প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১২
বারান্দায় সন্ধ্যাতারা

ছোট্টবেলা থেকে দেশের বিভিন্ন মফস্সল শহরে থেকেছে শেহরিন। বাবার বদলির চাকরি। সেই সুবাদে দেশের বহু জেলায় থাকা হয়েছে শেহরিনের। ওর বয়স এখন তেরো। কদিন আগেই বাবার বদলি হয়েছে ঢাকায়। তাই খুব মন খারাপ শেহরিনের। ঢাকা শহরটাকে ওর মনে হয় ধুলায় ধুলায় ঢাকা। আকাশটা দেখা যায় কি যায় না! এই শহরে আগের শহরগুলোর মতো ফুল নেই, গাছ নেই, সকাল–সন্ধ্যায় কিচিরমিচির করা পাখির দল নেই। নেই ঝিঁঝির ডাক। চারদিকে এত আলো যে অন্ধকারের সৌন্দর্যটা হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। পূর্ণিমার চঁাদের আলো পেঁৗছে না উঁচু বাড়ির ছাদটাতেও। পুরোনো দিনের কথা তাই খুব মনে পড়ে ওর আজকাল।
এই বাসাটা একটা খঁাচার মতো। আগের বাসাগুলোর চেয়ে অনেকটাই ছোট। মাঝেমধ্যে দম আটকে আসার মতো অনুভূতি হয় শেহরিনের। উচ্ছলতা হারিয়ে যেতে থাকে ওর জীবন থেকে। বারান্দায় কিছু গাছপালা লাগিয়েছে ওরা। তাতেও অবশ্য প্রকৃতিকে খুব একটা নিজের মতো করে পায় না ও। ফুল আর পাখি যে ওর ভীষণ পছন্দ। কিন্তু বারান্দায় রোদ কম আসে বলে গাছে ফুল ধরে না খুব একটা। কিছু পাখি উড়ে যায় দূরে কোথাও। ঘরের কাছে কোনো পাখির মধুর ডাকে ওর মনটা খুশিতে নেচে ওঠে না।
ওর বাবা খুব ব্যস্ত থাকেন। কাজের চাপেই তঁার দম ফেলবার সময় নেই। বুঝতেই পারেন না, কী চলছে মেয়ের মনে। কিন্তু ওর মন খারাপের ব্যাপারটা মা ধরে ফেলেন সহজেই। তঁার নিজেরও যে দম আটকে আসে এই বাড়িটায়। মা অনুভব করেন, শেহরিন তঁারই মতো প্রকৃতির কাছাকাছি বেড়ে উঠেছে। ইটপাথরের এই যান্ত্রিক শহরে তাই মনে মনে মরে যাচ্ছে মেয়েটা।
মা বুঝতে পারেন, শেহরিনের জীবনে প্রকৃতির আরেকটু ছেঁায়া প্রয়োজন। তাই রোজ ভোরে ওকে নিয়ে রমনা পার্কে হঁাটতে যেতে শুরু করলেন তিনি। প্রকৃতির সান্নিধ্য শেহরিনকে আনন্দ দেয়। এখন রোজ রাতে সে পরের ভোরের জন্য প্রতীক্ষা করে। ঘুমিয়েও পড়ে জলদি। ভোরে উঠে পার্কে যেতে হবে তো মায়ের সঙ্গে!
দুই
চার দিন ধরে মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। হঁাটতে যাওয়া হচ্ছে না আর। পঞ্চম দিন সকাল সকালই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলেন মা। শেহরিনও গেল সঙ্গে। বহির্বিভাগের সামনে পেঁৗছাতেই হঠাৎ বকুল ফুলের ঘ্রাণ পেল শেহরিন। তাকিয়ে দেখল, মাটিতে পড়ে আছে অনেকগুলো বকুল ফুল। কোনোটা তরতাজা, কোনোটা আবার মানুষের পায়ের চাপে পিষ্ট। হাসপাতালের সামনের জায়গাটার বাতাসে নানা রকম ঘ্রাণ। এই ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকরও বটে। তবে বকুলের ঘ্রাণে মুগ্ধ হলো শেহরিন।
ডাক্তার দেখানোর পর জানা গেল, বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে মায়ের। বহির্বিভাগ থেকে একটু এগিয়ে গেলে রেডিওলজি বিভাগ। সেখানে টাকা জমা দিয়ে এক্স-রে আর আলট্রাসনোগ্রামের জন্য সিরিয়ালে থাকতে হবে মাকে। রক্ত পরীক্ষার জন্য যেতে হবে এই ভবনের লম্বা, টানা করিডর পেরিয়ে আরেক ভবনে। কফের পরীক্ষার জন্য আবার যেতে হবে অন্য আরেকটি ভবনে। কারণ, হাসপাতাল ভবনে নয়, মেডিকেল কলেজ ভবনের দোতলায় হয় কফ পরীক্ষা।
এই ছোটাছুটিতে মায়ের পাশেই থাকার ইচ্ছা ছিল শেহরিনের। মা বললেন বাবাকে ফোন করে ডেকে নিতে। সেটাই করল শেহরিন। ফোন পেয়ে বাবাও চলে এলেন দ্রুত। আলট্রাসনোগ্রামের জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজেই বেশ অধৈর্য হয়ে উঠলেন। বেলা বাড়ছে। বাড়ছে ভিড়। মানুষ কতটা অসহায়, তা যেন এখানে এসে নতুনভাবে উপলব্ধি করলেন তিনি। অপেক্ষা করার জায়গায় আসনসংখ্যা খুব কম। একজন অসুস্থ মানুষকে নিজের আসনটা ছেড়ে দিল শেহরিন। দঁাড়িয়ে রইল মায়ের পাশে।
বাবা ভাবলেন, এখানে যতটা সময় লাগবে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করতে, ততটা সময় শেহরিনের সত্যিকার অর্থে করার তেমন কিছু নেই। স্ত্রীর পাশে তো তিনি রয়েছেনই। শেহরিনকে বরং আশপাশে কোথাও ঘুরে আসতে বলা যায়। ওর তো আজ ক্লাস নেই। এই ভেবে তিনি ফোন করলেন ভাতিজি পুনমকে। শেহরিনের পুনম আপু। পুনম আপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। সবটা শুনে পুনম আপু জানাল, সে এসে শেহরিনকে নিয়ে যাচ্ছে এক্ষুনি।
মিনিট কুড়ি পর পুনম আপু হাজির। হাসিখুশি মানুষ পুনম আপু। শেহরিন ঢাকায় আসার পর অবশ্য তার সঙ্গে মাত্র একবারই দেখা হয়েছে। আর দেখা হলো আজ। আপু সঙ্গে করে নিজের ক্যাম্পাসে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ওর ক্যাম্পাসটা নাকি খুব সুন্দর।
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই মুগ্ধ হয়ে গেল শেহরিন। ক্যাম্পাসটা সত্যিই অন্য রকম। একটু এগোতেই চোখে পড়ল কাঠগোলাপগাছ। গাছের নিচে পড়ে আছে কিছু ফুল। আরে! একটা কাঠবিড়ালি! দৌড়ে গেল ওপাশটায় চোখের নিমেষে। পাখিও আছে আশপাশে। খুশি হয়ে উঠল শেহরিন।
আপু বলল, ‘কী রে, কেমন লাগছে?’
‘দারুণ!’ বলল শেহরিন। ‘থ্যাঙ্ক ইউ, পুনম আপু!’
ভেতরটাও ঘুরে দেখল ওরা। কী চমৎকার পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ক্লাসরুমের বাইরে বসে ছবি অঁাকছে। দৃশ্যটা অসাধারণ মনে হলো ওর কাছে। ও ফিরে এল কাঠগোলাপগাছটার কাছে। কিছু ফুল কুড়িয়ে নিল। এই ক্যাম্পাসেও আছে বকুলগাছ। নিচের বঁাধানো জায়গাটাতে ও বসে থাকল অনেকক্ষণ।
তিন
কদিন পর মা সুস্থ হলেন। স্কুলের পড়ালেখার চাপও বাড়ছিল শেহরিনের। আগের মতো রোজ আর রমনা পার্কে যাওয়া হয়ে ওঠে না। মা তো বোঝেন, শেহরিনের মন কঁাদে। এর মধ্যেই মা একদিন শেহরিনের ঘরের বারান্দায় পাখিদের জন্য একটা পানির পাত্র রাখলেন। আরেকটা পাত্রে ছড়িয়ে দিলেন কিছু দানা। মনে আশা, যদি দু–একটা পাখি আসে। পাখি কিন্তু সত্যিই এল। কিচিরমিচির করে খাবার খেল। পানির পাত্র থেকে শুধু পানিই খেল না, তাতে গা ভিজিয়ে আনন্দও করল কিছুক্ষণ। আর তাতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেল শেহরিন।
পাখির জন্য নিয়ম করে পানি আর খাবার রাখা এবং পাত্রগুলো পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিজের কঁাধেই তুলে নিল সে। রোজ সকালের এই কাজটা একটা রুটিন হয়ে দঁাড়াল ওর জন্য। সারা দিনে কয়েকবার ওর বারান্দায় আসতে শুরু করে কয়েকটা চড়ুই, এক জোড়া বুলবুলি আর এক জোড়া মৌটুসি পাখি। পড়ার ফঁাকে ওরাই এখন ওর প্রশান্তি। এক জোড়া চড়ুই পাখি বাসাও গড়ে নিল বারান্দার ওপরের দিকটায়।
হঠাৎ এক সকালে শেহরিন দেখল, বারান্দার টবে অন্য গাছের পাশ দিয়ে একটা নতুন চারা গজিয়ে উঠছে। আরে! দেখে তো সন্ধ্যাতারার চারা মনে হচ্ছে। এই ফুলটার আরেকটা নাম আছেÑসন্ধ্যামালতী।
মাকে ডেকে দেখানোর পর মা বললেন, ‘হ্যঁা। সন্ধ্যাতারার চারাই তো রে। নিশ্চয়ই তোর পাখিরা বয়ে এনেছে এই সন্ধ্যাতারার বীজ।’
সন্ধ্যাতারার চারা বেড়ে উঠতে থাকল শেহরিনের অন্য গাছেদের সঙ্গে। শেহরিন অবশ্য ফুলের ব্যাপারে সন্দিহান। আদৌ এই গাছে ফুল ফুটবে তো! খুব একটা রোদ না পাওয়ায় অন্য গাছগুলোতে তো তেমন ফুল হয় না। কেবল পাতাই হয়। মা অবশ্য বেশ আশাবাদী এই গাছটার ব্যাপারে।
চার
শেহরিন আজ অনেক খুশি। সন্ধ্যাতারা গাছে ফুল ফুটেছে। গাঢ় ম্যাজেন্টা রঙের ফুল। শেষ বিকেলের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে ফুলটা। বারান্দার চেহারাটাই যেন বদলে গেছে এই একটা ফুলের উজ্জ্বলতায়। গাছে কলি আছে আরও বেশ কয়েকটা। মনে হচ্ছে, ফুলে ফুলে ভরে উঠবে গাছটা আর কদিন পরেই। আরও একটা চমৎকার কারণ আছে শেহরিনের খুশির পেছনে। সকালেই সে আবিষ্কার করেছে চড়ুই পাখির বাসায় ডিম ফুটে এক জোড়া ছানা বেরিয়েছে। একখণ্ড প্রকৃতি এখন সত্যিই তার বারান্দায় হাজির হয়েছে। পাখিরা ওর কাছে পেয়েছে এক নিরাপদ আশ্রয়। আর ওদের আনা বীজ থেকে যে গাছটা হয়েছে, সেই গাছটার ফুলেই তো ওর বারান্দা আলো করে ফুটেছে অদ্ভুত মায়াময় এক সন্ধ্যাতারা। সন্ধ্যাতারার বাকি কলিগুলোও নিশ্চয়ই ফুল হয়ে ফুটবে। শেহরিন সেই সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছে।
ছবি :
রকি বিচে কোথাও কেউ নেই
ফেরদৌস রহমান
কিশোরের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা টেনে দেখে ৪টার এদিক-ওদিক। অন্যদের কথা বাদ, স্বয়ং মেরিচাচীও এখনো ঘুমাচ্ছেন।
জেগে ওঠার কারণ খুঁজতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল তিন গোয়েন্দা প্রধান পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ড অন্ধকারে ডুবে আছে। রাস্তার লাইটের আবছা আলোয় ওয়ার্কশপের আদল বোঝা গেলেও হেডকোয়ার্টারের দিশা পাওয়া যায় না।
না, রাস্তার দিক থেকে কোনো শব্দ আসছে না। ইয়ার্ডেও সন্দেহজনক কিছুর আলামত নেই যাতে ঘুম ভাঙবে। একটু হতাশই হলো কিশোর।
এবারের বন্ধটা পুরো মাঠে মারা গেছে। হ্যঁা, ছুটির প্রথম কদিন গোবেল বিচে কাটিয়ে এসেছে মুসা-রবিনের সঙ্গে। জিনা ও রাফির সঙ্গে গোবেল দ্বীপেও দুর্দান্ত পিকনিক করেছে। কেরি আন্টির দুর্দান্ত রান্না আর পারকার আঙ্কেলের বেখেয়ালি আচরণে দারুণ সময় কেটেছে, কিন্তু কোনো রহস্য এসে ধরা দেয়নি।
রকি বিচে ফেরার পরও ভাগ্য ফিরল না। রবিন তার মিউজিক কোম্পানি, মুসা তার গাড়ি মেরামতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই সময়ে বরিস আর রোভারকে দিয়ে হেডকোয়ার্টারের কিছু মেরামতি সাড়িয়ে নিয়েছে কিশোর, কিন্তু সেখানে বসার কোনো সুযোগ আসেনি।
উপায় না দেখে ডেভিড ক্রিস্টোফারের অফিসেও একটা ফোন দিয়েছিল কিশোর। কিন্তু তিনি নেই, একটা মুভির কাজে স্পেনে, ফ্রান্সেও নাকি কাজ আছে। তাই বহুদিন ধরেই রহস্যের গন্ধ নাকে লাগছে না তিন গোয়েন্দার।
আর ঘুম আসবে না বুঝে পুলওভারটা টেনে নিল। ঠান্ডাটা ইদানীং জেঁকে বসেছে। মোবাইলটা নেবে কি নেবে না, এ নিয়ে ভাবল কিছুক্ষণ। পাজামার পকেটে নিয়েই নিল, আর কিছু না হোক টর্চটা কাজে লাগবে।
বাসা থেকে বের হতেই দরজা খোলার শব্দ কানে এল। বরিসের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কে ওখানে?’
‘বরিস ভাই, আমি কিশোর।’
‘ও তুমি, সব কিছু হোকে?’
‘হ্যঁা ভাই, সব হোকে।’
বরিস চারপাশটা দেখে নিয়ে নিশ্চিত হলো, আসলেই সবকিছু ‘হোকে’, তারপর আবার রুমে ঢুকে পড়ল।
হঁাটতে হঁাটতে হেডকোয়ার্টারের সামনে চলে আসে কিশোর। দুই সুরঙ্গের মুখটা দেখতে পাচ্ছে। অন্য কেউ দেখে মনে করবে জঞ্জালের অংশ। কিন্তু কিশোরদের বহুবার বঁাচিয়ে দিয়েছে এই পথ। শতচেষ্টাতেও শুটকি টেরি এর হদিস পায়নি।
সেদিকে তাকিয়ে কিশোরের খেয়াল হলো, ওরা তিনজন নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বহুদিন ধরেই, দিন শেষে এখন আর নিয়ম করে ওয়ার্কশপ বা হেডকোয়ার্টারে বসা হয় না।
তবু এমন খরা এর আগে কখনো যায়নি। শুধু এই ছুটি কেন, বহুদিন ধরেই নতুন কোনো রহস্য পাচ্ছে না ওরা। দুনিয়ার সব রহস্য যেন উবে গেছে হঠাৎ। কী হলো সবার? তিন গোয়েন্দার যাত্রা কি তবে শেষ হয়ে যাবে!
ঘরমুখো হবে, এমন সময় টুং করে উঠল মোবাইল। এ সময় আবার কে মেসেজ দিল, ভাবতে ভাবতে ফোন বের করে কিশোর। অবাক হয়ে দেখল, বাংলাদেশ থেকে মেসেজ এসেছে। বড় মামা; তাই ছোট্ট করে লেখা মেসেজ।
‘কিশোর, রকিব হাসান আর নেই।’








