শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৪

শিশুর জীবনমুখী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার রূপরেখা

রাশেদা আতিক রোজী
শিশুর জীবনমুখী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার রূপরেখা

শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় শিক্ষকগণ শ্রেণীকক্ষের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগতভাবে নানাভাবে সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেন। এখানে কিছু প্রধান ক্ষেত্র তুলে ধরা হলো যেখানে শিক্ষকরা সহযোগিতা করেন :

স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে সহযোগিতা

* পাঠ্যসূচিতে স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তিকরণ : শিক্ষকরা বিজ্ঞান, জীবন বিজ্ঞান, বা নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্লাসে পুষ্টি, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এবং রোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

* সঠিক খাদ্যাভ্যাসের শিক্ষা : তারা শিশুদের ফাস্ট ফুডের নেতিবাচক দিক এবং ফল, সবজি ও সুষম খাদ্যের উপকারিতা শেখান। টিফিন বক্সের খাবার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করেন।

* ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা : হাত ধোয়ার সঠিক পদ্ধতি, দঁাত মাজা, নখ কাটা, এবং পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধানের মতো মৌলিক অভ্যাসগুলো শেখান এবং উৎসাহিত করেন।

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে সহযোগিতা

* শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করা : পিটি, খেলাধুলা, এবং ক্লাসের মধ্যে ছোট ব্রেক বা ব্যায়ামের মাধ্যমে তারা শিশুদের দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক কার্যকলাপের প্রয়োজনীয়তা বোঝান।

* মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ : শিক্ষকরা শিশুদের নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে শেখান, বন্ধুত্বের মূল্য বোঝান এবং মানসিক চাপ বা উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করেন। প্রয়োজনে স্কুলের কাউন্সেলরের কাছে যেতে উৎসাহিত করেন।

* নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ : বুলিং বা যেকোনো ধরনের হয়রানি থেকে শিশুদের রক্ষা করে একটি নিরাপদ ও সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেন।

পর্যবেক্ষণ ও প্রাথমিক সচেতনতা

* স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ : শিক্ষকরা শিশুদের আচরণ, ক্লান্তি, অসুস্থতার লক্ষণ (যেমন: ঘন ঘন কাশি, জ্বর, দুর্বলতা) বা আঘাতের দিকে নজর রাখেন।

* সময়মতো তথ্য জানানো : যদি কোনো শিশুর স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা অস্বাভাবিকতা তাদের নজরে আসে, তবে তারা দ্রুত অভিভাবক বা স্কুল কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে অবহিত করেন, যাতে সময়মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।

* জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা : ছোটখাটো আঘাত লাগলে বা অসুস্থ বোধ করলে শিক্ষকরা প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং প্রয়োজনে অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করেন।

অভিভাবক ও সমাজের সাথে সংযোগ

* অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠক (চঞগ) : এই সভাগুলোতে শিক্ষকরা শিশুর স্বাস্থ্যগত কোনো বিশেষ প্রয়োজন বা অভ্যাস নিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করেন এবং বাড়িতেও একই ধরনের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে উৎসাহিত করেন।

* স্বাস্থ্য শিবির বা সচেতনতা প্রোগ্রাম : স্কুলে আয়োজিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির, টিকা প্রদান কর্মসূচি, অথবা পুষ্টি সপ্তাহ পালনে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং শিশুদের উৎসাহিত করেন।

শিক্ষকরা শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রথম সারির যোদ্ধা। তারা শুধুমাত্র জ্ঞান দেন না, বরং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ভিত্তি গড়ে তোলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকগণ, যারা নিজ নিজ জ্ঞানরাজ্যে সুউচ্চ প্রাসাদের নির্মাতা, তারা প্রায়শই পাশের প্রাসাদের খবর রাখেন নাÑবাংলা শিক্ষক ইংরেজির খেঁাজ নেন না, গণিত শিক্ষক ইতিহাস থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনি, এই সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভূমিকার অধিকারী। আপনি শুধু বর্ণমালা বা সংখ্যা শেখান না; আপনি এক ফাউন্ডেশনের প্রকৌশলী। আপনি একইসাথে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-জীবনের পাঠ শেখানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। একটি শিশুর শেখার যাত্রায় পাঠ্যবই হচ্ছে রূপরেখা, আর আপনি হচ্ছেন সেই কারিগর যিনি তাতে প্রাণ সঞ্চার করেন।

‘সোজা হয়ে দঁাড়াও’ থেকে ‘জাতীয় পতাকাকে সম্মান করো’ অথবা ‘খাবারের আগে হাত ধোও’বা ‘টয়লেট থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধোও’ Ñএই মৌলিক শিক্ষাগুলি কেবল পাঠ্যসূচির অংশ নয়, এগুলি জীবন নামক মহাপ্রাসাদের মূল ভিত্তি। এই দৈনন্দিন জীবন-ব্যবস্থাপনার দক্ষতাগুলোই একজন শিশুকে সামাজিক, সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্য-সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।

সম্প্রতি একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সম্ভবত ভিডিওটি চাইনিজ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন শিশু শ্রেণির একটা ক্লাসের ভিডিও। সেখানে শিক্ষিকা ক্লাসে দেখাচ্ছে টয়লেট শেষে কীভাবে টিস্যু পেপার ব্যবহার করে তা নির্ধারিত ঝুড়িতে ফেলতে হয়।টিচার কোমরের নিচের অংশের বিশেষ কস্টিউম পরে এই রোল প্লে করেছে।

এই সিমুলেশনেত সাধুবাদের পাশাপাশি অনেক সমালোচনা করে লিখেছেন এ শিক্ষা পরিবার থকে শিখবে এটা কেন স্কুলে? কিন্তু অশিক্ষিত বা অসচেতন অভিভাবকরা স্বাস্থ্যবিধির দিকে নজর রাখে না।আমাদের মত পশ্চাৎপদ সমাজের অভিভাবকরা শিশুদের মল মূত্র পরিষ্কারের ক্ষেত্রে খুবই উদাসীন। তাদের তো ধারনা বাচ্চাদের মলে বেশী স্বাস্থ্যঝুকি নেই!

তারা বাচ্চার টয়লেটের পর পানি দিয়েধুয়ে পরনের শাড়ির যে আচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে, ঐ একই আচল দিয়ে খাওয়ার পরে শিশুর মুখসহ নিজের মুখ মুছে দিচ্ছে। সো চাইনিজ ঐ ক্লাসের একটি ভিডিও হতে মেসেজ হলো ‘শিক্ষা হবে জীবন মুখি(খরভব-ঈবহঃৎরপ ),শিশু কেন্দ্রিক(ঈযরষফ-ঋড়পঁংবফ)। তাহলে সেই শিক্ষা স্থায়ী হয়।

কেন আপনি ‘ফাউন্ডেশনের প্রকৌশলী’?

শিক্ষার প্রথম সোপানে দঁাড়িয়ে থাকা শিশুরা একটি নরম কাদার দলার মতো। তাদের জ্ঞান, অভ্যাস, সামাজিক সচেতনতাÑসবকিছুই আপনার হাতে আকার পায়।

জ্ঞান ও দক্ষতার সেতু: আপনার কাজ শুধু ‘অ আ ক খ’ ‘অ ই ঈ উ’ বা ‘১ ২ ৩ ১ ২ ৩’ শেখানো নয়। আপনার প্রধান কাজ হলো পুঁথিগত বিদ্যা এবং দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার মধ্যে একটি দৃঢ় সেতু তৈরি করা। যখন আপনি স্বাস্থ্যবিধি শেখান, তখন আপনি কেবল একটি স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য দিচ্ছেন না; আপনি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের ভিত্তি স্থাপন করছেন।

অসচেতনতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা: আমাদের সমাজে এমন অনেক অভিভাবক আছেন যারা অসচেতনতাবশত শিশুদের মলমূত্র পরিষ্কারের পর হাত ধোয়ার গুরুত্ব বোঝেন না, অথবা একই বস্ত্রে অস্বাস্থ্যকর কাজ করে। এই পরিস্থিতিতে, আপনার ভূমিকা শুধু শিক্ষকের থাকে না, আপনি হয়ে ওঠেন স্বাস্থ্য ও সচেতনতার দূত। পরিবার যা শেখাতে ব্যর্থ হয়, ক্লাসরুমের জীবন্ত শিক্ষাই তা পূরণ করে। “একটি শিশুর হাতে সঠিকভাবে টিস্যু পেপার ধরানো, একটি জটিল সমীকরণ শেখানোর চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়”

পাঠকে ‘জীবন্ত’ করে তোলার কৌশল

আপনার হাতেই রয়েছে সেই যাদুর কাঠি যা শিক্ষাকে নীরস না রেখে আকর্ষণীয় ও স্থায়ী করে তুলবে। কীভাবে?

রোল-প্লে ও সিমুলেশন (জড়ষব-চষধু ধহফ ঝরসঁষধঃরড়হ): টয়লেট ব্যবহারের চীনা ভিডিওটির মতো, আপনিও শিক্ষাকে অভিনয় বা খেলার মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলুন। হাত ধোয়ার সঠিক পদ্ধতি শেখানোর জন্য গান তৈরি করুন। ‘বাজারে কেনাকাটা’র ধারণা দিতে ক্লাসরুমে একটি ছোট বাজার তৈরি করুন। এতে শিশু সরাসরি ব্যবহারিক ধারণার প্রয়োগ দেখবে।

আকর্ষণীয় ও জীবন-ঘনিষ্ঠ প্রশ্ন: ক্লাসরুমে অঙ্ক কষানোর সময় জিজ্ঞেস করুন: “বাজার থেকে তুমি ৫টি মিষ্টি কিনলে। তোমার বাবা তোমাকে আরও ৩টি দিলেন। এখন তোমার কাছে ক’টি হলো?”Ñগণিত সরাসরি জীবনের কাজে চলে এলো।

শিক্ষাক্রমের বাইরেও শিখন: পাঠ্যবইয়ে হয়তো ‘সময়ানুবর্তিতা’ নেই। কিন্তু আপনি ক্লাসে প্রতিদিনের কাজ সময়মতো শেষ করার অভ্যাস তৈরি করে দিচ্ছেন। এটিই ভবিষ্যতের একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের প্রথম পাঠ।

আপনিই আসল নায়ক/নায়িকা

প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে, আপনি জানেন, প্রতিটি শিশু এক অপার সম্ভাবনা। আপনার হাতে কেবল খাতা-কলম নয়, তাদের ভবিষ্যতের শক্ত ভিতের নকশা। আপনিই সেই আসল নায়ক-নায়িকা, যারা নিরলসভাবে এই ফাউন্ডেশন নির্মাণে লিপ্ত।

আসুন, আমরা সকলে একমত হইÑশিক্ষাকে কেবল পাশ করার মাধ্যম না রেখে, জীবনের প্রতিচ্ছবি করে তুলি। যখন একটি শিশু আপনার ক্লাসে শেখা হাত ধোয়ার অভ্যাসটি তার পরিবারে নিয়ে যায়, যখন সে জাতীয় পতাকাকে দেখলেই সোজা হয়ে দঁাড়ায়, তখন বুঝবেন আপনি কেবল একজন শিক্ষক নন, আপনি একটি সচেতন, স্বাস্থ্যবান ও উন্নত সমাজের রূপকার।

আপনার এই জীবনমুখী শিক্ষাদানই শিশুকে সত্যিকার অর্থে ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ভিতের ওপর দঁাড় করাবে। আপনার কাজ শুধু চাকরি নয়, এটি একটি মহান জাতি গঠনের ব্রত। আপনিই ফাউন্ডেশনের স্থপতি, আপনার হাতেই আমাদের নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

তাই আমাদের মনে রাখতে হবে-উন্নত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে সকল শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি সমান মনোযোগ দিতে হবে। কেননা প্রতিটি শিশুই অনন্য এবং অসীম সম্ভাবনাময়। সব শিশুকে সমভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া উচিত।

রাশেদা আতিক রোজী : ইনস্ট্রাক্টর, উপজেলা প্রাইমারি এডুকেশন ট্রেনিং সেন্টার (ইউপিইটিসি), হাজীগঞ্জ, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়