প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
এটা যেন তাদের লাইফলাইন রক্ষার প্রয়াস

‘হাজীগঞ্জে কৃষকের টাকায় চলছে মিঠানিয়া খাল খনন’। এমন শিরোনামের সংবাদে কিছুটা অবাক হতে হয়। কারণ, আমাদের দেশে অপ্রয়োজনীয় খাতে সরকারি ব্যয়ের অনেক নজির আছে। আবার প্রয়োজনীয় খাতে সরকারি বরাদ্দ নিয়ে সে বরাদ্দ লুটেপুটে খাওয়ার নজিরও আছে। সেই দেশেই কৃষক তার ফসল উৎপাদনের জন্যে অনিবার্য খাল খননের প্রয়োজনে সরকারি বরাদ্দ পায় না, সেটা ভাবতে অবাক লাগে।
|আরো খবর
গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বের সাথে উপরোক্ত শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটিতে কামরুজ্জামান টুটুল লিখেছেন, হাজীগঞ্জে ডাকাতিয়া নদীর পানি ইরি-বোরো চাষের কৃষি জমিতে নিতে স্থানীয় কৃষকরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছে। নিজেদের টাকায় তারা ঐতিহ্যবাহী মিঠানিয়া খাল খনন শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খাল খননে নীরব ভূমিকা পালন করায় স্থানীয় কৃষককুল ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরজমিনে গেলে দেখা যায়, মিঠানিয়া খালটি হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার খাটরা বিলওয়াই পেপসিঘাট সংলগ্ন ডাকাতিয়া নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের পাশ ঘেঁষে উত্তরে রেললাইন ধরে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মূল এই অঞ্চলের কৃষি জমির পানি ডাকাতিয়া নদী থেকে সরবরাহ পেয়ে কৃষিতে ব্যবহার করছে স্থানীয় কৃষকরা। চলতি মৌসুমে খালটি দখলে, দূষণে অনেকটা ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে গত শনিবার ২১ জানুয়ারি থেকে কৃষকরা নিজেরা টাকা তুলে খালটি খননের কাজ শুরু করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই খাল দিয়ে এক সময় নৌকা যোগে লোকজন চলাচল করতো। বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে মাছ শিকার করে মানুষ পারিবারিক চাহিদা পূরণ করে সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতো। খালটির সবচে’ বড় ভূমিকা ফসল উৎপাদনে। খালের পানি ব্যবহার করে পৌরসভাধীন ৩, ৪ ও ৫নং ওয়ার্ডের খাটরা বিলওয়াই ও মকিমাবাদ গ্রাম, হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সুদিয়া, মাতৈন, দোয়ালিয়া, মৈশাইদ, খাকবাড়িয়া, বাড্ডা, বাউড়া, শাহপুর, সুবিদপুর, মাড়ামুড়া ও কালচোঁ গ্রামের একাংশে প্রায় কয়েক হাজার কৃষক ফসল ফলাতেন। কিন্তু দিনে দিনে খালটি দূষণ ও দখলের কারণে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি প্রবাহ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে পৌরসভা এলাকার হাজীগঞ্জ বাজারস্থ মিঠানিয়া ব্রীজের দক্ষিণ ও উত্তর পাশে আবর্জনা, দখল ও দূষণের ফলে খালটির পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, খালটি পুনরুদ্ধার ও খননে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে বহুবার বলা হলেও বারবার আশাহত হতে হয় তাদের। এই খালটি দিয়ে সাত-আটটি কৃষি মাঠের পানি নিষ্কাশন হতো। কৃষকদের অর্থায়নে মিঠানিয়া ব্রীজের অংশে খাল খননের কাজ শুরু করা হয়। ভেকু দিয়ে মিঠানিয়া ব্রীজের দুই পাশে খাল থেকে ময়লা-আবর্জনা ও মাটি অপসারণ করা হচ্ছে। খালটির এ অংশ খনন হয়ে গেলে পানি প্রবাহ শুরু হবে এবং খাটরা-বিলওয়াই ও মকিমাবাদ গ্রামের অনাবাদী জমিতে চাষাবাদ হবে।
খাটরা-বিলওয়াই মাঠের স্কীম ম্যানেজার মোঃ আবুল হাসেম অভিমানের সুরে বলেন, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তাসহ কতজনের কাছে কৃষকরা গিয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। সামনে হবে কিনা তাও জানি না। তাই কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আমরা (কৃষকরা) নিজস্ব অর্থায়নে খাল খননের কাজ শুরু করেছি।
খাল খননে সহায়তাকারী কৃষকদের প্রশংসা ও তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলরুবা খানম জানান, প্রধানমন্ত্রীর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনাবাদী জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যে ওই এলাকার কৃষকরা খাল খননে এগিয়ে এসেছেন। এতে খালে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং ওই এলাকার প্রায় ৪৫ হেক্টর অনাবাদী জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। তিনি খালটি খননের বিষয়ে বিএডিসি’র সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএডিসি কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সেচ) মোঃ মামুন রশিদের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ ও পরে ব্যাক না করায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রাশেদুল ইসলাম জানান, কৃষকেরা স্বেচ্ছায় খালে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করছেন। এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তিনি বলেন, টেকসই ব্যবস্থাগ্রহণে আমি মেয়র সাহেবের সাথে কথা বলবো।
বলা দরকার, প্রতিটি শহরেই কিছু খাল লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে। চাঁদপুর শহরে এমন ক'টি খালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হচ্ছে নূতনবাজার এলাকার এসবি (শ্রীরামদী-বিষ্ণুদী) খাল এবং পুরাণবাজার এলাকার নাপিতবাড়ি খাল। তেমনি হাজীগঞ্জেও এমন দুটি খাল হচ্ছে মিঠানিয়া খাল ও বোয়ালজুরি খাল। এমন খাল কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে উপকারভোগী মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, প্রতিক্রিয়া, ক্ষোভ যেটাই বলি না কেনো সেটা দেখা যায় প্রকটভাবে। বিপন্ন মানুষ, বিশেষ করে ডুবুরি তার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ব্যবহৃত দড়ির ওপর যেমন নির্ভরশীল, কৃষক তেমনি তার ফসল উৎপাদন ও বাঁচানোর জন্য এবং খালের তীরবর্তী বাসিন্দারা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি নিষ্কাশনের জন্যে খালের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে কোনো কোনো খালকে লাইফলাইন হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। আমাদের পর্যবেক্ষণে মিঠানিয়া তেমন একটি খাল। এ খালটিতে অতি প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে উদ্বেগাকুল কৃষকরা নিজ খরচে খননের যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটাকে ইউএনও, কৃষি কর্মকর্তা প্রশংসনীয় বললেও আমরা বলতে চাই সময়োপযোগী ও লাইফলাইন রক্ষার অনিবার্য প্রয়াস। তবে এই প্রয়াসকে টেকসই করতে সরকারি সহায়তার বিকল্প নেই। সেটি সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকতার সাথে ভেবে দেখার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।