প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০০
ইন্দির ঠাকরুণ এক প্রবীণ নারীর নিঃশব্দ সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘পথের পঁাচালী’ শুধু গ্রামীণ জীবনের কাব্য নয়, এটি এক প্রবীণ নারীর সামাজিক অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার গল্পও। ইন্দির ঠাকরুণ চরিত্রটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়Ñসময়ের সঙ্গে মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে, সমাজ কী নির্মমভাবে প্রবীণ নারীকে উপেক্ষা করতে পারে।
ইন্দির এক সময়কার গৃহস্থ পরিবারের আপনজন, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচয় ঝাপসা হয়ে যায়। পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়, কিন্তু সম্মান দেয় না। খাবার, অবস্থান আর জায়গা–সব কিছুতেই তাকে ‘বোঝা’ হিসেবে দেখা হয়। আজকের সমাজেও বহু প্রবীণ নারী একই বাস্তবতার মুখোমুখিÑবাড়িতে আছেন, কিন্তু পরিবারের মানচিত্রে নেই; বেঁচে আছেন, কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতায় অনুপস্থিত।
ইন্দির ঠাকরুণ নিজস্ব মর্যাদা নিয়ে বঁাচতে চান, ভিক্ষাবৃত্তির মতো জীবন নয়, বরং ‘চিনে রাখা মানুষ’ হিসেবে বঁাচার আকাঙ্ক্ষা তার চোখে ফুটে উঠে। তিনি দিদিমাদের মতো গল্প বলেন, স্নেহ বিলানÑকিন্তু পরিবর্তিত সময়ের গৃহস্থালি নীতিতে অনুভূতির জায়গা আর নেই, আছে কেবল উপযোগিতার হিসাব। আজকের যুগে প্রবীণ নারীরা যখন সন্তানদের ঘরে থেকেও একাকীত্ব অনুভব করেন, কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে ঠঁাই নেনÑইন্দির সেই একই প্রবহমান বেদনার প্রতীক।
সত্যজিৎ রায় অসাধারণ নৈপুণ্যে দেখিয়েছেন, একজন প্রবীণ নারীর সবচেয়ে বড়ো যন্ত্রণা অনাদর নয়, ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে যাওয়া। এটি কেবল সিনেমার গল্প নয়। সমসাময়িক সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে, প্রবীণ নারীরা পারিবারিক পরিসর থেকে প্রান্তসীমায় সরে যাচ্ছেন। ইন্দিরের জীবনে অপর আর দুঃখে ভরা হাসি আজকের প্রবীণ নারীদের আবৃত কান্নার মতো।
চরিত্র হিসেবে ইন্দিরের আরেকটি দিক লক্ষ্যণীয়Ñ তিনি সহায়হীন হলেও আত্মসম্মানে অটল। ক্ষুধার্ত থাকলেও কারও কাছে নিজের দীনতা প্রদর্শন করেন না। এই আত্মমর্যাদাবোধই তাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে আজকের স্বনির্ভর প্রবীণ নারী আন্দোলনের সাথে। বর্তমানে সমাজে ‘প্রবীণ কল্যাণ’ বা ‘বয়স্কদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন’ নিয়ে যে কথা বলা হয়, ইন্দির আসলে তারই এক প্রাথমিক রূপক।
তিনি একা, কিন্তু ভেঙ্গে পড়েন না। তিনি আশ্রয় খেঁাজেন, কিন্তু করুণা চান না। এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রবীণ জীবনের মর্যাদার রাজনৈতিক উচ্চারণ হিসেবে দঁাড়িয়ে যায়। যখন তিনি দূরে গিয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করেন, সিনেমাটি আমাদের মনে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়Ñ’প্রয়োজন ফুরালেই কি সম্পর্কের মূল্য শেষ হয়ে যায়?’
ইন্দির ঠাকরুণ কেবল একটি চরিত্র নন, তিনি আমাদের সমাজের মুখোমুখি দঁাড় করানো এক প্রবীণ প্রশ্নÑ’প্রবীণ নারী কি পরিবারে আশ্রিত থাকবেন, নাকি মর্যাদার সাথে দৃশ্যমান হবেন?’
ওনার নাম চুনীবালা দেবী, ইন্দির ঠাকরুন চরিত্রে যখন অভিনয় করেছেন, তখন ওনার বয়স অতিক্রম করেছে।







