প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৫
প্রবীণদের মধ্যে নার্সিসিস্টিক লক্ষণ ও করণীয়

প্রবীণ বয়সে মানুষের মানসিক পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই শারীরিক দুর্বলতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আত্মমর্যাদার সংকট ও পারিবারিক অবহেলার মুখোমুখি হন। এই অবস্থায় কিছু প্রবীণ ব্যক্তি নিজেদের অতীত সাফল্য, প্রভাব বা গুরুত্বকে অতিরিক্তভাবে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে ভালোবাসেন, অন্যের মতামত বা অনুভূতিকে তুচ্ছ মনে করেনÑএগুলোই নার্সিসিস্টিক বা আত্মমুগ্ধতার লক্ষণ। প্রবীণ বয়সে এই প্রবণতা কখনো স্বাভাবিক আত্মসম্মানের প্রকাশ, আবার কখনো মানসিক বিকারের রূপ নিতে পারে।
|আরো খবর
প্রবীণদের মধ্যে নার্সিসিস্টিক লক্ষণসমূহ
১. অতিরিক্ত আত্মগর্ব ও আত্মপ্রচার : অনেক প্রবীণই নিজের অতীত অর্জন নিয়ে অহংকারে ভোগেন। তাঁরা বারবার বলেনÑ“আমার সময় এমন ছিলো না”, “আমার ছাড়া কিছুই হতো না” ইত্যাদি। নিজেদের জীবনকাহিনি বা কৃতিত্ব অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেন।
২. অন্যদের প্রতি অবজ্ঞা ও সংবেদনহীনতা : তারা অন্যের সাফল্য বা মতামতকে গুরুত্ব দিতে চান না। ছোটদের চিন্তা, আধুনিক ধারণা বা নতুন প্রজন্মের সাফল্যকে তুচ্ছ মনে করেন।
৩. মনোযোগের কেন্দ্র হতে চাওয়া : যে কোনো আলোচনা বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁরা চান, সবাই শুধু তাঁর দিকেই মনোযোগ দিক। যদি তা না হয়, তাঁরা রাগান্বিত বা বিমর্ষ হয়ে পড়েন।
৪. সমালোচনা সহ্য করতে না পারা : যদি কেউ তাঁদের ভুল ধরিয়ে দেন, তাঁরা তা মেনে নিতে পারেন না। বরং সমালোচনাকারীকে হেয় করেন বা মানসিকভাবে আঘাত করেন।
৫. সহানুভূতির অভাব : অন্যের কষ্ট, অনুভূতি বা প্রয়োজন বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারেন না। তাঁরা ভাবেন, “আমার সময় যেমন ছিলো, এখনো তেমনই থাকা উচিত।”
৬. নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা : পরিবারে বা সমাজে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে চান। সন্তান বা নাতি-নাতনিদের জীবনে হস্তক্ষেপ করে বলেন, “আমিই জানি কোনটা ঠিক।”
৭. হতাশা ও একাকীত্বের ছায়া : নার্সিসিজমের অন্তরালে অনেক সময় ভয় ও শূন্যতা কাজ করে। প্রবীণরা তখন অহংকারের আড়ালে নিজের অসহায়তা বা পরিত্যক্ত হওয়ার ভীতি ঢেকে রাখেন।
নার্সিসিস্টিক প্রবণতার কারণসমূহ
দীর্ঘদিনের সামাজিক প্রভাব বা নেতৃত্বে থাকার অভ্যাস অতীত গৌরব হারানোর শূন্যতা
বার্ধক্যের সঙ্গে আসা অবমূল্যায়নের অনুভূতি
একাকীত্ব, অবসর ও মানসিক নিঃসঙ্গতা
শারীরিক দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত আত্মবিশ্বাসের অভাব।
করণীয়
১. সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ : নার্সিসিস্ট প্রবীণদের সঙ্গে তর্ক বা বিরোধ নয়, বরং সহানুভূতি দেখাতে হবে। তাঁদের অভিমান বা অহংকারের পেছনে যে একাকীত্ব কাজ করছে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
২. যোগাযোগ বজায় রাখা : পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত কথা বললে, তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। ভালোবাসা ও মনোযোগ পেলে আত্মকেন্দ্রিকতা অনেকটাই কমে যায়।
৩. অর্থবহ ভূমিকা দেওয়া : প্রবীণদের ছোট ছোট দায়িত্ব দিনÑনাতির পড়া দেখা, গাছের যত্ন নেওয়া, পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। এতে তাঁদের ‘আমি অপ্রয়োজনীয়’ ভাবনা দূর হয়।
৪. মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা : যদি আচরণ খুব কঠিন হয়ে উঠেÑঅন্যকে কষ্ট দেয়, বা সম্পর্ক নষ্ট করেÑতবে একজন সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিতে হবে। থেরাপির মাধ্যমে তাঁরা আত্মমর্যাদা ও সহমর্মিতা দুটোই পুনর্গঠন করতে পারেন।
৫. আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সম্পৃক্ততা : ধর্মীয় চর্চা, সমাজসেবা, ক্লাব বা প্রবীণ সংগঠনে যুক্ত হওয়াÑএসব কার্যকলাপ তাঁদের মনোযোগকে নিজের থেকে সমাজের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
৬. নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া শেখানো : প্রবীণদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, প্রতিটি বয়সের নিজস্ব মর্যাদা আছে। আজকের তরুণরা যেমন পরিবর্তনের বাহক, প্রবীণরাও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারÑদুই প্রজন্মের সহযোগিতা সমাজকে সুন্দর করে তোলে।
উপসংহার :
প্রবীণ বয়সে নার্সিসিস্টিক আচরণ অনেক সময় আত্মমর্যাদার ক্ষয় ও একাকীত্বের প্রতিক্রিয়া। ভালোবাসা, মনোযোগ ও মানসিক সহায়তা পেলে তাঁদের আচরণ কোমল হয়। সমাজ ও পরিবার যদি সহানুভূতির সঙ্গে তাঁদের পাশে থাকে, তবে প্রবীণ জীবনও হতে পারে স্নেহ, জ্ঞান ও মর্যাদার অনন্য সময়।




