প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

আমাদের দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হিড়িক লক্ষ্য করা যায় বর্ষাকালে। শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে তেমনটি লক্ষ্য করা যায় না। তারপরও যখন এ সময়টাতে কোথাও শিশুমৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় এবং সেটি গণমাধ্যমে বিশেষ খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়, তখন পাঠক/শ্রোতা থমকে যায়। থমকে যাওয়ার মতোই এমন একটি খবর গত ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে চাঁদপুর কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায়। শিরোনাম হয়েছে ‘পানিতে ডুবে ২ সহোদর শিশুর করুণ মৃত্যু’। শিরোনাম পড়েই পাঠকের মধ্যে তৈরি হয় ভীষণ দুঃখবোধ।
এ খবরটিতে চাঁদপুর কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিনিধি আলমগীর কবির লিখেছেন, হাজীগঞ্জ উপজেলার মুকুন্দসার গ্রামের মোঃ সইফুল ইসলাম পাটওয়ারীর দুপুত্র সাইমুন (৭) ও তামিম (৫) গত বুধবার (১৩ এপ্রিল ২০২২) সকাল ১০টায় নতুন পাটওয়ারী বাড়ির পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। সাঁতার না জানা এ দু শিশু প্রতিদিনের ন্যায় বাড়ির পুকুর পাড়ে খেলাধুলা করছিলো। মায়ের দৃষ্টির অগোচরে তারা সেখানে খেলতে যায়। অনেক সময় পার হয়ে যাবার পর মা তার দু সন্তানকে হন্যে হয়ে চারদিকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে পুকুরের পানিতে তল্লাশি শুরু করেন। আশেপাশের লোকজনের সহযোগিতায় অবশেষে নাড়িছেঁড়া ধন দু শিশু পুত্রকে খুঁজে পান পানির নিচে। সেখান থেকে তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু কর্মরত চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। এ দুটি সন্তান ছাড়া সাইফুল ইসলাম পাটওয়ারীর আর কোনো সন্তান না থাকায় এবং তাদের দুজনেরই এমন করুণ মৃত্যু হওয়ায় এলাকায় গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
‘গ্লোবাল হেল্থ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরে’র সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ গত ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গবেষণা চালিয়ে জানায় যে, বাংলাদেশের যে ক’টি জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচে’ বেশি ঘটেছে, তন্মধ্যে চাঁদপুরও রয়েছে। উক্ত ১১ মাসে চাঁদপুর জেলায় ৪১ জন মারা গেছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, পানিতে ডোবার ৭৯ শতাংশ ঘটনা ঘটে দিনের বেলায়। দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে অধিকাংশ মৃত্যু ঘটে। পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরদারি না থাকায় সবচে’ বেশি সংখ্যক শিশুর পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটে এবং এতে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু মৃত্যুবরণ করে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
সাধারণ পর্যবেক্ষণে জানা যায় যে, আমাদের দেশের পরিবারগুলোতে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিশুদের মায়েরা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বাবা যায় বাজারে, নয়তো কর্মস্থলে। আর বড় ভাই-বোন যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা তাদের কর্মস্থলে। এ সময় গ্রামীণ শিশুরা বড়দের অগোচরে আপন মনে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে এবং খেলাধুলা করে। এক সময় পুকুর বা জলাশয়ের পানির সংস্পর্শে যায় এবং এক পর্যায়ে পানিতে পড়ে ডুবে গিয়ে করুণ মৃত্যুর শিকার হয়।
এক সময় মানুষ ভাবতো, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু মানেই অপ্রতিরোধ্য বিষয়। কিন্তু সারাবিশে^ গ্লোবাল হেল্থ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর ও ‘সমষ্টি’র মতো অনেক প্রতিষ্ঠান গবেষণা চালিয়ে ও বিশ্লেষণ করে এটা প্রমাণ করেছে যে, কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। সুখের বিষয় এই যে, প্রাগুক্ত গবেষণার আলোকে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। সরকার ও দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পাইলট তথা পরীক্ষামূলকভাবে দেশের ক’টি জেলায় কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। শিশু সুরক্ষার জন্যে দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার অতি শীঘ্রই প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ যাতে গ্রহণ করে, সেজন্যে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।