প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৫
প্রবীণরা কেন প্রবীণদের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন?

বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ক্রমেই বাড়ছে। তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা, জ্ঞানের গভীরতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা সবার জন্যে অনুপ্রেরণার উৎস। তাই প্রবীণদের কল্যাণে নানা সংগঠন গড়ে উঠেছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য প্রবীণদের অধিকার রক্ষা, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং সুখী বার্ধক্য গঠন। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। দেখা যাচ্ছে, এসব সংগঠনের অনেকই কিছু দিনের মধ্যেই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক অনিয়ম এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। প্রশ্ন উঠছে—প্রবীণরা কেন প্রবীণদেরই নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন?
|আরো খবর
প্রথমত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বপ্রবণতা প্রবীণ সংগঠনগুলোর বড়ো দুর্বলতা। অনেকেই নেতৃত্বকে আজীবন মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ধরে রাখতে চান। পদ ছাড়ার মানসিকতা থাকে না। ফলে নেতৃত্বে নবায়ন বা তরুণদের অন্তর্ভুক্তি বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা নষ্ট হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রবীণ সমাজে বিশ্বাসের সংকট ও আত্মকলহ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক সময় উদারতার বদলে সন্দেহপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। একে অপরের সাফল্যে সহযোগিতা না করে, প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এতে দলীয় সংহতি ভেঙ্গে পড়ে, সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।
তৃতীয়ত, আর্থিক স্বচ্ছতার অভাব ও অসততা সংগঠনগুলোর প্রতি সদস্যদের আস্থা নষ্ট করছে। অনুদান, প্রকল্প বা দান ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহির ঘাটতি থেকে যায়। ফলে সদস্যরা নেতৃত্বের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং সংগঠনগুলো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
চতুর্থত, প্রশিক্ষণের অভাব ও আচরণগত সীমাবদ্ধতাও বড়ো সমস্যা। অনেক প্রবীণ জীবনে সফল হলেও সংগঠন পরিচালনার নীতি, পরামর্শ সভা পরিচালনা বা দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত নন। এতে নেতৃত্বে একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব তৈরি হয়, বিরোধী মতামতকে জায়গা দেওয়া হয় না। ফলে সংগঠন হারায় গণতান্ত্রিক গতি।
পঞ্চমত, তরুণ প্রজন্ম থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রবীণ নেতৃত্বকে আরও দুর্বল করেছে। তরুণদের উদ্যম, প্রযুক্তি জ্ঞান এবং উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগানোর মানসিকতা অনেক প্রবীণের মধ্যে নেই। ফলে সংগঠনগুলো সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে ব্যর্থ হয় এবং জনসম্পৃক্ততা হারায়।
সবশেষে, প্রবীণ নেতৃত্বে আচরণগত ক্রটি ও আত্মঅহংকারের প্রবণতাও অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ নিজেকে অপরিহার্য ভাবেন, অন্যের মতামতকে তুচ্ছ করেন। এতে সহমর্মিতা ও সম্মিলিত দায়িত্ববোধ কমে যায়।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এখন সময় এসেছে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও তরুণদের উদ্যমকে একত্রিত করে সমন্বিত নেতৃত্ব কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। আর্থিক স্বচ্ছতা, নিয়মিত নেতৃত্ব নির্বাচন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং নৈতিক চর্চার ভিত্তিতে সংগঠন পরিচালনা করতে পারলে প্রবীণ নেতৃত্ব আবারও আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে।
প্রবীণরা সমাজের জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও পথপ্রদর্শক মানুষ। তাঁদের নেতৃত্ব ব্যর্থ হওয়া মানে সমাজের একটি মূল্যবান সম্পদের অবমূল্যায়ন। তাই এখনই দরকার আত্মসমালোচনা, সহযোগিতার মনোভাব এবং নতুন নেতৃত্বকে জায়গা করে দেওয়ার সাহস, যাতে প্রবীণ সমাজ নিজেরাই নিজেদের আলোকিত ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারেন।





