেন সেটাও ইউপি চেয়ারম্যান সাধারণ্যে খোলসা করবেন। এতে কামালের মতো অন্য দুর্ভাগা সন্তানরা সাবধান হবেন কিংবা শিক্ষাগ্রহণ করবেন। কথা হলো, শেষ পর্যন্ত ইউপি চেয়ারম্যান এতো তিক্ত কাজটা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন?