শুক্রবার, ০৮ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৭

ইসলাম ও বিজ্ঞান

আহমেদ উল্লাহ ভূইয়া
ইসলাম ও বিজ্ঞান

সভ্যতা ও আধুনিকতার ধ্বজাধারী পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের এদেশীয় একশ্রেণীর ইতিহাস জ্ঞান বিবর্জিত বুদ্ধিজীবি এবং তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতিবিদগণ প্রায়শঃ বলে থাকেন, ইসলাম বিজ্ঞান বিমুখ ধর্ম। এঁরা নিজদেরকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতেও যেন সংকোচ বোধ করেন। মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ তথা পশ্চাদপদাতাকেই ইসলামের অবয়ব হিসেবে নিজদের নিষ্প্রভ ভাবেন। প্রকৃত সত্য এঁদের কূপমণ্ডপতার খোলসের বাইরে। আজকের কথিত সভ্য পৃথিবীর মানুষ যখন কাপড় পরতেও জানতোনা, ঝাড়-ফুঁক আর ডাকিনি বিদ্যাচর্চায় ব্যস্ত ছিল-তখন মুসলমানরাই পবিত্র কোরানের শিক্ষায় উৎসাহিত হয়ে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বিজ্ঞান সাধনায় নিজদের নিয়োজিত করেন। তঁাদেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়ভিত্তিক রূপ লাভ করে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর ধর্মপ্রচার ও বিজ্ঞানময় ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআন লাভের আগে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর মতো আরব জাতিও বহুধা বিভক্ত এবং কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। মুহাম্মদ (স.) এর ওফাতের একশত বছরের মধ্যেই আরবীয় মুসলমানগণ সিরিয়া, ইরাক, মিশর, ইরান, স্পেন এবং আফ্রিকান উপদ্বীপ বিজয়ের সাথে বিজ্ঞানময় ধর্মীয় আলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ-রাষ্ট্রকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেন। পবিত্র কোরআান বিচ্ছিন্ন অবিশ্বাসীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলে। সকল বিচ্ছিন্ন গ্রীক, সিরীয়, মিশরীয়, পার্শিয়ান এবং দ্রাবিড়ীয় বিজ্ঞানভিত্তিক লিখনীকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং সংরক্ষণ করেন। এ বিষয়ে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ সাল) এবং ইসলামের ৫ম খলিফা হারুন-অর-রসিদ (৭৮৬-৮০৯ সাল)।

ইসলামিক শিক্ষা সূচীতে ছিল, ওসানোগ্রাফি, কেমিস্ট্রি, পিজিকস, ম্যাথম্যাটিকস, পিজিওলজি, মেডিসিন, এগ্রিকালচার, জুলজি, বুটানী, সয়েলসাইন্স, জিওগ্রাফি, এস্ট্রোনমি, ফিলোসফি, সোসাল ডেমোগ্রাফি এবং আইন শাস্ত্র। পবিত্র কোরান মানব জাতিকে বিজ্ঞান সাধনার জন্য বার বার তাগিদ দিয়েছে। শুধু তাই নয় হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তঁার বিদায় ভাষণে পবিত্র আরাফাতের ময়দানে ঘোষণা করেন, ‘মানব সম্প্রদায়ের কল্যাণ এবং জ্ঞানান্বেষণের জন্য একঘন্টা বিজ্ঞান সাধনা-মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি বিধানার্থে সত্তর ঘন্টা ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য।থ

পবিত্র কোরআনের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমান মনিষীগণ বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। ৭২১-৮১৫ সালের দিকে জাবির ইবনে হাইয়ান একজন ডাক্তার ও রসায়নবিদ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এ সময়ে ভিনেগার নামক আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত রসায়নটি পানির সাথে দ্রবিভূত ছিল বিধায় এর উপযোগিতা তেমন অনুভূত হতো না। জাবিরই প্রথম পাতনের সাহায্যে এসিটিক এসিড আবিষ্কার করেন যা ছিল খুবই খঁাটি-নির্ভেজাল এবং কার্যকর। তিনিই আবিষ্কার করেন ম্যাঙ্গানিজ-ডাই-অক্সাইড যা কঁাচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তিনি আর্সেনিক হতে সালফাইড পৃথকিকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং এ্যান্টিমনি উদ্ভাবন করেন। লোহার বিশৃদ্ধিকরণ পদ্ধতিরও আবিষ্কর্তা তিনি। মাকারী এভং ফসফরাসের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য তিনি নির্ণয় করেন। তঁার পঁাচশতের উপর থিসিস রয়েছে। তঁার লিখিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে, “দি বুক অব মার্কারীচ্, “বুক অব কনসেনট্রেশনচ্, দি লিটল বুক অব ব্যালেনসেসচ্, দি বুক অব ইষ্টার্ণ মার্কারীচ্, “দি বুক অব রয়ালটিচ্ প্রভৃতি। তঁার জ্ঞানগর্ব এবং তথ্য বহুল বইগুলো অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত ল্যাটিন, ইংরেজি, জার্মান এবং ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। আর এর হাত ধরেই ইউরোপীয়দের বিজ্ঞান জগতে আসা।

আরেকজন বিখ্যাত রসায়নবিদ এবং চিকিৎসক হলেন আল-রাজী, যিনি বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরানে জন্মগ্রহন করেন (৮৫০-৯২৩ সাল)। ইউরোপীয়রা তঁাকে ‘রাজেসথ বলে ডাকে। তিনি পারদ ও সালফিউরিক এসিডকে পেস্ট হিসেবে রোগ চিকিৎসায় ব্যবহার করতেন। তিনি ডিমের সাদা অংশকে গরম করে জিপসামের সাথে মিশিয়ে প্লাস্টার অব প্যারিস তৈরি করেন যা সার্জারিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অদ্যাবদি শুধু তাই নয় ত্রয়োদশ শতাব্দিতে আবুল কাশেম আল-ইরাকী এবং আবদুল্লাহ-আল-কাশানী নামে অনুরূপ দুথজন রসায়নবিদ ছিলেন যঁারা সে সময়কার খ্যাতিমান চিকিৎসক ও রসায়নবিদ ছিলেন। চতুর্দশ শতকের আরেকজন বিখ্যাত রসায়নবিদ ছিলেন আল-জিলদাকি। বাগদাদের বিখ্যাত খলিফা আল মামুনের সময়কালীন বিখ্যাত পদার্থবিদ এবং প্রকৌশলী বানু মুসার নাম আজও সবাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন যঁারা অন্ততঃ বিজ্ঞানের ক্রম বিকাশের ইতিহাস জানেন। তিনিই ওজন মাপার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তঁার লিখিত বইয়ের নাম, “বুক অব ব্যালেন্সচ্। আরবে জন্মগ্রহণকারী আবু আল হাসান ইবনে আল হাইথাম যিনি পশ্চিমা বিশ্বে আল হাজেন নামে খ্যাত যিনি অতিব ব্যতিক্রমি মেধাসম্পন্ন পদার্থবিদ এবং অংকশাস্ত্র বিশারদ। দশম শতাব্দিতে জন্মগ্রহণকারী আরব বিজ্ঞানীদের মাঝে তিনি ব্যতিক্রম। তঁার বিশ্বখ্যাত বই “কিতাব আল মানাজিরচ্ (অপটিকা থিসোরাস আল হাজেনি) এতটাই স্বীকৃত ও সমাদৃত ছিল যে, বিখ্যাত ইউরোপীয় বিজ্ঞানী রজার বেকন, কেপলার, ভিটেলিয়াসসহ অন্যান্যরা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। তঁার প্রদত্ত মতামত ছিল একেবারেই মৌলিক এবং বাস্তব যা এর আগে কেউই ভাবতে পারেন নি।

১০৩০ সালে আল হাজেনই প্রথম বাতাসের রূপ এবং বায়ুস্তরের উচ্চতা পরিমাপ করেন বিজ্ঞানের উপর তঁার কাজে উৎসাহবোধ করেই ইউরোপীয়গণ সপ্তদশ শতাব্দিতে বিজ্ঞান সাধনায় উদ্বুদ্ধ হন। তঁাকেই অনুসরণ করেন ইউরোপীয় বিখ্যাত বিজ্ঞানীগণ যথা রজার বেকন, রবার্ট এসেছি, জন পেচহাম, লিওনার্দো দ্যা ভিন্সি প্রমুখ। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দিতে আগমন ঘটে বিখ্যাত পদার্থবিদ আল-খরিজমির যিনি তৈরি করছিলেন “সিনজারিক টেবিলচ্ এবং লিখেন “বুক অব ব্যালেন্সচ্ বাতাসের ওজন নির্ণয় এবং মধ্যাকর্ষণের শক্তি নির্ণয় তঁার বিখ্যাত আবিষ্কার। বিজ্ঞানী আল জাজারির হাইড্রোলিকস তথা জলের গতি ও তথা হতে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের ধারণ্য আধুনিক বিজ্ঞানকে গতির ঢাকার উপর স্থাপন করে। ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের প্রায় সাতশত বছর আগে ইবনে হিশাম মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেন।

আরেকজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী হলেন কুতুব উদ্দিন সিরাজী (১২৩৬-১৩১১ সাল) যিনি হালাকুখানের শাসনামলে মাবাঘার মহাশূন্য পর্যেবক্ষণ কেন্দ্রের বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। অধিকন্তু তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি প্রমাণ করেন যে, পানির ওপর পতিত সূর্যালোকের প্রতিক্রিয়াই রেইনবো। বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ (৮১৩-৮৩৩) তৎকালীন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান প্রেমী শাসক ছিলেন। তঁারই সময়ে ইরাকের খিবায় জন্মগ্রহণকারী ইবনে মূসা আল খারিজমি তৎকালীন বিশ্বের একজন সেরা গণিতজ্ঞ ছিলেন। তিনিই প্রথম গ্রীক ও ভারতীয় অংক শাস্ত্রের সমন্বয় সাধন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি দশমিক অংক-তথা হিসেবে দশমিকের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার এবং চথ এর ব্যবহার আবিষ্কার করেন। এ্যালগোরিজম এবং এ্যালজেব্রায় তঁার অবদান অনস্বীকার্য। ওমর খৈয়াম ও তঁার কাজে খারিজমির ব্যবহৃত চিহ্ন ব্যবহার করতেন। ১১২৬ সালে তঁার উদ্ভাবনী লিখনি লেটিনে অনুবাদ হলে ইউরোপীয়গণ তঁার কর্মযজ্ঞে উৎসাহিত হয়ে বিজ্ঞান সাধনায় এগিয়ে যায়। দশম শতাব্দিতে (৯০৮-৯৪৬) ইব্রাহিম ইবনে সিনান নামে একজন। বিখ্যাত অংকশাস্ত্রবিদ, দেহততত্ত্ববিশারদ এবং নভোমণ্ডল বিশারদ আত্মপ্রকাশ করেন। তঁার কার্যাবলী জার্মানগণ লুফে মেন। ভাষান্তর করেন, ‘আবহান্দলাংগ উবার ডাই আউমমোসাং ডার পেরাবেলচ্ নামে। অধিকন্তু তিনি উল্লেখযোগ্য। অবদান রাখেন, কনিকস, ডায়ালিং এবং জ্যামিতি শাস্ত্রের উপর। পারস্যের আবুল ওয়াফা (৯৪০-৯৯৮) ছিলেন বিখ্যাত অংকশাস্ত্রবিদ ও জ্যামিতি বিশারদ। তিনি অংকশাস্ত্র ও জ্যামিতির উপর পুস্তক রচনা করেন। তিনি ত্রিগনমিত্রি, দশমিকের ভগ্নাংশ, সাইকান্ট ও কো-সাইকান্টের উদগাতা।

একাদশ শতাব্দির প্রারম্ভে আল কুর্তি অংকশাস্ত্রের উপর রচনা করেন, “আলকাফি ফিল হিসাবচ্ এবং বাই-নোমিয়ালের সমাধান সূত্র দেন পারস্যের আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮) ছিলেন একজন বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, দার্শনিক, ভূগোল বিশারদ এবং বিশ্বকোষ লিখক। তঁাকে সকল যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি বিজ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করেছেন সাফল্যের সাথে। তিনি জিওমেট্রিক প্রগ্রেশন এবং জিওডেটিক পরিমান সূত্রের সমাধান করেন।

তঁার সমসাময়িক গণিতবিদ এবং মাহাকাশ বিজ্ঞানীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আল-মাহানী, আল-খাজিন, আল-কুহি, আল সিজি, আবুল যুদ এবং ওমর খইয়্যাম। যদিও ওমর বইয়্যাম তঁার রুবাইয়াতের জন্যই সমাধিক পরিচিত, তথাপি তিনি গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে সমাধিক পরিচিত। তিনি জ্যামিতিক বীজ গণিতের আবিষ্কর্তা-যা ১৮৫১ সাল, “লা এলজোর দ্যা ওমর খইয়্যামিচ্ নামে ফরাসী ভাষায় অনুদিত করেন ‘এফ, উইপকে।থ পরবর্তীতে উক ফরাসী অনুবাদক স্পেসিমেন ক্যালকুলি ফ্লাঙ্গিুনেলচ্ নামে ওমর খইয়্যামের আরেকটি গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তঁার গ্রন্থ বীজগণিত এখনও প্যারিস, ল্যাডেন, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও লাহোর লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে বেশ কিছু জ্যোতিবিজ্ঞানী ছিলেন মিশর, পারস্য, সিরিয়া এবং স্পেনে। প্রথম মুসলমান জ্যোতিবিজ্ঞানী ছিলেন আবু ইসাহাক যিনি ৮ম শতকে খলিফা আল মামুনের আমলে (৮১৩-৮৩৩) জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম মুসলমান বিজ্ঞানী যিনি মহাকাশ পর্যেবক্ষন মন্দির নির্মাণ করেন। পারস্যের আল হাসির (৭৭০-৮৬৪) একজন বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী যিনি দীর্ঘকাল “বাইতুল হিকমাহচ্ তে কর্মরত ছিলেন। আল কারগানির লিখা বই, “দ্যা এলিমেন্টস অব এস্ট্রোনমিচ্ ইউরোপীয় বিজ্ঞানী রেজিওমন্টানাস, জর্জ পিওরবাক প্রমুখসহ পঞ্চদশ শতাব্দির শেষভাগ পর্যন্ত অনুসৃত হতে থাকে

আরেকজন জ্যোতিবিজ্ঞানী আল-বাতেনী (৮৫৮-৯২৯) ইরাকে জন্মগ্রহণকারী যিনি বহুদূরে অবস্থিত তারকা ও গ্রহগুলোর নির্ভুল দূরত্ব নির্ণয়ে সক্ষম ছিলেন। তঁার আবিস্কার ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত হয়। “দ্যা সায়েনশিয়া স্টেলারাসচ্ ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করে। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি বছরের বিভিন্ন দিন ও রাতের নির্দিষ্ট সময় নিরূপন করেন এবং ২০ বা ২১শে মার্চের দিন রাতের সময়ের সমতা নির্ণয় করেন। অনুরূপভাবে নির্ণয় করেন ২২শে সেপ্টেম্বর ও ২৩শে সেপ্টেম্বরের দিন ও রাতের সময়ের সমতা। তিনিই সংশোধন করেন টলেমির ধারণা। আরেকজন মিশরীয় বিজ্ঞানী ও জ্যোতিবিজ্ঞানী যিনি ৯৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি দীর্ঘকাল খলিফা আল হাকিমের রাজত্বকালে মহাশূন্য পর্যেবক্ষণ কেন্দ্রে চাকুরী করেন। তিনি তঁার সময়েরও দুইশত বছরে আগেরকার সকল মহাশূণ্য বিজ্ঞানী ও অংকশাস্ত্রবিদদের সূচী তৈরি করেন।

নবম শতকের শেষ দিকে আল-হাসান (মুসা বিন সাকির) এবং তঁার দুই সহোদর বিজ্ঞান ও জ্যোর্তিবিদ্যায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। জিওমেট্রি এবং ওজন পরিমাপক যন্ত্রের নির্মাণে তঁারা অসামান্য অবদান রাখেন। জেরারদো দ্যা ক্রেমোনা (১১১৪-১১৮-৭) “লিবার ট্রিয়াম ফ্রানট্রাম দ্যা জিওমেট্রিয়াচ্ নামে উক্ত বিজ্ঞানীদের পুস্তকাবলী ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছেন জেরাবদো। মুসলমান বিজ্ঞানীদের গণিতশাস্ত্র, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রকৃতি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করাতে ইউরোপীয়রা বিজ্ঞান বিষয়ে অবগত হয়। আবু গাফাফার আবদুল্লাহ আল মনসুর (৮৭২-৯০০) মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ করেন বাগদানে। তিনি অংকশাস্ত্র ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অনেক বই লিখেন। পারস্যের আবদুর রহমান (১০৩-১৮৬) রাজকীয় জ্যোতিবিদ হিসেবে বাগদাদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, যিনি “সুওয়ার আল-কাওয়াকিন আল-খ্যাবিটাচ্ নামক বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়কগ্রস্থ লিখেন তিনি দূর আকাশের স্ত্রীর তারকার দূরত্ব নির্ণয়ে নির্ভুল সূত্র দান করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনার অবদান কে না জানে ?

আবুল ওয়াফা (১৮০ আরেকজন মুসলমান বিজ্ঞানী যিনি সর্বপ্রথম ত্রিগোনমিত্রির বর্তমান রূপ দান করেন। তিনি মহাশূন্যযানের বেশ কিছু যন্ত্র আবিষ্কার করেন। আরেকজন সিরিয় মুসলমান বিজ্ঞানী আল-মাজরিতি যিনি টলেমির “প্লানিসপোরিয়ামচ্ এর ওপর গবেষণা করেন এবং গণিতশাস্ত্রের উন্নয়ন করেন। এ সময়ে মরক্কোর আল হাসান মারাকুশি রচনা করেন, জ্যোতিবিদ্যা যার অন্যান্য বিখ্যাত বই হলো “জামি আল মাসাদি ওয়াল গিয়াতিচ্ এবং “দি ইউনিটার অব দ্যা বেগিনিং এন্ড ইন্ডসচ্। ১৯৮৮ সালে আলনাদিম নামক একজন মুসলমান বিজ্ঞানী রচনা করেন “ফিরিসি আল উলুমচ্ যা বিজ্ঞানের সকল শাখায় সমন্বিত রূপ। দুঃখের বিষয় হালাকু খান ইরাক আক্রমণ করে বাগদাদের সকল স্থাপনা ও বিজ্ঞানগার এবং লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেয়। এতে সবচেথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্বসভ্যতা এবং বিজ্ঞান। আর ইরাক আক্রমনে হালাকুখানকে উদ্বুদ্ধ করে তার খ্রিষ্টজন স্ত্রী ডুকজ ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে। বাগদাদের ২০ লাখ অধিবাসির মাঝে ১৬ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ডুকজ ছিল এক খ্রিষ্টান ধর্মাচারীর সুন্দরী কন্যা।

তবে ইতিহাস স্বাক্ষ্য বহন করে যে, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রবক্তা মুসলমানরাই যা ভাবতে অবাক লাগে ৬৯ জন মুসলমান ভূগোলবিদ পৃথিবীর যে নিখুঁত মানচিত্র এঁকেছেন-তা আজও বিশ্বের বিস্ময়। এর আরবি নাম ‘সূরাতুল আরদথ বা পৃথিবীর আকৃতি। মুসলমানরাই পৃথিবীতে প্রথম কাগজ তৈরী করেন। ইউসুফ ইবনে উমর ৭০২ খ্রিষ্টাব্দে তুলা থেকে তুলট কাগজ তৈরি করেন। ৭০৪ খ্রীস্টাব্দে বাগদাদে কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীতে উচ্চ আদালতখ্যাত হাই কোর্টের প্রচলন বা যাত্রা শুরু ইরাক থেকে ১১৪৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা আতাবেক।

ইতিহাসবিদ হিসেবে যঁারা আজও জগতের বিস্ময় তঁারা হলেন, ইবনে কাশেম আল বিরুনী, আলবিন হামিদ। বাইহাকি, উৎবী, কাজী মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ, মোহাম্মদ ঘোরি, সিরাজ উদ্দিন বারনী, আমীর খসরু, শামসী সিরাজ, ইয়াহিয়া বিন আহমদ, গওহার, আব্বাস শোওয়াতি, আবুল ফজল, বাদাউনী, ফিরিস্তা, কাফি খঁা, মীর গোলাম হোসেন, হুসাইন সালমী, সাঈদ আলী প্রমুখ ইতিহাসবিদ। রচিত বিখ্যাত ইতিহাসের মধ্যে তারিখই হিন্দ, কিতাবুল ইয়ামিনি, তারিখই-মাসুদি, তাবাকাতই নাসিরি, তারিখে সেনাতিনে আফগান, তারিখে শেরশাহী, মাখজানে আফগান, ফতহুল বুলদান, মুনতাখাবুত আত তারিখই-তাকরী, মারওয়াজুজ জাহাব, আখবারুল আব্বাস, ইসদুল গাবাহ, আইনী আকবরী তারিখুল হিন্দ, খাজেনুল ফতওয়া, কিতাবুল ফিদ-আ, মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ প্রভৃতি বিখ্যাত ইতিহাস প্রন্থগুলো পৃথিবীতে মুছে যাওয়ার মতো নয়। বাগদাদের খলিফা আল মামুনের সময়ই পৃথিবীতে পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয় বাগদাদে।

৯৭০ সালে কায়রোর আল-আজহার মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পৃথিবীর প্রাচীনতম আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়-যা আজও বিদ্যমান। অনুরূপভাবে গড়ে ওঠে..........গ্রানাডা, টলেডো, মার্সিয়া, আলমেরিয়া, সেভিল, ফেজ, টিংবাকতু, ভেলেনসিয়া, কাদজে বিশ্ববিদ্যালয়। যখন আজকের সভ্য ইউরোপ ঠিক মত বস্ত্র পরিধান করতেও জানতো না। সে সময়েই কাগজের মেশিন আবিষ্কৃত হয়- বাগদাদ, সিরিয়া, দামেস্ক, ত্রিপলি এবং হামায়।

সুতরাং বিশ্বসভ্যতা বিনির্মানে, বিজ্ঞান সাধনায়, রাষ্ট্র পরিচালনায়, সংগ্রামে এবং সহমর্মিতায় বিশ্বে মুসলমানরাই যোগ্য শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে। সমৃদ্ধ এবং গর্বিত ঐতিহ্যের ধারক মুসলমান জাতি আত্ম পরিচয় ভুলে আত্মকলহে লিপ্ত হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী মুসলমান সম্প্রদায়ের। এতো লাঞ্ছনা।

বিজ্ঞান মনস্কতা বিসর্জন দিয়ে আমরা আজ বিভাজনের পথে চলতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি। হারানো অতীত ঐতিহ্যকে ফিরে পেতে হলে অতীতকে জানতে হবে ভারত উপ-মহাদেশে মুসলমানদের অবদান নিয়ে আগামী সংখ্যায় লিখার ইচ্ছে রইল। ধর্ম, কর্ম ও বিশ্বাসে আমরা যে কোনো জাতি হতে খাটো নই, এ আবেদন সকল মুসলমান ভাই বোনদের প্রতি। আমাদের সৎ কর্ম, সৎ চিন্তা, বিজ্ঞান মনস্কতাই আমাদের আলোর পথে নিয়ে যাক-এ আমার কামনা।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আয়কর আইনজীবী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়